সীমানার গন্ডী ছাড়িয়ে

নিচের লেখাটা লিখেছিলাম ২০১৫ সালের রমাদানে। তখন আমি নিউযিল্যান্ডের ডানেডিন শহরে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ছোট একটা শহর ছিল ওটা। তাই বিভিন্ন দেশের মানুষ এসে জড়ো হয় সেখানে। কোন জাতিই সেখানে আধিপত্য করে না আবার ছোট কম্যুনিটি হওয়ার কারণে সবাই বেশ আন্তরিক। নিজ দেশের সীমানার বাইরে বিভিন্ন জাতি ও ভাষার মানুষের সাথে একসাথে প্রথম রামাদান কাটানোর অনুভূতি খুব সুন্দর ছিল। আল্লাহর এই পৃথিবী অনেক বিশাল, অনেক বৈচিত্রময়। জীবনে প্রথমবারের মতো অনুভব করেছিলাম আমি বৃহত্তর মুসলিম সমাজের একজন। এই অনুভূতি নিঃসন্দেহে মনকে অনেক বড় করে।

………………………………………………

দেখতে দেখতে রামাদানের বিশ দিন পার হয়ে গেল। খুব অন্যরকম একটা জায়গায় এবার রামাদান কাটাচ্ছি। প্রতিদিনই ইফতারে নানা দেশের মুসলিমরা মসজিদে এসে জড়ো হয়। খেজুর আর পানি দিয়ে ইফতার করে মাগরিব পড়ে ফেলা হয়। এরপর খাবার দেয়া হয়। একেক দেশের মুসলিমরা একেক দিন রান্নার দায়িত্ব নেয়। মালয়শিয়ানদের রান্না মজা লেগেছে।

সুদানী আর সোমালিয়ানদের রান্না অনেকটা বাঙালীদের মতো। অনেকে ঘর থেকে কিছু একটা নাশতা বানিয়ে আনে। খাওয়ার পর ডেজার্ট হিসাবে থাকে সেটা। কেউ ইফতারেই ঘর থেকে আনা অল্প কিছু নাশতা চারপাশের মানুষকে দিয়ে খায়। এক ঘন্টা পর ঈশা আর তারাবী পড়া হয়। সৌদি থেকে একজন হাফিয এসেছেন, উনিই তারাবী পড়ান। বাচ্চারাও বেশ মজা পায়, পেছনে খেলতে পারে। সারাদিন শেষে মসজিদে গিয়ে পরিচিত মুখগুলো দেখলে খুব ভালো লাগে। সানডে স্কুলের টিচারদের সাথে দেখা হলে আরও ভালো লাগে।

মালয়শিয়ান সিস্টার নুরুল সানডে স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল। উনার সাথে কথা বলতে বেশ ভালো লাগে। কথায় কথায় জানতে পারলাম এই দেশে উনার আরও কয়েক বছর থাকার ইচ্ছা। এখানে থাকার পেছনে উনার একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে দাওয়াহ করা এবং উনি রীতিমত প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন এ ব্যপারে। উনার দেশে এক ভদ্রলোক খ্রিষ্টান থেকে মুসলিম হয়েছে। সেই ভদ্রলোক এখন মুসলিমদের খ্রিষ্ট ধর্মের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানাচ্ছেন যেন মুসলিমরা খ্রিষ্টানদের প্রশ্নের যুতসই উত্তর দিতে পারে। সিস্টার নুরুল উনার কাছে ক্লাস করে এসেছেন কারণ কয়েক বছর আগে এই দেশে এসে উনি খ্রিষ্টানদের প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে দিতে পারতেন না। মালয়শিয়ান অন্য মেয়েদের মাঝেও ইসলাম প্রচারের একটা তাগিদ দেখা যায়। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ছোট একটা কাগজে কোন হাদিস বা ইসলামী কোট লিখে সবার মাঝে বিলি করে।

