১.
বেশ কিছু দিন ধরে তাদের বিয়ের কথা বার্তা চলছিল। দু পক্ষের মাতৃ- পিতৃকূল বহু ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করেন উভয় পক্ষ একত্রে মোলাকাত করবেন। উদ্দেশ্য হল পরিবারের লোকজনের উপস্থিতিতে বিবাহযোগ্য ছেলে মেয়ে দুটোর দেখাদেখি করিয়ে দেয়া।
এদিকে মেয়েটিকে পাত্রের অনেক পুরানো একটি ছবি দেয়া হল, যেখানে তার দাঁড়ি ছিল না। পাত্র পক্ষের দুশ্চিন্তা ছিল, এতে মেয়ে যদি বেঁকে বসে! যদিও মেয়ে কিন্তু পাত্রের ছবি দেখে আগে থেকেই ভেবে নিয়েছিল, কোনক্রমে যদি এর সাথে বিয়ে হয়েই যায়, তবে উনাকে দাঁড়ি রাখতে বলবে।
ছবি দেখে কেন যেন মনে হচ্ছিল এই ছেলেকে দাঁড়িতে ভীষণ মানাবে। মজার ব্যাপার হল ছেলেটিও মনে মনে চাচ্ছিল মেয়েটি যেন হিজাবধারী হয়। সে তখনো জানত না যে পাত্রী পর্দা করে।
মায়ের ঠেলা ঠেলিতে বাধ্য হয়ে মেয়েটি যেতে রাজি হয়। তবে সে খুবই সাদামাটা ধরণের সাজ পোষাকে তৈরি হয়। এখনকার মেয়েরা ঘরের ভেতরও এর চেয়ে দামী কাপড় পড়ে।
জীবনে প্রথম একটা ছেলের সাথে দেখা করতে যাবার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যেয়ে তার কেমন লাগছিল তা আর নাই বা বললাম।
যখন মেয়েটি নির্ধারিত স্থানে যায় তখন দেখলো, এক কোণায় গৌরবর্ণের অতিরিক্ত লম্বা একটা দাড়িওয়ালা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। যার চেহারা একদম বাচ্চাদের মত কিন্তু পরনে বুড়ো মানুষের মত ঢিলাঢালা কাপড় চোপড়। দেখে মনে হয় কেউ যেন তার বাবার শার্ট প্যান্ট পড়ে চলে এসেছে!!
আর ছেলেটি হয়তো দেখল, ছোট খাট আকৃতির ও নরম শরম দেখতে এবং সে যেমনটি পছন্দ করে ঠিক তেমন ভাবে মাথায় কাপড় দেয়া একটি মেয়ে এসে তার সামনে হাজির হয়েছে।
দুজনে যখন কথা বলার সূযোগ পেল, উভয়েই যার যার নার্ভাসনেস না দেখানোর সর্বোচ্চ প্রয়াস নিল।
ছেলেটি ভুলে চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিল এবং চিনি নিতে ভুলে যাবার লজ্জায় সেই তিতকুটে বিষাদ চা এক ঢোকে খেয়ে নিল। নিশ্চয় প্রথম দিনেই সে মেয়েটির সামনে নিজের ভুলোমনো ভাবের পরিচয় দিতে চাইল না।
আর পাত্রীর অবস্থাও তখন খুব একটা উন্নত ছিল না। বেচারীর চায়ের কাপ হাতে নিতে গিয়েই নার্ভাস ব্রেকডাউনের দশা হল। হাত কাঁপা কাঁপির ফলাফল স্বরুপ চায়ের পিরিচের উপর কাপ খানি ঠকাঠক করে নর্তন কুর্দন শুরু করে দিল।
মেয়েটি লজ্জা ঢাকার জন্য তাড়া তাড়ি চা সমেত কাপটি টেবিলে রেখে দিল। এক জন চিনি ছাড়া চা খেল আর অপর জন তাও খেতে পারল না।
কথা শুরু হবার মাত্র পনের মিনিটের মাঝে মাগরিবের আজান দেয়াতে আলোচনার সেখানেই সমাপ্তি হল। হবু বর তৎক্ষণাৎ নামাজে চলে গেল আর হবু স্ত্রী এতক্ষণে মুগ্ধ হল আলহামদুলিল্লাহ্।
