রাতের আকাশের দিকে তাকাতেই চোখ পড়লো চাঁদটার উপর। চাঁদ আবার পূর্ণরূপ ধারন করেছে। তার মানে রমাদান অর্ধেক শেষ প্রায়..!
বুকটা ধ্বক করে উঠলো। রমাদান নিয়ে এত কিছু ভেবেছি, এত প্ল্যান করেছি ; কিন্তু কতটুকু করছি..? কতটুকুই বা পেরেছি..?
মনটা কেমন যেন হাহাকারে ভরে উঠলো। কোন রমাদান- ই একভাবে যায়না। একেক রমাদানে যেন একেক পরীক্ষা আসে। মন মতো ইবাদত করতে না পারার অতৃপ্তিতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। জীবনের প্রতিটি মূল্যবান মূহুর্ত চলে যাচ্ছে।
তারচেয়ে ও মহামূল্যবান সময় এ পবিত্র রমাদান। ইবনুল জাওযী বলেছিলেন,
“কোন কবরবাসীকে যদি বলা হয়, তুমি দুনিয়ার কি চাও? – আল্লাহর শপথ সে বলবে, রমাদানের একটি দিন।”
আর আমরা জীবিত থেকে কতটা সদ্ব্যবহার করেছি সেই মহামূল্যবান সময়ের..?
যার কোন সময় অপচয় করবো না চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু নেক আমলের ঝুড়ি কতটুকু ভর্তি করতে পারলাম..?
আসলে মনে হয় অনেকেরই মন খারাপ হয়। বিশেষ করে যারা কোন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। যারা হয়তো কিছুটা অসুস্থ বা কোন বিশেষ কাজে বেশি ব্যস্ত। কেউবা প্রেগন্যান্ট বা ছোট্ট বাবুটির মা হয়েছেন। সবারই হয়তো ইচ্ছে ছিল বা ইচ্ছে করে অনেক ইবাদত করতে ; কিন্তু করা হয়ে ওঠে না। মনটা কিন্তু ঠিক ই হাহাকার করে।
অনেক বোনের কথাই জেনেছি গত রমাদানে অনেক প্ল্যান করে ইবাদত করেছে এই রমাদানে কিছুই হয়নি। আবার অনেকে গত রমাদানে ইবাদতের সুযোগ যতটা পায়নি এ রমাদানে কিছুটা পেয়েছে।
আসলে একেকজনের সিচ্যুয়েশন একেকরকম। তবে আলহামদুলিল্লাহ্ আমরা তো এই রমাদান পেয়েছি। হতেও তো পারতাম কবরবাসীর মতো যে হয়তো আফসোস করছে। বা সেটা ও জানি না আগামী রমাদানে এ দুনিয়ায় থাকবো কি না..!
তো যাই হোক যারা বেশি ইবাদত করতে পারছেন আলহামদুলিল্লাহ্। আর যেসব ভাই, বোন কম ইবাদত করতে পারা নিয়ে মনোঃকষ্টে আছেন তাদের জন্য আমার এ লেখা। যদি ও আমি রমাদান চ্যালেঞ্জে করণীয়- বর্জনীয় প্রসঙ্গে অনেক ইবাদতের কথা লিখেছি; সেগুলোর সবকটি যে একজন করবেন বা পারবেন তা না ও হতে পারে। কিন্তু এটা তো হতে পারে আমরা আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ, কম কিছু বেছে নিতে পারি; যার জন্য যেটা সহজ।
করণীয় গুলি না করতে পারি অন্ততঃ বর্জনীয় গুলো থেকে যদি বেঁচে থাকি সেটা ও কিন্তু উত্তম ইবাদত হতে পারে। কারণ দয়ালু আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কিন্তু সহজতাকে পছন্দ করেন। তিনি আমাদের উপর কখনোই সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু চাপিয়ে দেন না।
🔲 যারা ঘরের বা বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকেন তারা অন্য কোন আমল করতে পারি আর না পারি আমরা ফরয ইবাদত গুলি যেন সঠিক ভাবে করার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। কারণ ফরয গুলি করতে আমরা বাধ্য। যেমন সিয়াম রেখে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সহীহ ওয়াক্তে পড়ার চেষ্টা করতে পারি। বোনেরা অবশ্যই তখন কাজের চেয়ে সালাতকে প্রায়োরিটি দেবেন। আর ভাইয়েরা অবশ্যই চেষ্টা করবেন মসজিদে জামাতের সাথে সালাত আদায় করতে।
