আমরা প্লেনে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছি বেশ কিছুক্ষণ ধরে। একই ফ্লাইটের অন্যান্য যাত্রীরা এসে জায়গা খুঁজে বসে যাচ্ছেন আশেপাশে। এরমধ্যে এক বৃদ্ধাকে দেখলাম আমার খুব কাছে বসা, তার সাথে একজন মহিলা, সম্ভবত ওনার মেয়ে বা পুত্রবধূ। বয়সে আমার দাদির বয়সী হবেন, দাদি মারা গেছেন দুই বছর আগে। ওনার মতই ইনারো চামড়াগুলো শুকিয়ে হাড়ের সাথে লেগে গেছে, চোখ দুটো কোটরের ভিতরে।
প্লেনে ওঠার সময় দেখলাম, ওনাকে ধরেধরে হাঁটিয়ে নিতে হচ্ছে, নিজে একা একা পারছেন না হাঁটতে। আমাদের ঠিক সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, ওনার জন্য সবাইকে ধীরপায়ে যেতে হচ্ছিল।
প্লেনে যিনি চেকিং করে ওঠাচ্ছিলেন, আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “উনি হজ্জে যাবেন, এই শরীরে কি হজ্জের ধকল সইবে?” এরপর অল্পবয়সী একজনকে দেখিয়ে বললেন ” এরকম বয়সটাই হজ্জের জন্য সঠিক।”
এরপর ঐ বৃদ্ধার কি অবস্থা হয়েছিল জানা নাই, তবে তিনি সম্ভবত বাংগালী হাজিদের সিম্বল, যারা মৃত্যুর পূর্বে হজ্জে যাবার প্রস্তুতি নিই। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, বৃদ্ধ বয়সেই সবাই হজ্জে যান, অফিস থেকে রিটায়ার্ড করে, সন্তানদেরকে বিয়ে দিয়ে, তাদের নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে যখন নিজের পায়ের জোড় কমে আসে, তখন একজন মানুষ হজ্জের মনঃস্থির করেন।
হাজি বলতেই আমাদের চোখে যৌবন, বয়স পেরিয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধ লোকের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু বিষয়টা এমন তো হবার কথা নয়। হজ্জের যে শারিরীক এবং মানসিক ধকল সেটা সইবার জন্য তরুণ বয়সটাই পারফেক্ট।
হজ্জে যাবার পর যেটা দেখলাম, আমাদের দেশের লোকজনই বয়স করে হজ্জে যান বেশি, ৮০ ভাগ লোকের বয়স ৫০ এর উর্ধ্বে। অথচ ইন্দোনেশিয়ানদের দেখতাম, তারা দল বেধে আসতেন তাওয়াফ করতে, তরুনদের সংখ্যাই বেশি। আমার জানামতে কিছু দেশে বিয়ের আগেই হজ্জ করতে হয়।
শুধু তাই নয়, আফ্রিকানদের কেও দেখেছি, অল্প বয়সী হাজীর সংখ্যা প্রচুর। একদিন তাওয়াফ করছিলাম, আমার ঠিক সামনেই এক নিগ্রো মহিলা ছিলেন, হঠাৎ তার বিশাল খিমারের কিছুটা পিছন দিক থেকে একটু উপরে উঠে যায়। আমার চোখ বড়বড় হয়ে গিয়েছিল, কারন তার পিঠে একটা দুধের বাচ্চা। তাকে বেঁধে খিমারের নিচে পিঠে নিয়ে মা তাওয়াফ করছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
আমাদের দেশে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই দৃশ্য বিরল। উলটো হজ্জ ফরজ হয়েছে, ছোট বাচ্চাসহ মা হজ্জে যাচ্ছেন, এটা নিয়ে আত্মীয় স্বজনের কটুক্তি শুনতে হয়েছে কাউকে কাউকে; সেটা কিন্তু বিরল নয়।
তবে দৃশ্যটা পালটাতে শুরু হয়েছে বৈকি। অনেক তরুণ তরুণীই হজ্জে যাচ্ছেন এখন। যারা জানছেন হজ্জ ফরজ হওয়ার পর দেরি করা উচিৎ নয়, যার মন থেকে যেতে চান, ঠিকই যেতে পারছেন।
অনেকেই বলবেন, টাকা জমানোর ব্যাপার আছে। সেটা আছে অবশ্যই, কিন্তু আল্লাহ যখন ফরজ করছেন, আপনার সেই যোগ্যতা, সামর্থ্য আছে বলেই তো করেছেন। তিনি অবশ্যই কারো উপর তার ক্ষমতার চেয়ে অধিক দায়িত্ব চাপান না।
স্বামী/স্ত্রী , সন্তান, বাবা মা সবার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের উপর আরোপিত ফরজ ইবাদত পালনে আমরা গাফিলতি করি, যা নিজের পায়ে কুড়াল মারার চেয়েও ভয়ংকর!
আপনি যদি আজকে মারা যান, আপনার পরিবার, আপনার কাজ, অফিস একদিনের জন্যেও থেমে থাকবেনা। কিন্তু আপনি চলে চলে গেলে, আপনার ফেলে যাওয়া কাজ, আপনার ফরজ হজ্জ অনাদায় হয়ে পড়ে থাকবে। কবরের কষ্ট আপনার হবে, পরিবারের লোকজনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করতে পারিনি, এই অজুহাতে পার পাবার সুযোগ নাই।
আর হজ্জ একইসাথে শারিরীক এবং আর্থিক ইবাদাত। শুধু আর্থিক সংগতিই যথেষ্ট নয়, সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে, সুন্নাহ অনুসারে কাজগুলো করার জন্য শারিরীক সক্ষমতা জরুরী।
এর মাঝেও অনিশ্চয়তা আছে; সেটা হায়াতের। বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা কার আছে?
আমি আমার সহপাঠীর স্ত্রীসহ রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যুর খবর শুনে থমকে গিয়েছিলাম, তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে। এখনো কতোওওও কাজ বাকি!
আর এবারের ডেংগু কত প্রান নিয়ে গেল, আল্লাহ জানেন আরো কত বাবাকে সন্তানের লাশ বহন করতে হবে।
আপনি কি করে জানেন, আপনি অনেকের মত সত্তর, আশি বছর বা তার চেয়ে বেশি বাঁচবেন। মৃত্যুদূত কত দূরে তার খবর আল্লাহ ছাড়া কেই বা জানে? আর কিছুক্ষণ পরেই আমার/ আপনার মৃত্যু আসবেনা কি করে নিশ্চিত হবেন?
আর বোনেরা, স্বামী থাকা অবস্থায় হজ্জ করে ফেলতে চেষ্টা করবেন। আমি বহু মহিলাকে দেখেছি, যাদের স্বামী মারা যাবার পরে বোধোদয় হয়েছে, কিন্তু এখন আর মাহরাম পাচ্ছেন না যাবার জন্য। শেষ পর্যন্ত অন্য উপায় না পেয়ে এজেন্সির লোকদের কাউকে মাহরাম দেখিয়ে মহিলাদের সাথে বিনা মাহরাম অবস্থায় হজ্জ করছেন। বোন, আপনার যেন এই অবস্থা না হয়!
আমরা সবাই প্রস্তুত তো জীবনের শেষ গন্তব্যে যেতে??
হজ্জ কবে করবেন ও কেন?
ফাহমিদা হুসনে জাহান
অগাস্ট ১০, ২০১৯ইং