তার সালাতের জন্য সরে যাওয়া দেখে মেয়েটির মনে হঠাৎ যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি হল। সেও তখন সালাতে আল্লাহ্র কাছে একটি বিশেষ দুয়া করল।
আল্লাহ্ সেই দুয়া অল্প কিছু দিনের মাঝে কবুল করে নিলেন। সেদিনের সেই নার্ভাস ও লাজুক তরুন তরুণীদ্বয় দু সপ্তাহের মাঝে এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল।
তাদের বিবাহের আমন্ত্রণ পত্রের উপর কুরআনের ছোট্ট একটি আয়াত লিখে দেয়া হয়েছিল। আয়াতটি কলেবরে তেমন বিশাল না হলেও এর অর্থের, সৌন্দর্যের ও সর্বোপরি এর সত্যতার গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব নয়, কেবল মাত্র অনুধাবন করার চেষ্টা করা সম্ভব।
“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য যারা চিন্তা করে”। সুরার রুমঃ ২১
তাদের এই কাছে আসার গল্প ভেলেন্টাইন ডের “ক্লোজ আপ কাছের আসার গল্পের” মত, হুজুগে মাতানো কোন বিশেষ দিন উপলক্ষে নয়। বরং আল্লাহ্র রহমতে এটি এক পবিত্র কাছে আসার গল্প।
২.
উপরের কাছে আসার গল্পে নেই কোন অশ্লীলতা, অভিভাবকের কান্না, যিনার দিকে প্রলোভন বা সাময়িক মোহ। সেখানে আছে আল্লাহ্ এর অনুগ্রহ, মা বাবার দুয়া ও প্রশান্তিময় হালাল ভালোবাসার সূচনা।
অথচ আজকাল কাছে আসার সাহসী/ দু:শ্বাহসী গল্পগুলো কোন দিকে আহ্বান করছে যুবসমাজকে? যিনা, ব্যাভিচারিতা, পারিবারিক অশান্তি, মোহের বশবর্তী হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া ইত্যাদিকেই শুধুমাত্র প্রমোট করা হচ্ছে চকচকে বিজ্ঞাপনের মোড়কে আবৃত করে!
কাছে আসার যে গল্পগুলোকে বাহবা দেয়া হচ্ছে, একবার অন্তর থেকে ভেবে দেখুন তো, আপনার সন্তান বা আদরের ছোটবোন যদি এ ধরণের মোহের ফাঁদে পড়ে জীবনটা নষ্ট করে দেয়, কেমন অনুভূত হবে আপনার? কিংবা বিয়ের পর যদি জানতে পারেন, আপনার স্ত্রী/ স্বামী বিয়ের আগে যৌবনের উদ্দিপনায় অন্য কারো “কাছে গিয়েছিলো”, তখন হজম করতে পারবেন সেটি?
নিজের পরিবারের জন্য যা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তা সামাজিক ভাবে কিভাবে আমরা মেনে নিচ্ছি? কেনো আমরা অনৈতিক প্রেমকে ‘না’ বলছি না ও হালাল বিবাহকে সহজ করছি না? হাশরের ময়দানে কিভাবে জবাব দেব, তা ভেবেছি কি একবারো?
আমরা যেনো ভুলে না যাই, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন,
“নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।”
(সুরাহ নুর-১৯)
কাছে আসার গল্প গুলোর ভিত্তি যেনো হয়, আল্লাহ্ এর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পবিত্র ভাবে দুটো স্বত্তার বৈধ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। মিডিয়ার কল্যাণে, অশ্লীলতা বা যিনার প্রচার যেনো আমাদের দৃষ্টিতে শোভন হয়ে না দাঁড়ায়।
একটি অন্যরকম কাছে আসার গল্প
বিনতে হক
( ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৮)