১.
প্রতি বছরের মতো এবারও কুরবানী ঈদ একসাথে পালনের জন্য গ্রামে দাদার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে সামান্তা। ঈদের এখনও দুই দিন বাকী থাকলেও গতকাল রাতেই ওরা এসে পড়েছে। আজ সকালে নাস্তা সেরেই সামান্তা ওর ছোট চাচার ছেলে জারিফের সাথে বেড়িয়ে পড়ল গ্রাম দেখতে।
প্রথমেই ওরা গেল ওদের দাদা বাড়ি থেকে একটু দূরে বড় দাদার বাসায়। বড় দাদা বেঁচে না থাকলেও ওনার তিন ছেলে একসাথে তাদের পরিবার নিয়ে এক বাড়িতে থাকে।
এখানে আসলেই ওদের বাসার কাজিনগুলোর সাথে সাতচারা, লুকোচুরি খেলে সামান্তা। খেলার ফাঁকে ফাঁকে চলে গল্পগুজব। স্কুলের বন্ধুদের গল্প, দুরন্ত টিভির নতুন কার্টুনের গল্প, ঈদের জামা-কাপড়ের গল্প আর কুরবানীর গরু ছাগলের গল্প।
সামান্তা বলল, “আমাদের গতবারের গরুটা কত তেজী ছিল মনে আছে? এবার বাবাকে বলেছি, একটা শান্ত গরু কিনতে।” ওর কথায় জারিফও মাথা নেড়ে সায় দিল। তবে বড় দাদার নাতি- নাতনীরা এবার কোনো উৎসাহ দেখালো না ওদের গল্পে।
সবচেয়ে ছোট কাজিন লীনা তো বলেই ফেলল, “এবার বোধহয় আমাদের কুরবানী দেয়া হবে না।”
“কেন, কেন কুরবানী দিবি না তোরা?” জারিফ পাল্টা জিজ্ঞেস করল লীনাকে। সাথে সাথে সবচেয়ে বড় বোন রিমা ওর মুখ চেপে ধরে বলল, “ বেশী পাকনামি করিস না তো লীনা।“
ওদের বিব্রত অবস্থা দেখে সামান্তা জারিফকে চোখ টিপে ইশারা করল আর কথা না বাড়াতে। জোহরের আজান দিলে বাড়ি ফিরে এল ওরা।
বাসায় ফিরেই শুনল, ঢাকা থেকে সামান্তার ছোট খালামণি ফোন করেছিল। ওদের গরু নাকি আজকেই কেনা হয়ে গেছে। গরুর সাথে ওর কাজিন টিয়ারার একটা সেলফিও পাঠিয়েছে খালামণি। ওদের বিশাল সাইজের গরুর পাশে ছোট টিয়ারাকে আরও পিচ্চি দেখা যাচ্ছে।
দুপুরে খেতে বসে বাবাকে টিয়ারা আর ওদের গরুর ছবি দেখিয়ে সামান্তা বলল, “বাবা আমাদের গরুটা কিন্তু ওদের চেয়েও বড় কিনতে হবে, না হলে বড় বোন হিসেবে আমার প্রেস্টিজ থাকবে না।”
ওর কথা শুনে বাবা বলল, “ কুরবানী তো দেয়া হয় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। নিজের সামর্থের বাইরে গিয়ে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য কুরবানী দিলে কি সেটাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন, তুমিই বলো”?
বাবার এই প্রশ্ন শুনে লজ্জায় পড়ে গেল সামান্তা। আসলেই তো ও ব্যাপারটা এভাবে ভেবে দেখেনি। সামান্তা বলল, “আচ্ছা, সামর্থ্য না থাকলে কি কুরবানী না দিলেও হবে? আল্লাহ কি এত অন্তুষ্ট হবেন না?”
“হঠাৎ এ কথা কেন জানতে চাইছ?” বলল, সামান্তার বাবা। সামান্তা তখন বাবাকে খুলে বলল দুপুরের ঘটনা। সব শুনে বাবা বলল, “হ্যাঁ, আমিও শুনেছি ওদের পারিবারিক ব্যবসায় এবার নাকি অনেক লস হয়েছে, তাই হয়তো কুরবানী দেবে না ওরা।” এ কথা শুনে ওর কাজিনদের মুখগুলো ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল সামান্তার।
২.
ঈদের দিন দুপুর বেলা। সামান্তার বাবা ওদের ভাগের কুরবানীর মাংস নিয়ে ঘরে ঢুকে সামান্তার মাকে বললেন, “তাড়াতাড়ি মাংসগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে ফেল। বাড়ির বাইরে গরীব মানুষেদের ভীড় জমে গেছে। এক ভাগ মাংস ওদের মাঝে বিলি করে দিয়ে আসি।”
সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে সামান্তা তখন ঘরে বসে টিভি দেখছিল। বাবার কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, “তিন ভাগ করতে হবে কেন বাবা?” ওর বাবা বললেন , “ এটাই নিয়ম। এক ভাগ আমাদের, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের আর এক ভাগ গরীবদের দিতে হয় “ কিছুক্ষণ পর গরীবদের এক ভাগ মাংস নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাবা।
মা এরপর আত্মীয়দের ভাগের মাংস কয়েক প্যাকেটে ভাগ করে তাতে নাম লেখা কাগজ আটকাতে লাগলেন। সামান্তার মামা, খালামণি, বড় ফুপি, ছোট ফুপি…… নামগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎ সামান্তা বলে উঠল, “ মা, এরা সবাই তো নিজেরাই কুরবানী দিয়েছে, এদের আবার মাংস দেয়ার কি দরকার?
তার চেয়ে বরং সবার ভাগের মাংস বড় দাদার বাসায় পাঠিয়ে দাও, ওরা তো এবার কুরবানী দেয়নি, তাছাড়া ওরাও তো আমাদের আত্মীয়।” ছোট সামান্তার মুখে এ কথা শুনে মা এবার লজ্জা পেয়ে গেলেন।
সামান্তার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। ছোটদের কাছেও আসলে বড়দের অনেক কিছু শেখার আছে। তবে কাঁচা মাংস দিলে ওরা হয়তো মাইন্ড করবে। রাতের বেলা বরং এই মাংস দিয়ে ওদের সবার জন্য বিরানী রান্না করে নিয়ে যাব।” মায়ের এই কথা শুনে খুব খুশী হল সামান্তা।
কুরবানীর শিক্ষা হলো, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পশু কুরবানীর মাধ্যমে সামর্থ্যহীন মুসলমানদের সাথে সামর্থ্যবান মুসলমানদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া। সামর্থ্যবান মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতা করা কুরবানীর শিক্ষা নয়।
কুরবানীর শিক্ষা
সামিন বিনতে ইয়াসির
বয়সঃ৯
অগাস্ট ১১, ২০১৯ইং