রাইয়ান দরজা

থরথর করে কেপে উঠলো আনিতা। ঘুম ভেঙে গেলো তার। বাঁশির আওয়াজ পাচ্ছে সে। বুঝলো, এই আওয়াজেই ঘুম ভেঙেছে তার। ওঠার সময় হয়েছে। গায়ের কাদামাটি ঝেড়ে মাটি ভেদ করে উঠে দাঁড়ালো সে। ঠিক যেমন চারাগাছগুলো মাটি ভেদ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, সেরকম।

আশেপাশে তাকানোর সময় নেই তার। তাকালে দেখতে পেতো তারমতোই সবাই মাটি ভেদ করে উঠে দাঁড়াচ্ছে।

সবাই এক জায়গায় গিয়ে জড়ো হচ্ছে। সূর্যটা কিভাবে যেনো সবার মাথার একহাত উপরে চলে এসেছে। সূর্যের আলোর তাপে অনেকের মগজ গলে বের হয়ে যাচ্ছে। অনেকের গায়ের থেকে ঘাম বের হচ্ছে। নিজের ঘামের পানিতে নিজেই ডুবে যাচ্ছে। ঘামের গন্ধে নিজেরাই টিকতে পারছে না। বেশীরভাগ মানুষেরই নীল চোখ। দিশেহারা সবাই। বিকৃত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকেই। আনিতার সেদিকে নজর নেই। হিসাব দিতে হবে তার। পরিচিত কয়েকজন আসলো তার কাছে সাহায্য চাইতে। এড়িয়ে গেলো সে।

খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না তার। উপরে মেঘেরা জমা হয়ে আছে, তার উপর এক্সট্রা ছায়াও পাচ্ছে সে। একটা হালকা আরামদায়ক ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব পাচ্ছে সেই ছায়া থেকে। তার সাথে আরো অনেকেই আছে। আনিতা জানে না তখনো, সেটা আসলে আল্লাহ্‌’র আরশের ছায়া। প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন সে। যত দ্রুত এই জায়গা থেকে পার পাওয়া যায়, ততই ভালো। সে ভালো করেই জানে এটা পৃথিবী নয়। অনেক অনেক বছর আগে পৃথিবীতে ছিল সে। পৃথিবীর হিসাব অনুযায়ী পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান এখনকার সময়ের একদিন। এই অবস্থায় কতদিন থাকতে হবে সে জানে না। মাথায় একটাই চিন্তা, দ্রুত হিসাব দিয়ে বের হয়ে আসতে হবে তাকে। হিসাব না দিয়ে এই জায়গা থেকে চলে যেতে পারলে আরো খুশি হবে সে। সবাই তাই চাচ্ছে। কিন্তু সবার পক্ষে সেটা সম্ভব না। সারাজীবনের ছোট বড় সব কাজের হিসাব।উফ!! কি ভয়ানক পরিস্থিতি!!

খুব তাড়াতাড়ি ডাক চলে আসলো তার। বুঝতে পারেনি সে, এত তাড়াতাড়ি ডাক চলে আসবে। তার সাথে আরো দু’জন, তার হয়ে সুপারিশ করছে। এর আগে অবশ্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করে দিলেন। আমলনামা অর্থাৎ দুনিয়ার কাজের ফিরিস্তি দেখানো হলো আনিতাকে।

আহ! কি আশ্চর্য!! পৃথিবীতে যা করেছে, ছোট বড়, খুঁটিনাটি কিছুই দেখি বাদ নেই এই আমলনামায়। একেবারে অডিও ভিডিও সহ। জিজ্ঞেস করা হলো, “করেছিলে এসব কাজ?” একদম অস্বীকার করার উপায় নেই আজ। স্বীকার করে নিল সে। ভয়ে মরে যাবার দশা। কিন্তু মরতেও তো পারবে না এখানে। এখানে মৃত্যু নেই। “কেনো করেছিলে?” – এই কথা আর জিজ্ঞেস করা হলো না তাকে। জিজ্ঞেস করলেই হিসেব দেওয়া লাগতো। কোনো এক অজানা কারণে সদয় দৃষ্টি আছে তার উপর।

নিজের আমলনামায় কিছু কিছু জায়গায় চোখ আটকে গেলো আনিতার। পৃথিবীতে থাকতে প্রথম রোজা রাখার দিনটি দেখছে সে। মাত্র পাচ বছর বয়স ছিল তখন। রোজা রেখে বন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতে আচার খেয়ে মুখ মুছে ঘরে ঢুকছিল সে। বকা খাওয়ার ভয়ে কাউকে কোনোদিন বলেনি সে কথা। মামার ড্রয়ার থেকে স্ট্যাম্প চুরি করছিল একদিন সেটাও দেখলো। ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন।