🔲 আর রমাদানে যেহেতু একেকটি আমলে সত্তর গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায় তাই যেকোন ছোটখাটো কষ্টহীন আমল করতে পারি। বোনেরা রান্না করতে করতে বা ঘরের অন্যান্য কাজ করতে করতে কুরআন তিলাওয়াত বা কোন লেকচার শুনতে পারেন। অথবা ঐ সময়গুলোতে যিকির দ্বারা জিহ্বা কে ব্যস্ত রাখতে পারেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলা পবিত্র কুরআনে যিকির করার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
এতে হৃদয় ও সতেজ হবে ইন শা আল্লাহ্। যিকির কিন্তু অন্তর ও শরীরে শক্তি যোগায়। যিকিরকারীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় এবং ফেরেশতারা তার জন্য দুআ করে। তাই উঠতে বসতে, হাঁটতে সবসময়-ই যিকির করুন। এমনকি ফেসবুক স্ক্রল করার মাঝে মাঝে ও যিকির করে নিতে পারেন।
আর এটাই হল পূর্ণ সফলতা ও কামিয়াবি। যারা রাস্তায় জ্যামে বসে থাকেন তখন বিরক্ত, রাগ হয়ে ও যেহেতু কোন লাভ নেই। তারচেয়ে বরং সে সময়টা ইয়ার ফোন দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পারেন বা যিকিরে ব্যস্ত থাকতে পারেন।
অনেকে জিজ্ঞেস করেন কি যিকির করবো..? তাদের জন্য বলতে পারি ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ সর্বোত্তম দুআ। ‘সুবহান আল্লাহ্’ এক হাজার সওয়াব লেখার দুআ। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ সর্বোত্তম যিকির। ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লাহিল আযীম’ মীযানের পাল্লা সবচেয়ে ভারী করবে ইনশাআল্লাহ্।
🔲 রমাদান মাস কুরআনের মাস। প্রতিদিন অন্ততঃ একটি ছোট সূরা বা কিছু আয়াত হলে ও পড়ার চেষ্টা করুন। তা ও যদি সম্ভব না হয় তাহলে আন্তরিক ভাবে নিবিড় মনোযোগে তিনবার সূরা ইখলাস পড়বেন। এক খতম কুরআন তিলাওয়াতের সওয়াব পাবেন ইনশাআল্লাহ্। আবার কখনো দশবার সূরা ইখলাস পড়বেন। এতে জান্নাতে একটি ঘর তৈরি হবে আপনার জন্য। সুবহানআল্লাহ্..! এগুলোতে সময় কিন্তু বেশি লাগে না। কয়েক মিনিট মাত্র।
🔲 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ্ পালনের জন্য আল- কুরআনে নির্দেশ আছে।
আমাদের প্রতিদিনের প্রায় প্রতিটি কাজে অনেক সুন্নাহ্ আছে, যা পালন করার কথা হয়তো আমরা খেয়ালই করি না। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “যে আমার সুন্নাতকে ভালবাসে, সে আমাকে ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে সে জান্নাতে আমার সাথে থাকবে।”
এই সুন্নাত পালন করা কিন্তু কঠিন কোন কাজ নয় । অথচ এ সহজ সুন্নাহ্গুলি একটু খেয়াল করে পালনের মাধ্যমেই কিন্তু আমরা দয়ালু আল্লাহ্ ও আমাদের প্রিয় রাসূল (সাঃ) এর প্রিয়পাত্র হতে পারি।
🔲 রমাদান দুআ কবুলের শ্রেষ্ঠ মাস। তাই রমাদানে বেশি বেশি দুআ করবেন। সবসময়- ই দুআ করতে চেষ্টা করুন। কখন কার দুআ দয়ালু আল্লাহ্ কবুল করবেন তা আমরা কেউ জানি না। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলা তো বলেছেন ই “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো।”
[আল-মু’মিন-৬০]
