সৌদি আরবে রমজান মাস শুরুর আগে চারদিকে যেন একটা সাজ সাজ রব পড়ে যায়। মসজিদগুলো সাজে নতুন সাজে, পর্দা কার্পেট পরিষ্কার বা বদল করে দেয়ালগুলোতে নতুন পেইন্টিং করে একটা তরতাজা আমেজ নিয়ে আসা হয়।
রাস্তার বিলবোর্ড গুলোতে “রামাদান কারিম” বা “আহলান সাহালান ইয়া রামাদান” জাতীয় ওয়েলকাম নোট সংযোজন করা হয়। দোকানপাট আর বড় শপিং মলগুলোতে আলোকসজ্জা আর রঙিন কাগজ বা কাপড়ের বড় চাদরের ডেকোরেশন দেখে মনে হয় পুরা শহরটাই বুঝি উৎসবের সামিয়ানায় ঢেকে গেছে। পুরো বছর জুড়ে যে মহিমাময় মাসের অপেক্ষায় থেকেছে মুসলমান জাতি, তাকে বরণ করা হয় পূর্ণ আয়োজনে।
আমার জীবনে দেশে রমজান মাস পালন করেছি বড়জোর দশবার। প্রতিবারই দেখতাম রোজায় জিনিসপত্রের দাম গগন ছুঁই ছুঁই করছে। রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজে রোজার সময়ের গরম জিলাপি, পিঁয়াজু, সমুচা, বেগুনীর মত সবচেয়ে গরম খবর থাকত এইটাই…চাল, ডাল, মাছ, মাংস, বেগুণ, টমেটো, আলু, পেঁয়াজ থেকে কাঁচামরিচ পর্যন্ত সবকিছুর দরে আগুন লেগেছে!
সবচেয়ে খারাপ লাগত দিনে দুপুরে হোটেল গুলোতে পর্দা টানিয়ে মানুষজন খাওয়া দাওয়া করছে দেদারসে। অন্যসময় না হয় বাদ দিলাম, রোজার মাসেও নামাজের সময় সব দোকানপাট খোলা থাকে। শুধু পথে ঘাটে হোটেল রেস্তোরায় রকমারি ইফতার আর সংবাদ পাঠিকাদের এক মাসের জন্য মাথায় কাপড় দেয়া ছাড়া তেমন বিশেষ কোন পরিবর্তন চোখে পড়েনি।
এদেশে হয় ঠিক তার উল্টোটা। শপিং মলগগুলোতে থাকে বিশাল ছাড়। বিশেষ করে রোজার ইফতার আর সেহেরিতে যে খাবার গুলো বেশী জনপ্রিয় সেগুলোতে স্পেশাল অফার থাকে। তাদের উদ্দেশ্য হল, রোজার মাসে মানুষগুলো যেন কম খরচে ভাল খাওয়াদাওয়া করতে পারে। মূলত পরকালীন কল্যাণ আর সওয়াব অর্জনের জন্যই ব্যবসায়ীরা এমনটা করে থাকেন।
ডাক্তার আর নার্সদের ডিউটি টাইম আটঘন্টা থেকে কমিয়ে ছয় ঘন্টা করা হয় যেন তারা কিছু বেশী সময় ইবাদতে মনোনিবেশ করতে পারে। অমুসলিম দের জন্যও এসময় একঘন্টা করে ডিউটি টাইম কমিয়ে দেয়া হয় যেন তারাও মুসলমান দের অতি প্রিয় এ রমজান মাসের মহিমা উপলব্ধি করতে পারে।
খেয়াল করেছি রোজার আগে রোগীদের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেড়ে যায়, যাদের একটা গুরু অংশ কিছুটা বয়স্ক/বয়স্কা রোগী। তাদের অনেকেই আছেন যারা অবহেলা করেই বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নেননি সারাবছর কিন্তু রমজানের রোযাগুলো যেন পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারেন তাই এখন একটু ত্বরা করছেন চিকিৎসা নিতে।