এমন সব ঘটনা দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখে, একদিন খুব কাঁদছিল সে সেজদায় গিয়ে। ক্ষিদে সহ্য করতে পারতো না সে পৃথিবীতে। সব ইবাদত আগ্রহ ভরে করলেও রোজা রাখতে কষ্ট হতো তার। বিভিন্ন উসিলা দিয়ে কত রোজা রাখেনি সে। বিয়ের পর মা হবে, বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে, মেয়েলি সমস্যা, এমন সব ফালতু কারণ দেখিয়ে রোজা রাখেনি সে। একদিন রোজা নিয়ে এক আর্টিকেল পড়তে গিয়ে নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হলো সে। সেজদায় গিয়ে আল্লাহ্‌’র কাছে মাফ চাইলো আর তওবা করলো।

আমলনামায় সেই ঘটনাটা দেখে মন আশার দোলায় দুলে উঠলো তার। আহা! আজকে যদি সেই উসিলায় পার পেয়ে যায় শাস্তির হাত থেকে। কারণ সেদিন সে মনস্থির করেছিল ভাংতি রোজাগুলো হিসেব করে যত দ্রুত সম্ভব সব রেখে ফেলবে। আর কোনোদিন ফরজ রোজা মিস করবে না। এরপর সপ্তাহে সোমবার আর বৃহস্পতিবার, চাঁদের ১৩,১৪,১৫ তারিখে, আশুরার দিনে, আরাফার দিনে, শাওয়াল মাসের ছয়দিন সহ যখনি যেভাবে সম্ভব রোজা রাখবে সে, যত কষ্টই হোক তার। সমস্ত ভাংতি রোজা শেষে চেষ্টা করেছিল দাউদ আলাইহে ওয়া সাল্লামের মত একদিন পরপর রোজা রাখতে। সবসময় সম্ভব হয়নি সেটা। ভাগ্যিস পৃথিবীতেই অনুতপ্ত হয়ে ভুল শুধুরে নিয়েছিল সে। না হলে আজকের দিনে অনুতপ্ত হতে হতো শুধু। আজ শুধরানোর সুযোগ নেই।

পৃথিবীতে মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আনিতার, আল্লাহ তাকে নিজ হাতে এর প্রতিদান দিবেন, সাথে সমস্ত গুনাহ মাফও করে দিবেন। কারণ যে প্রতিদান পাওয়ার আশায় রোজা রাখে, তাকে আল্লাহ্‌ নিজ হাতে স্পেশাল উপহার তো দিবেনই, সাথে আগের সব গুনাহ মাফও করে দিবেন। সে যে এটা বিশ্বাস করেছিল, সেটাও আমলনামায় দেখতে পেলো।

সত্যি তাই করা হলো আজ তার সাথে। সমস্ত গুনাহ মাফ করে ডান হাতে আমলনামা দেওয়া হলো আনিতাকে। আনিতা মহাখুশী। সে চূড়ান্ত সফলতা লাভ করেছে। যদিও তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তার সফলতার কথা বলে সান্তনা দেওয়া হয়েছিল। এরপর দ্রুত সব ঘটনা ঘটে গেলো। হাউজে কাওসার থেকে পানি পান করে পুলসিরাত পার হয়ে গেলো খুব সহজেই।

তার পাশে দু’জন সংগী তাকে আলো দিয়ে ঘিরে রেখেছিল সারাক্ষণ। সেই আলোতেই আনিতা খুব সহজেই অন্ধকার পথ পার হয়ে এসেছে। অনেকেই তার কাছ থেকে আলো চেয়েছিল। এটাতো পৃথিবী না, এখানে নিজের আলো দিয়েই নিজেকে চলতে হবে।

পৃথিবীতে দুটো কাছের বন্ধু ছিল আনিতার- কুরআন আর রোযা। তারাই তাকে সংগী হিসাবে রাইয়ান দরজার সামনে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছিল। রাইয়ান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলো আনিতা। কি সুন্দর মিষ্টি সম্মোহনী সুগন্ধি আসছে এর ভিতর থেকে। অনেকক্ষণ থেকে এই সুগন্ধিটা আনিতার নাকে আসছিল। এতক্ষনে বুঝতে পারলো এর উৎস কোথায় ছিল। তাকে সালাম জানিয়ে স্বাগত জানানো হচ্ছে। সে অবাক নয়নে স্থির তাকিয়ে আছে এই দরজার দিকে।

আরো অনেক দরজার থেকে তাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে, কিন্তু সে এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এই দরজা দিয়েই ঢুকবে অনন্তকালের জন্য শান্তির আবাসভূমিতে। যেখানে রোজাদার বান্দাদেরকে আল্লাহ্‌ নিজ হাতে স্পেশাল উপহার দিবেন। এত সৌন্দর্য, এত সুখ, এত শান্তি, এত সম্পদ, এত খাবারদাবার এখানে আছে, কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই, অযথা কথাবার্তা নেই, হিংসা বিদ্বেষ নেই এখানে, এর থেকে আর কি স্পেশাল উপহার থাকতে পারে!! সে কথা চিন্তা করতে করতেই রাইয়ান দরজার দিকে ডান পা বাড়ালো আনিতা।

রাইয়ান দরজা
তাহনিয়া ইসলাম খান

(১৯/৫/১৯)