সুমাইয়া আজ সিয়াম রেখেছে


“ওঠো আম্মু, সেহরি খাবে না ?” আম্মুর এক ডাকেই লাফ দিয়ে উঠে বসে সুমাইয়া। আজকে ওর সেহরি খেতেই হবে। কালই ও রোযা থাকতে চেয়েছিল। কেও ডাকেনি। যখন ঘুম ভেঙ্গেছে ফযরের আযান দিয়ে দিয়েছে। ও অনেক কেঁদেছে। তাইতো মা বলেছে আজ ওকে ডাকবে।

গত বছর রোযায় ওর যখন ৪ বছর ছিল। কেউ ডাকতো না ওকে। একদিন ঘুম ভেঙ্গে ও অনেক কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে ঠাস করে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তবে পড়ার আগে দেখে নিয়েছে বিছানা নাকি মেঝেতে মাথা পড়ছে। মেঝেতে মাথাটা ঠাস করে লাগলে অনেক ব্যাথা লাগে কিনা! তারপর আম্মু একটা রোযা করতে দিয়েছিল। কিন্তু দুপুরের পর ও আর পারেনি। গোসল করার সময় ঝরণার পানি অনেকটা খেয়ে নিয়েছিল। তখন তো ও একা গোসল করা শুরু করেছিল। বের হওয়ার পর দাদুমণি জিজ্ঞেস করেছিল, ক্ষিধে লেগেছে আপুসোনা? পানি পিপাসা লাগে? সরল মনে সুমাইয়া বলে দিয়েছিল পানি খাওয়ার কথা। দাদুমণির সেকি হাসি। সবাইকে ডেকে ডেকে বলে দিয়েছিল। সুমাইয়া কি আর জানতো নাকি ঝরণার পানিও খাওয়া যাবে না। সুমাইয়া খুব রেগে গিয়েছিল। গালটা ফুলিয়ে মুখটা শক্ত করে হতাশ হয়ে আম্মুর দিকে তাঁকিয়েছিল। ওকে তখন ঠিক রাগী বিড়ালের মতই লাগছিল। তারপর আম্মু ডিম ঝোল দিয়ে ভাত খাইয়ে দিলো, রোযা আর রাখা হলো না।

হাতমুখটা ধুঁয়ে খাবার টেবিলে বসলো সুমাইয়া। দাদুভাই এখনো আসেনি টেবিলে। দাদুভাইকে উঠাতে অনেক কষ্ট হয়। একবার বাবা ডাকে, একবার মা, আরেকবার দাদুমণি। মা খাবার গরম করে একটা একটা করে বাটি রাখছে টেবিলে। গরুর মাংসও আছে আজ। সুমাইয়ার খুব পছন্দের খাবার। তাই মা সেহরিতে গরুর মাংস রেখেছে।

ভালো মেয়ের মতো ডাল আর মাংস দিয়ে খেয়ে নেয় সুমাইয়া। কয়েকবার বাবাকে জিজ্ঞেস করে আর কয় মিনিট বাকি আছে। দাদুভাই খাওয়ার মাঝেও অনেক প্রশ্ন করেছে।
“সুমাইয়া কি রোযা রাখবে নাকি!”
“ইন শা আল্লাহ!”
“ইন শা আল্লাহ মানে কী গো!”
“তুমি তো জানো দাদুভাই!”
“ভুলে গিয়েছি। আবার বলো।“
“শোনো মজা করেও মিথ্যা বলবে না কেমন? ইন শা আল্লাহ মানে আল্লাহ্‌ চাইলে। আল্লাহ যদি চান আমি সিয়াম থাকবো। আর প্রশ্ন করো না কেমন? এখনো অনেকটুকু ভাত বাকি। আযান দিয়ে দিলে আর খাওয়া যাবে না।“

সবাই একসাথে হেসে দেয়। সুমাইয়ার রাগ করার মতো সময় নেই, তাই ও খাওয়ায় মন দেয়।

খাওয়া শেষে ওযু করে এসে মা এর সাথে সালাতে দাঁড়ায় সুমাইয়া। মাত্র ৪টা সূরা জানে সুমাইয়া। ফাতিহা, ইখলাস, ফালাক, নাস। আর যেসব দুআ জানেনা সেখানে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ পড়তে থাকে ও। আরেকটু বড় হলে ইন শা আল্লাহ সব দুআ শিখে নিবে। ভাতগুলো এখনো ঠিকমত নামেনি, পানিও অনেক খেয়েছে, তাই সিজদাহ দিতে কষ্ট হয়।

মনে পড়ে পেটের একভাগ খালি রাখার কথা ছিল। একভাগ খাবার, এক ভাগ পানি, একভাগ ফাঁকা এমনটাই রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) করতে বলেছেন। দুই রাকাত পড়ে আর পড়ে না। আসলে ওর তো এখনো সলাত ফরয হয়নি। ফরয হওয়া মানে অবশ্যই পড়তে হবে। রোযাও ফরয না তবু ও রাখতে চায় আজ। কত বছর বয়সে ফরয হবে মা কে জিজ্ঞেস করেছিল। মা বলেছিল বড় হলে এই বিষয়ে বলবে। সুমাইয়া আর কথা বাড়ায়নি।