প্রতিবার রোজা আসলে আমার ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। আমার মা ঘরদোর, পর্দা, জানালা,কার্পেট সব ধুয়ে পরিষ্কার করতেন। আমাদের ভেতর একটা মৌন প্রতিযোগিতা চলত কে সবটুকু তারাবীহ নামাজ পড়তে পারবে, কে পুরো কোরআন শরীফ কতবার তেলাওয়াত শেষ করবে।
বাসার সামনেই ছিল মসজিদ। মসজিদের দোতলায় মেয়েদের নামাজের আলাদা ব্যবস্থা থাকত। এখানে অবশ্য সব মসজিদেই মেয়েদের নামাজের ব্যবস্থা থাকে। আযান পড়ার সাথে সাথেই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে মায়ের সাথে চলে যেতাম তারাবীহ নামাজ পড়তে, পাড়াপড়শিদের মধ্যে আমার সমবয়সী, ছোট বড় সব একসাথে, সে যেন একটা ছোট কাফেলা যাচ্ছে তারাবীহর উদ্দেশ্যে, ইমাম সাহেবের সেই সুমধুর তেলাওয়াত আজও আমার অবচেতন মনে স্বর্গীয় শিহরণ জাগায়।
তখন স্কুলে পড়ি, বড়জোর থ্রি বা ফোরে। এভাবে প্রতিটি রোজা কেটেছে কলেজ পর্যন্ত। একটা আলাদা ভাললাগা বা শিহরণ কাজ করত ইফতার, তারাবীহ আর সেহরির ব্যাপারে। আমার আব্বা প্রতি রোজায় একাধিক ইফতার পার্টির আয়োজন করতেন।
একসাথে অনেক মানুষের ইফতারের ব্যবস্থা করা হত, কখনো শ’ দেড়শ। এত মানুষের ইফতার আর খাবারের রান্নাবান্না করতেন আমার মা আর আশপাশের প্রতিবেশি আন্টি/ চাচীরা। আমরা বাচ্চারা কাটা বাছা যোগাড় এর কাজ করে দিতাম। উফ! সে কী আনন্দ ছিল আমাদের! বাসায় মেহমানদের আগমনটা ছিল অনেক খুশীর , তাদের ইফতার/ আপ্যায়ন করা ছিল অন্যরকম আনন্দের যা শুধু মুখে বলে বা লিখে বোঝানো যাবেনা।
সেসময় দেখতাম শহরের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত এলাকা, বা যেখানে কম আয়ের মানুষজন বেশী থাকে সেখানে বড় বড় ট্রাক এসে বিলি করত দশ কেজি খেজুরের টিন, ওটস এর প্যাকেট, ক্যান্ড টমেটো পিউরি, সুগার কিউব, রুহ আফজা বা লেমোনেড এর বোতল। কেউ জানতেও পারত না এগুলোর দাতা কে বা কারা! শুধু শোনা যেত “বারাকাহ” এসেছে গাড়িতে করে !
সেই সোনালি দিনগুলো, সেই মানুষগুলো অনেকেই এখন আর নেই। পৃথিবীর বয়স বাড়ার সাথে মানুষের মানসিকতা বদলে যাচ্ছে। আগের মাটির মানুষগুলোকে আর পাইনা। চোখ বুজলেই সেই ধূলোবালি মাখা দিন, সেই আবেগ, সেই বিশুদ্ধ অনুভূতি গুলো হাতড়ে বেড়াই! তারপরও ‘রমজান আসছে’ – একথা ভাবতেই একটা প্রগাঢ় আনন্দানুভূতি জেগে উঠে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে যে আরেকবার রমজানের রোজা পালন আর ইবাদত করার সুযোগ করে দিয়েছেন এজন্য তার দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া!
——————-
প্রবাসে রামাদান
ফাতিমা খান
জুন ০৯, ২০১৮ইং