“দু’আগুলো তো অস্ত্রের মত। অস্ত্র কেবল ধারের উপর নির্ভর করে না, চালনাকারীর উপরও নির্ভর করে। তাই একাগ্র চিত্তে আল্লাহর কাছে দুআ করুন। কোন কিছু চাওয়ার থাকলে চাইতে থাকুন, চাইতে থাকুন। আল্লাহ্ একভাবে না হয় একভাবে জবাব দেবেন-ই।
তবে কোন উদাসীন অন্তরের দুআ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কবুল করেন না। আবু দারদা আল আনসারী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
”কোন দরজায় যখন কেউ কড়া নাড়ে, তখন দরজাটি তার জন্য খুলে যাওয়ার খুব কাছে থাকে। যে ব্যক্তি অনেক দু’আ করতে থাকে তখন তার দু’আ কবুল হবার দ্বারপ্রান্তে থাকে।”
[আশ-শু’আব, ২/১১৪২]
দুআ হচ্ছে ইবাদত। তাই আমরা আমাদের নিজেদের জন্য, মা- বাবার জন্য, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু – বান্ধব, সমগ্র মুসলিমদের জন্য বিশেষ করে নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য বেশি করে দুআ করতে পারি।
🔲 রমাদান মাস ক্ষমার মাস। তাই যত বেশি পারেন ততো বেশি তাওবা, ইস্তেগফার করবেন।
আপনি সকাল শুরু করতে পারেন ইস্তেগফার দিয়ে। ইস্তেগফারের অনেক ফযিলতের কথা আগে লিখেছি। কিন্তু আবার ও লিখছি ইস্তেগফার সাবানের মতো। আপনার গুনাহ্গুলোকে ধুয়ে মুছে নেবে ইনশাআল্লাহ্।
শায়খ আবদুল আযীয আত-তারিফী বলেন, ইস্তেগফার করতে করতে দিন শুরু করা সে দিনের এক বরকত। কারণ তা মুছে দেয় রাতে সঙ্গী করে ঘুমানো সব গুনাহ, সাহায্য করে রিযিক খুঁজে পেতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর কাছে একশতবার ইস্তেগফার না করে আমি কোন সকাল পার করি নি।” সুবহান আল্লাহ্..!
ইস্তেগফার সবসময়-ই করা যায়। তবে ফযরের আগের ইস্তেগফার আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয়। তাই ফযরের আগে বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়ার চেষ্টা করুন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা চাইলে তখন আপনাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।
যিকিরের সময় তাই ইস্তেগফার অর্থাৎ ‘আসতাগফিরুল্লাহ্’ বেশি পড়বেন। এছাড়াও ‘আসতাগফিরুল্লাহা ওয়া আতুবু ইলাইহি’ ও পড়তে পারেন।
তাই রমাদানে আমরা বেশি ইবাদত না করতে পেরে বিষন্নতায় আক্রান্ত না হয়ে শুধুমাত্র অতিসহজ এ ইবাদত গুলোকে আমাদের হাতিয়ার বানাতে পারি। অতি আকাঙ্খিত জান্নাতের জন্য আমাদের পুঁজি বানাতে পারি।
যদি আমরা অপেক্ষাকৃত কঠিন গুলো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও না পারি ;তবে আর- রহমান তো অন্তর্যামী। তিনি সবার অন্তর দেখেন, পরিস্থিতি দেখেন, নিয়্যাত দেখেন।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “ইন্না মা’ল আ’মালু বিন্যিয়্যাতি”।
অর্থ- কর্মের ফলাফল অবশ্যই নিয়্যাতের উপর নির্ভর করে।
তাই হতে পারে অনেক ক্ষুদ্র আমলের কারণে ও আমরা সফলকাম হতে পারি। যদি আমরা শির্ক, কুফর, মুনাফেকী, গীবত সহ যাবতীয় কবীরা গুনাহ্ ও হারাম কাজ থেকে দূরে থাকতে পারি তবে সামান্য আমল ও আমাদের জান্নাতের উছিলা হতে পারে ইনশাআল্লাহ্। কারণ কোন আমল তা যতই ছোট হোক তা নিয়মিত করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়া যায়। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলা আমাদের পালন করার তৌফিক দান করুন।
রমাদানের সহজ ইবাদত
ইসমত কণক
(২২/০৫/১৯)