১.
লাবিবা ওর লিস্ট টা আরেকবার চেক করলো সব ঠিক আছে কিনা।
“সালাতের পরের দুয়া,চেক! সূরা মূল্ক মুখস্থ, চেক! জিকির, চেক! কুরআন তেলাওয়াত, চেক!” নিজের মনেই বলতে বলতে লিস্টের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছে লাবিবা। এরপর কিছুক্ষণ এক মনে চিন্তা করে দেখলো আর কিছু এ্যাড করা যায় কিনা।
”দুয়া মাফ, ভালো রেজাল্ট, দ্বীনি হাসবেন্ড, বাবা মায়ের জন্য দুয়া,বান্ধবীর জন্য দুয়া,ফেসবুকের অমুক আপুর বাচ্চাদেএ জন্য দুয়া……সব ঠিক আছে আলহামদুলিল্লাহ!“
আবারও লাবিবা নিজেকেই নিজে বলে উঠলো।
“এখনো রমাদানের এক মাস আছে।এর মধ্যে লাগলে আরও কিছু এ্যাড করা যাবে ইন শা আল্লাহ।“
নিজের লিস্ট দেখে নিজেই খুব খুশি লাবিবা।এবারের রমাদানটা সে কোন ভাবেই হেলায় ফেলায় কাটতে দিবেনা ঠিক করে রেখেছে।এক মাস আগে থেকেই কখন কি করবে সব কিছুর একটি বিশাল লিস্ট বানিয়ে রেখেছে। রোজ একবার করে লিস্ট চেক করে কিছু বাদ গেলো না তো বা কিছু এ্যাড করা যায় কিনা।
২.
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল।রমাদানের একদিন আগে রাতে লামিয়ার প্রচন্ড জ্বর উঠলো। ১০৪ ডিগ্রি প্রায় জ্বর। মা এসে মাথায় পানি দিয়ে লাবিবাকে ঘুম পারিয়ে দিয়ে গেল। সারারাত ছাড়া ছাড়া ভাবে লাবিবার ঘুম হলো। একদিন পরে রমাদান,এর আগে এতো অসুস্থ হলে আমলগুলো করবে কিভাবে। বিছানা থেকেই উঠতে পারছেনা,ফরজ নামাজই বা পড়বে কিভাবে? টেনশনে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখতে লাগলো সারারাত।
পরের দিনও অবস্থার কোন উন্নতি নাই। বরং সকাল থেকে লাবিবার চোখ একদম হলুদ হয়ে আছে। এত দূর্বল হয়ে গেছে যে বিছানা থেকে মাথা উঠালেও মাথা ঘুরিয়ে উঠে। লাবিবার দু চোখ ভেঙে পানি পরতে লাগলো। এত প্ল্যান, এত প্রস্তুতি, কিছুই কি করতে পারবেনা? লাবিবার অবস্থা দেখে সেদিন বিকালেই ওর বাবা মা ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
৩.
আজ প্রথম রমাদান,লাবিবা রোজা রাখতে পারেনি।এতো অসুস্থ অবস্থায় ওকে ওর বাবা মা রোজা রাখতে দেয়নি। আল্লাহ তো রুগীদের জন্য সহজ করেছেন।
লাবিবা নিজেও জানে রোজা ও রাখতে পারবেনা।এমনিতেই দুইদিন ধরে কিছুই খেতে পারেনা,বিছানা থেকে উঠতে পারেনা দুর্বলতার জন্য,তার উপর পানি না খেতে পারলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। তবুও লাবিবা রোজা রাখার জন্য জোর করেছিলো। কিন্তু বাবা মাকে কোন ভাবেই রাজি করাতে পারেনি।
লাবিবার জন্ডিস ধরা পরেছে। বিলুরুবিন অনেক হাই।এখন ওর জন্য রেস্ট নেওয়া খুব দরকার। লাবিবা সারাদিন শুয়ে থাকলেও মানসিক শান্তি পাচ্ছেনা।রমাদান চলে যাচ্ছে,কুর’আন দূরে থাক কোন ইসলামিক বই পড়তে পারছেনা, নামাজ শুয়ে শুয়ে পড়তে হচ্ছে, মোবাইলটাও নষ্ট হয়ে আছে, নয়ত অন্তত মোবাইলে লেকচার শুনতে পারতো। রমাদানে ইবাদতের সময় নষ্ট হবে মোবাইল থাকলে তাই নিজেই ইচ্ছা করে মোবাইলটা ঠিক করায়নি। এখন তো আর যেতেও পারবেনা মোবাইল ঠিক করাতে।
সারাদিন শুয়ে শুয়ে লাবিবা কাঁদতে লাগলো। জিকির করা ছাড়া আর কিছুই করার নাই ওর। সেই জিকিরও মন দিয়ে করতে পারছেনা। গুনতে ভুল হচ্ছে, মুখে ঠিকই আওড়াচ্ছে কিন্তু মন কোথায় কোথায় যে চলে যায়! জিকির করেও মনে শান্তি পাচ্ছেনা।
৫.