একদিন খাবার পর আফগানী আন্টি যারঘুনা সবাইকে জানালেন যে আগের দিন একজন খ্রিষ্টান মেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে, সবাই যেন তাকে স্বাগত জানায়। মেয়েটা ইউরোপিয়ান। এক বন্ধু ওকে ইসলাম সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা দিয়েছিল তারপর ও নিজেই আরও পড়াশোনা করেছে এই নিয়ে। কুরআন অর্ধেক পড়েছে। সালাত সম্পর্কেও জানে। গত বছরও কয়েকটা রোজা রেখেছে। পড়াশোনা করে ওর মনে হয়েছে “Islam makes sense.” মেয়েটা চেষ্টা করছে রামাদানে প্রায়দিনই মসজিদে আসতে। একদিন ঘর থেকে কিছু ইফতারও নিয়ে এসেছিল। এরপর একদিন দেখলাম অন্য স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে খাবার পরিবেশনও করছে। সালাতে পরার জন্য একটা বোরকাও জোগাড় করে ফেলেছে। এসে ওজু করে সুন্দর করে বোরকা আর স্কার্ফ পড়ে ফেলে। মসজিদে অনেককেই এখন ও চেনে। পরিচিতদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে।

এখানে অমুসলিমদেরও ইফতারে দাওয়াত দেয়া হয়। আফগানী আন্টি ফাওজিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ব্যপারে। উনি বললেন কয়েক বছর আগে এমন একটা মেয়েকে দাওয়াত করা হয়েছিল। সে রামাদানের কয়েক মাস পর ইসলাম গ্রহণ করে। নিজের গল্প বলতে গিয়ে সে বলেছিল মসজিদে এসে সবার মাঝে আন্তরিক সম্পর্ক দেখে ওর খুব ভালো লেগেছিল।
একদিন একটা কিউই টিনএজ মেয়েকে দেখে অন্যদের জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর সম্পর্কে। অন্যরা আমাকে ওর কিউই মুসলিম মাকে দেখাল। মেয়েটার বাবা কিউই। বাবা-মার ছাড়াছাড়ির পর মা একটা মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করেছে, নিজেও মুসলিম হয়েছে। মেয়েটা হয়েছে কিনা জানি না তবে মসজিদে ও বেশ স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়ায়।

গতকাল ইমাম সাহেবের স্ত্রী রান্না করেছেন। উনার ছোট ছেলেদের স্কুলের শিক্ষিকাদের দাওয়াত করা হয়েছিল। এরা সবাই কিউই। আগের বছরও তারা এসেছিল এমনই দাওয়াতে। বলল যে মসজিদে আসতে ওদের ভালোই লাগে, এখানের মানুষগুলো বেশ আন্তরিক। ওরাও খুব সহজ ছিল আলাপচারিতায়। মালয়শিয়ান মেয়েরা যখন ছোট কাগজে হাদিস বিলি করছিল তখন তারাও আগ্রহ করে নিল। হাদিসের অর্থও আগ্রহ ভরে বুঝে নিল।

একদিন এক ভারতীয় পরিবার ইফতারের দায়িত্ব নিয়েছিল। তারা অন্য শহরে থাকে এবং সেখানে কোন মসজিদ নেই। তাই এখানে এসেছে। তবে ওই শহরেই নিজেদের বাসার গ্যারেজে সালাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে মুসলিমদের জন্য। ঠাণ্ডা যেন না লাগে তাই গ্যারেজে হিটারও বসিয়েছে।

সপ্তাহে এক-দুইদিন সেখানে ইফতারের আয়োজন করে। এখানে মুসলিমরা কিভাবে সাওয়াব অর্জন করা যায় যেন সে চেষ্টা করে!

মসজিদ কেন্দ্রিক একটা মুসলিম সমাজ যে কত্ত সুন্দর হয় সেটা এখানে না আসলে আমি বুঝতামই না। কিউই একজন শিক্ষিকা জিজ্ঞেস করেছিল এখানে একইসাথে কয়টা ভাষায় কথা বলা হয়? বলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আরবী, মালয়, উর্দু, বাংলা, পশতু, ইংরেজীসহ আরও অনেক ভাষা চলে এখানে তারপরও আমরা জানি আমরা একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ভাষা, চেহারা, গায়ের রঙ ছাড়িয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এক আল্লাহকে আমরা যারা সিজদা করি তারা সবাই এক বৃহত্তর মুসলিম পরিবারের সদস্য।

সীমানার গন্ডী ছাড়িয়ে
রাবেয়া রওশীন

(২১/০৫/১৯)