মনে পড়ে, আমার ফেসবুকের প্রথম প্রোফাইল পিকচার ছিল সাদা একটা গোলাপের ছবি। অনেক ভেবেচিন্তে সেই ছবিটা দিয়েছিলাম। নিজের ছবি কখনোই পাবলিকলি দিতাম না। আমার বোন আমার হিজাব ছাড়া একটা ছবি দিয়ে দিল। তখন ইসলাম মানার প্রথম দিকের কথা। শুধু স্কার্ফ পরতাম। নিজের ছবি দিতে মাঝে মাঝে ইচ্ছাও করত। আবার ভয়ও লাগত। জানতাম কাজটা ভালো হবে না। আস্তে আস্তে বোরকা শুরু করলাম। রঙিন টাইপ বোরকা পরতাম। নিচে টুকটাক ডিজাইনও থাকত। ঈদের সময় আশেপাশের প্রভাবে আমারও একটু ঢিল দিতে ইচ্ছা করত। একবার ঈদে আমার হাতের তালুর ছবি দিলাম। সেই প্রথমবার নিজের কোনো ছবি পাবলিক হল। বান্ধবি বলেছিল, “তুবার হাত আসছে, আস্তে আস্তে সব ই আসবে।”
ফেসবুকে এসেছি প্রায় সাত বছর হল। হাত বাদে আর কিছুই আসে নি আলহামদুলিল্লাহ। এই ক’বছরে অনেক দেখলাম। অনেক জানলাম। অনেক শিক্ষা পেলাম।
কত জন বদলে গেল। কত জন ঝরে পড়ল। কত জন আবার আমার পরে দ্বীনের বুঝ পেয়েও আমার চেয়ে বেশি এগিয়ে গেল!
এক মেয়েকে চিনতাম, পরিবারের বিপক্ষে এসে খুব কষ্ট করে দ্বীন পালনের চেষ্টা করত। বয়সে আমার চেয়েও কয়েক বছরের ছোটো হবে। ছোটো বয়সেই তার পরিণত চিন্তাগুলো দেখতে ভালো লাগত। টুক-টুক করে কত কথা বলত! খুব শখ ছিল একজন দ্বীনদার ছেলেকে বিয়ে করবে। কিন্তু পরিবার শুনল না। দ্বীনী ছেলে কেন বিয়ে করা উচিত না সেই কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলল।
কথার প্রভাব বিষের চেয়েও ভয়ংকর। তারা কিন্তু মেয়েকে কোনো প্রেসার দেয় নি। শুধু বুঝিয়েছে। এক সময় মেয়েটা গলে গেল। জাহেল বিয়ে করতে সমস্যা কী? কত ভালো চরিত্র, কত ভালো আচার-ব্যবহার! আসলে মেয়েটা নিজেই নিজেকে ধোঁকা দিল। এখন সে বদলে গেছে। তার স্বামী কিন্তু বদলায় নি! তিনি আগের মতই আছেন। এখন ওরা দুজন মিলে অ্যানিভার্সারি পার্টি করে, জন্মদিন করে, মুভি দেখে। মেয়েটা সাজগোজ করা ছবি ফেসবুকে দেয়। আমি মানুষকে ভুলতে পারি না। মাঝে মাঝে ওর প্রোফাইলে যাই। ঘুরে ঘুরে দেখি। খারাপ লাগে। কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা হয়। ওর সাথে একদিন রিকশায় ঘুরেছিলাম, মনে পড়ে যায়। ওর মুখে অনেক বড় বড় কথা শুনেছিলাম, সেগুলো গানের মত কানের মধ্যে বাজে, ভুলতে পারি না।
এরকম মানুষ আমার লিস্টে আরও অনেক আছে। আগে স্কার্ফ পরত, দ্বীনের পক্ষে সোচ্চার ছিল, কত কথা লিখত। এখন আর কিছুতেই নেই। এখন খালি সুন্দর সুন্দর পোজ দেওয়া ফ্যামিলি পিকচার শেয়ার দেওয়াই ফেসবুকে তাদের একমাত্র কাজ।
অনেক ভাইকে চিনতাম, এক সময় তাদের লেখা পড়ে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি, মনে জোর পেয়েছি। এখন তারা অনেকে দ্বীনের মাঝেও নেই। হারিয়ে গেছে। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তারা এখন গান শোনে, খেলা দেখে। মেয়েদের সাথে পাবলিকলি কথা বলে, হাসি-তামাশা করে। তাদের নজরে এগুলো আর খারাপ লাগে না।
যারা দ্বীনের বুঝ পায় নি, তাদের জন্য তবু একটা অজুহাত দাঁড় করানো যায়, “হয়ত সে জানে না”। কিন্তু যারা একবার দ্বীনের বুঝ পেয়ে ইসলাম মেনে চলল, তাদের জন্য আমি কী অজুহাত দেব? আল্লাহর এত বড় রহমত, হেদায়েতকে পেয়েও যে নিজের নফসের অনুরসণ করল, তার জন্য আমি আর কী অজুহাত দিতে পারি? এদের ভুল এদেরকে সরলপথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। গুনাহর জীবনে এরা ডুবে গেছে। সঠিক পথ জেনেও যখন কেউ ভুল পথ বেছে নেয়, তখন তার সাথে আর কী হবে?