রমাদানের প্রায় ১০ দিন চলে গেছে। লাবিবার অবস্থার কোন উন্নতি নাই। বরং দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে।ডাক্তার সহ সবার এক কথা রেস্ট নিলেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু কি তে কি। মানসিক শান্তি তো আসছেনা।লাবিবা সারাদিন শুধু কাঁদে। ওর ভার্সিটির বান্ধবীরা এসেও সান্তনা দিয়ে গেল। কোন লাভই হলো না
১০ দিনের দিন সকালে উঠে লাবিবা অনেক কষ্টে বসে বসে সালাত পড়লো। এরপর আল্লাহর কাছে কাঁদতে লাগলো নিজের অবস্থার কথা বলে। দুয়া শেষে বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগলো লাবিবা, “আমি কি কোন গুনাহ করেছি যার কারণে আল্লাহ আমাকে রমাদানের বরকত লাভ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন??”
লাবিবা নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে লাগলো,ওর ভার্সিটির কথা,বান্ধবীদেএ সাথে কাটানো সময়ের কথা, বাবা মায়ের সাথে কাটানো সময়, বাবা মাকে বলা ছোট ছোট মিথ্যা কথা সব নিয়ে ভাবতে লাগলো।নিজের জীবনটাকে আয়নার মত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলো লাবিবা।
হটাৎ করেই লাবিবা একটা কথা চিন্তা করে ধাক্কা খেল। ওর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে পড়া লেখা, বান্ধবী, মোবাইল, মুভি ইত্যাদি নিয়ে। ওর দৈনন্দিন জীবনে নামাজ ছাড়া আমলের সংখ্যা খুবই কম।
রমাদানের জন্য যে দৈনিক আমলের বিশাল লিস্ট ও বানিয়েছিল আর মধ্যে ফরজ নামাজ ছাড়া ও বলতে গেলে আর কিছুই করেনি সারাদিনে। জীবনের কতটা সময় ও হেলায় ফেলায় কাটিয়ে এসেছে ভেবে নিজেরই লজ্জা করতে লাগলো।
“আমি তো বছরেএ বাকি ১১ মাসে তেমন কোন আমলই করি নাই।“ নিজের মনে ভাবতে লাগলো লাবিবা, “ সব রেখে দিয়েছিলাম এই একটা মাসের জন্য। আল্লাহ চাইলে আমার জন্ডিস না হয়ে কোন এক্সিডেন্ট হয়ে মারাও তো যেতে পারতাম। তখন কি আমলের লিস্ট নিয়ে আল্লাহর সামনে দাড়াতাম!।কত মানুষ গত রমাদানে জীবিত ছিল কিন্তু এই রমাদানে তারা কবরে শুয়ে আছে। “ ভাবতে ভাবতে লাবিবার চোখে পানি চলে আসলো।ও উঠে শুকরানা সিজদা দিয়ে আল্লাহর কাছে কাঁদতে লাগলো যে আল্লাহ ওকে যে উপলব্ধি করিয়েছেন তা যেন ও সব সময় মনে রাখতে পারে।
সেদিন অনেকদিন পর লাবিবা ভালো মনে ঘুমাতে পারলো।কারণ ও এখন জানে রমাদানে হয়তো নেক আমল করার জন্য ও অনেক বেশি রিওয়ার্ড পেত আল্লাহর কাছে, কিন্তু আল্লাহ তো মানুষের নিয়ত দেখেন।হয়তো আমল না করেও শুধুমাত্র ইচ্ছা ছিল বলে ও রিওয়ার্ড পেয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। কিন্তু সেটা কথা না,কথা হলো আল্লাহ ওকে এখনো সময় দিয়েছেন নিজের আমলের খাতা ভরে ফেলার জন্য।রমাদান চলে গেলেও সুস্থ হলে ও সারা বছর এভাবে লিস্ট করে আমল করবে ইন শা আল্লাহ।
রমাদান লিস্ট
নাইলাহ আমাতুল্লাহ
জুন ০৪, ২০১৯ইং