জানালা দিয়ে আসা রোদ চোখের উপর পড়ায় চোখ কুঁচকে ফেলে সুমাইয়া। ঘড়ির দিকে তাঁকায়। বাবার থেকে শিখে নিয়েছে ঘড়ি দেখাটা। সবচেয়ে মোটা কাঁটাটা দশের কাছে। মানে ১০টা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে ও। সবসময় বড়জোর ৮টা বাজে। হঠাৎ মনে পড়ে রাতে ও সেহরি করেছে, আজ রোযা। আস্তে আস্তে বাথরুমে গিয়ে দাঁতটা ব্রাশ করে নেয়। খুব সাবধানে করে, যেন পানি গলায় চলে না যায়। বারবার করে থুতু ফেলে। বের হয়ে দাদুমণি আর দাদুভাই এর রুমে যায় ও। দাদুভাই পত্রিকা পড়ছে। দাদুমণি নাই। হয়তো এখনই ইফতার সেহরির রান্না জুড়ে দিয়েছে। দাদুভাই এর প্রশ্ন থেকে বাঁচতে তাড়াতাড়ি মা এর খোঁজে বের হয় ও।

টাইল্‌স দেয়া মেঝেটা দাবার ছক কাটা বোর্ডের মতো। প্রতিটা ছকে মাত্র একবার করে পা ফেলে সুমাইয়া। এটা ওর মজার খেলা। একবারের বেশি কোনো ছকে পা পড়ে গেলে আবার শুরু করে। মা স্টাডি রুমে বসে ল্যাপটপে লিখছে। স্টাডি রুমটা খুব ছোট। সুমাইয়া আরেকটু বড় হলে এই রুমটা ওর হয়ে যাবে। তাই এই রুমের সব একটু নজরদারিতে রাখে সুমাইয়া। সেদিন ফুপাতো ভাই আরিফ একটু রং পেন্সিল দিয়ে দেয়ালে দাঁগ কেঁটেছিল। সুমাইয়া ভালো মতো বকে দিয়েছে। কিন্তু আরিফ তবু হেসেছে। আসলে আরিফ বোধহয় কিছু বুঝেনি। ওর এখনো দুই বছর হয়নি।

মা খটখট করে টাইপ করে যাচ্ছে। সুমাইয়াকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। মা এর হাসি খুব সুন্দর। সুমাইয়া রেগে থাকলেও মা এর হাসি দেখলে অল্প হলেও হাসে। ও মা এর গা ঘেষে বসে। খুব সুন্দর গন্ধ মা এর গা এ। কোনো ব্র্যান্ডের পারফিউম না, এটা আল্লাহ্‌র দেয়া পারফিউম। অনেক প্রিয় গন্ধ। মা অনেক লেখালেখি করে। মা এর বান্ধবীরা বলে মা এর লেখার হাত নাকি দারুণ। মা বড়দের গল্প লিখে।

সুমাইয়ার জন্যে একটা বাবুদের গল্পও লিখেছিল। গল্পের নামটাই হাসির, ইকিলি বিকিলি। সুমাইয়া অনেক হেসেছিল গল্পটা শুনে। মা যে এতো ভালো লিখে সেটা ফুপিকে একদিন বলেছিল। ফুপি মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, “বাচ্চাকাচ্চা আরো থাকলে এসব আজগুবি লেখার সময় থাকতো না।“ সুমাইয়া না বুঝে মাকে বলে দিতেই মার সেকী কান্না। বাবা অফিস থেকে ফেরার পরও মা কেঁদেছে। যদিও ফুপি এসব জানে না। বাবা পরে সুমাইয়াকে বলেছে একজনের কথা আরেকজনকে বলতে নেই। এতে গুনাহ্‌ হয়। একজনের কথা আরেকজনকে বলে সম্পর্ক নষ্ট করলে নামীমাহ্‌ হয়। এটা ভিষণ গুনাহর কাজ। সুমাইয়া এরপর থেকে সব কথা সবাইকে বলে না, শুধু মাথায় গেঁথে রাখে। মাঝে মাঝে কথাগুলো পেটে খুব গুতোগুতি করে। তখন খুব সমস্যা হয়ে যায়। কথাকে তো আর টয়লেটের সাথে বের করে দেয়া যায় না!