আমার ভীষণ কষ্ট হয়। খুব অবাক লাগে ভাবতে, কীভাবে এত স্ট্রং মানুষগুলো এইভাবে বদলে যায়! এরপর লাগে একটা অবর্ণনীয় ভয়- নিজেকে নিয়ে, আমিও যদি বদলে যাই…! আল্লাহ মাফ করুক যেন তা কখনও না হয়। যেন ঈমান থেকে আর কোনোদিন কুফর কিংবা জাহেলিয়াতে ফেরত না যাই। আল্লাহ আমাদের অন্তরকে ঈমানের উপর অটল রাখুক।
“ইয়া মুক্বাল্লিবুল ক্বালব, সাব্বিত ক্বুলুবানা ‘আলা দ্বীনিক”
জীবনে চলতে গিয়ে কিছু মানুষ দূরে চলে যায়। আগে হয়ত যার সাথে রেগুলার কথা হত, এখন তার সাথে কথা বলারও কোনো সুযোগ নেই। এমন আমার জীবনে অনেকেই আছে। এই মানুষগুলো দূরে থাকুক, আর কোনোদিন কথা না হোক, তবু তারা দ্বীনের উপর থাকুক এইটাই শান্তি। হেদায়েত পেয়েও যারা দ্বীন থেকে সরে যায়, তার জন্য আফসোস ছাড়া আর কিছুই হয় না। যারা একবার দ্বীনকে বুঝেছে, যে বান্দা একবার আল্লাহর পরিচয় পেয়েছে, সে আল্লাহর ওপর নিরাশ হয় কী করে!?
খুব কাকুতি-মিনতি করে তাদেরকে বলতে ইচ্ছে হয়, “ফিরে আসো, তোমরা ফিরে আসো আবার আল্লাহর দিকে। এখনও তো মৃত্যু হয় নি। এখনও তো সময় শেষ হয়ে যায় নি। নিজেকে বদলে নাও… দ্বীনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দাও!”
আমরা রামাদানে রোজা রেখেছি। তারাউয়িতে দীর্ঘ কিয়ামুল লাইল করেছি। ক্বদরের রাতের খোঁজে কেউ কেউ হয়ত সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে দিয়েছি। অথচ ঈদ শুরু হতেই সব শেষ। জোরে গান বাজিয়ে, সেজেগুজে, পর্দা ছাড়া ছবি তুলে, ছেলেমেয়ে কাজিন মেলামেশা করে আমরা আমাদের রামাদানের আমলগুলোকে নষ্ট করে ফেলছি। যে ছেলেটা এতদিন কষ্ট করে দাড়ি রাখত, ঈদে এসে দাড়িটা কেটে ফেলল। যে মেয়েটা এতদিন বোরকা-হিজাব করেছে, ঈদের দিন সে হিজাব খুলে ফেলল। আপনারা ভয় করুন। ভয় করুন আপনারা!
আজ যারা দ্বীন থেকে এক বিন্দুও দূরে সরে যাচ্ছেন, এক বিন্দুও ছাড় দিচ্ছেন, এক বিন্দুও কম্প্রোমাইজ করে নিচ্ছেন, মনে রাখবেন, এই অল্প একটু সরে যাওয়াটাই এক সময় আপনাকে অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এতক্ষণ যাদের কথা বললাম, তারা প্রত্যেকেই কোনো একটা সময়, কোনো একটা পরিস্থিতিতে দ্বীন থেকে সরে গিয়েছিল, আল্লাহর আদেশের উপর নিজের নফসকে প্রাধান্য দিয়েছিল। আজ তাদের এই পরিণতি…
ঈমান দুনিয়ার সবচেয়ে দামি জিনিস। ঈমান ছাড়া আমাদের সব পরিচয় ধুলোয় মিশে একাকার হয়ে যাবে। তাই নিজের দ্বীনকে কখনও ছাড় দেবেন না, কখনও ঝরে যাবেন না। নিজের নফসের অনুসরণ করাকে ভয় করুন। আমাদের প্রিয় নবী আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর কাছে দুআ করতেন, “ও আল্লাহ, এক মুহূর্তের জন্যেও আমাকে নিজের নফসের হাতে ছেড়ে দিও না! চোখের পলকের জন্যেও আমাকে নিজের উপর ছেড়ে দিও না!” (নিজের ভাষায় দুয়ার একাংশ বললাম, মূল দুয়াগুলো নিচে)
“ইয়া হাইয়ু ইয়া ক্বাইয়ুমু বিরহমাতিকা আসতাগীসু আসলিহলি শা’নি কুল্লাহু ওয়া লা তাকিলনী ইলা নাফসি ত্বরফাতা ‘আইন”
“আল্লাহুম্মা রহমাতাকা আরজু ফালা তাকিলনী ইলা নফসি ত্বরফাতা ‘আইন ওয়া আসলিহলি শা’নি কুল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা আনত”
নিজেকে নফসের হাতে ছেড়ে দেবেন না। আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দিন।
সবার ঈদ আনন্দে কাটুক। আনন্দের দিনগুলো যেন গুনাহ কামানোর দিনে পরিণত না হয়। জীবন যেন নফসের পিছে ছুটে চলার জীবন না হয়। আমাদের অন্তরের ঈমানের মহীরুহটা সব অবস্থায় মজবুত থাকুক। আমীন!
…………………
ঈদ
আনিকা তুবা
জুন ১৫, ২০১৮ইং