গোসল করার পর একটু ঘুমিয়ে নিবে সুমাইয়া। আজ ঘড়ির কাঁটা কি একটু আস্তে নড়ছে? অল্প অল্প ক্ষুধা পাচ্ছে সুমাইয়ার। দুপুরে মা ওর পাশে এসে একটু শোয়। তখন মাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে যায় সুমাইয়া।

আসরের আযানে ঘুম ভাঙ্গে সুমাইয়ার। ঘুম ভাঙ্গতেই মুখের সামনে রুমকির হাসিমুখ দেখতে পায়। রুমকি ওর পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। ওর থেকে একটু ছোট। রুমকি পড়ে নার্সারিতে সুমাইয়া কেজিতে। ওরা প্রতি বিকেলে একসাথে খেলে। খেলনা হাড়ি পাতিলগুলো নিয়ে দুইজন একসাথে বসে পড়ে মেঝেতে। কিন্তু সুমাইয়া রুমকিকে সাবধান করে দেয় আজ কোনোভাবেই ঝগড়া করা যাবে না।

“শোনো আমি সিয়াম আছি। আমরা তো এমনিতেও ঝগড়া করি না । আজও আরো সাবধান থাকতে হবে বুঝলে?”
“সিয়াম আছি মানে কি? আমার ভাইয়ার বন্ধুর নাম সিয়াম।“
“সিয়াম মানে রোযা। মা বলেছে। তোমার আম্মু তোমাকে বলে নি?”
রুমকি চোখ বড় বড় করে দুইদিকে মাথা নাড়ে। আজ একটা নতুন শব্দ শিখলো ও।

এক পাতিলে চা, আরেক পাতিলে মাংস উঠায় দুইজন। সুমাইয়ার চুলাটা জ্বলছে না। রুমকির থেকে একটু আগুন নেয় ও। প্লাস্টিকের চামচটা দিয়ে পাতিলে নাড়তে থাকে, তবু চামচ গরমে গলে যায় না। রুমকি চা এ পাতি দেয়। এভাবে ওদের মিছিমিছি খেলা অনেক্ষণ চলতে থাকে। মা ইফতারের আধা ঘন্টা আগে ডাক দেয়। খেলতে খেলতে ভুলেই গেছিল ক্ষুধার কথা। তাড়াতাড়ি খেলনার বাক্সে পাতিল তুলে রাখে ও। চা আর মাংসের ঝোলে খেলনার বাক্স একাকার হওয়ার ভয় নেই, কারণ সবই ছিল এমনি এমনি রান্নাবান্না।
অযু করে ইচ্ছা করেই ওর প্রিয় স্কার্ফটা পড়ে নেয় সুমাইয়া। কালোর উপর গোলাপি ফুল ফুল। রুমকিকে নিয়ে খাবার টেবিলে বসে। একটু চোখ ট্যারা করে দেখে নেয় ওর সবচেয়ে প্রিয় আলুর চপ আম্মু করেছে কিনা। খাবার নিয়ে এতক্ষণ বসে থাকতে কষ্ট হয় ওর। আযান দিতে এখনো দেরি। দাদুভাইও পাশে বসে। সুমাইয়া মনে মনে ভাবে, “এই যে, এখন একশো হাজারটা প্রশ্ন করবে দাদুভাই।“ অনেক বোঝাতে সুমাইয়া সবসময় বলে একশো হাজার, ওর মনে হয় এটা অনেক বড় সংখ্যা।
“সুমাইয়া বলো তো তোমার নাম কার নামে রাখা হয়েছে।“

এতদিনে উত্তর মুখস্থ হয়ে গেছে রুমকির। খুব আগ্রহ নিয়ে বলে, “প্রথম মহিলা শহীদের নামে। শহীদ মানে যে আল্লাহকে খুশি করতে মারা গেছে।“
দাদুভাই রুমকিকে বলে,” মা শা আল্লাহ। “
রুমকির মুখটা ঝলমল করে ওঠে। সুমাইয়ার দাদুভাইকে ওর অনেক ভালো লাগে। সুমাইয়ার কি সুন্দর সময় কেঁটে যায় দাদুমণি দাদুভাই এর সাথে। রুমকির বাসায় শুধু ভাইয়া, মা আর বাবা। ভাইয়া সারাদিন প্লেস্টেশানে গেইম খেলে, মা তো খুব ব্যস্ত, বাবা রাত করে ফিরে। সুমাইয়ার বাসায় আসলে যা মজা হয়।

রোযাদারের দুআ কবুল হয়, তাই সুমাইয়া দুআ করতে থাকে। খুব মায়াবী লাগে তখন ওর মুখটা। আযান হতেই সবার সাথে সাথে রুমকি আর সুমাইয়া খেজুর তুলে নেয়। রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) খেজুর দিয়ে রোযা ভাংতেন তাই লোভনীয় শরবতটা ছেড়ে খেজুরই মুখে দেয় সুমাইয়া। আজ ওর প্রথম রোযা। আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় সুমাইয়া রোযা রাখতে পেরেছে তেমন কষ্ট ছাড়াই। আলহামদুলিল্লাহ।

সুমাইয়া আজ সিয়াম রেখেছে
উম্মে লিলি

(১৮/০৫/১৯)