“দাদুমণি তাড়াতাড়ি সোয়েটারটা পড়ে নাও, আমরা খেলার মাঠে যাব!”
আসর সালাত পড়ে নাতনিকে ডাকতে আসলেন দিলারা বেগম। অথৈ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে দেখছিল। দাদুর ডাকে এক লাফ দিয়ে টুল থেকে নেমে দৌড়ে আসল। বিকালে খেলার মাঠে যেতে ওর খুব ভালো লাগে।
দ্রুত রেডি হয়ে দাদুর হাত ধরে রাস্তায় নেমে আসে অথৈ। ওদের বাসার কাছে মসজিদ, এরপর একটা ফার্মেসী, তারপর একটা খাবার হোটেল। হোটেলের পরেই এলাকার জনপ্রিয় কাঁচাবাজারটা। এই বাজারের শেষে একটু আগালেই খেলার মাঠ। বাইরে বের হলে অথৈর খুব আনন্দ হয়। ও দাদুর হাত ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে যায় আর সব কিছু দেখে। বাসা থেকে বের হলে যে মুদি দোকানটা ওটার বাইরে রঙ্গিন চিপ্সের প্যাকেট ঝোলান থাকে। কোনটা কোন চিপ্স অথৈ এখন জানে। মা প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় ওর জন্য চিপ্স নিয়ে আসে। এরপর মসজিদের বাইরে থেকে ও ভেতরটার দিকে তাকায়। বড় খোলা জায়গা, ভেতরে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মানুষ বসে কুরআন পড়ছে। আরেকটু হেঁটে গেলেই গরম গরম পুরি আর শিঙ্গাড়ার ঘ্রাণ ভেসে আসে হোটেল থেকে।
কাঁচাবাজারে যেন অথৈর দেখার জিনিসের অভাব নেই। থরে থরে আলু, পেঁয়াজ সাজান থাকে, ও দেখতে দেখতে যায়। খাঁচির ভেতর একদিন অনেকগুলো হাঁস দেখেছিল। দাদুকে হাত টেনে ধরলে দিলারা বেগমও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওকে মন ভরে দেখতে দিলেন হাঁসগুলো। একটা দোকানের পাশে পরের দিন জবাই করার জন্য গরু এনে রাখা থাকে। গরুগুলো খড় খায়, অথৈ দাঁড়িয়ে দেখে। দাদু ওকে আরও কাছে নিয়ে যান ভালো করে দেখার জন্য। এক দুইবার সুযোগ পেয়ে গরুর গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দিয়েছে অথৈ। গরুর চোখদুটো কী যে মায়া লাগে ওর! বাজারের শেষে পিঠা বিক্রেতা বসে। গরম গরম ভাপা পিঠা বানাতে দেখা যায় তাকে। চিতই, পাটিসাপটা আগে বানিয়ে সাজান থাকে বাক্সের ভেতর। খেলার মাঠের গেটের বাইরে বসে বাতাসা, মুরালি, নিমকির ভ্যান। ছোট ছোট খেলনার মতো জিনিসগুলো কী সুন্দর করে সাজান থাকে! মাঠে ঢুকতেই অথৈর মনটা আনন্দে আরেকটা লাফ দেয়। মাঠের এ-মাথা ও-মাথা দৌড়ে বেড়ায় ও। পৃথিবীটাকে বিশাল মনে হয় ওর কাছে তখন। খেলার সাথী জুটে গেলে কারো সাথে ও বল নিয়ে খেলে। কখনো দাঁড়িয়ে অন্যদের খেলা দেখে।
দিলারা বেগমের হাঁটুতে ব্যথা, হেঁটে এসে উনি মাঠের একপাশে বসে থাকেন।
“অথৈইইইই … আম্মুউউউ!!” পেছন থেকে মালিহার ডাক শুনে অথৈ ঘুরে তাকিয়ে দেখে মা এসেছে মাঠে। মনে পড়ে গেল ওর আজ শনিবার, মায়ের অফিস কিছুটা তাড়াতাড়ি শেষ হয় এইদিন। বাড়ি ফেরার আগে মা তাই শনিবারে মাঠে এসে কিছু সময় ওর সাথে থেকে একসাথে বাড়ি ফেরে। মা মাঠে আসলে অথৈর খুব আনন্দ হয়। মায়ের সাথে কিছুক্ষণ বলটা নিয়ে খেলতে না খেলতেই ফেরার সময় হয়ে গেল।
ফেরার সময়টাও অথৈর খুব ভালো লাগে। মাঠের বাইরে ছোট ছোট চৌকিতে ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা শীতের কাপড় নিয়ে বসে থাকে। অন্যান্য দিন দাদুর হাত ধরে টেনে অথৈ সেদিকে নিয়ে যায়, ছোট ছোট রঙ্গিন উলের টুপি, হাত মোজা ধরে ধরে দেখে। রাস্তার উল্টোদিকে ঝুড়িতে করে আমলকী, লেবু, তেঁতুল বিক্রি করে। সবকিছু অথৈ হাতে নিয়ে একটু ধরে দেখে। বাজারটার শুরুতেই বড় একটা খাঁচির ভেতর অনেকগুলো মুরগী নিয়ে বসে মুরগীওয়ালা। কাছাকাছি গেলেই দাদুর হাত ছেড়ে অথৈ দৌড়ে গিয়ে মুরগী দেখে। প্রতিদিন ওকে দেখতে দেখতে এখন মাঝবয়সী বিক্রেতাও ওকে দেখলে এ-কান ও-কান বিস্তৃত হাসি দিয়ে বলে, “আইসো মনু!” বাজারের শেষে স্টুডিও আছে একটা। সেটার বাইরে ছোট ছোট রঙ্গিন লাইট দিয়ে সাজান। অথৈ হাত বাড়িয়ে নিচের দিকের একটা লাইট ধরে। ওর ছোট হাতের ভেতর লাইটটা রঙ পাল্টায়। যাত্রাবাড়ির এই এলাকাটা এখনো অতটা কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। শীতের বিকালে নাতনির সাথে বাইরে বের হওয়াটা দিলারা বেগমও খুব উপভোগ করেন। কিছু সময়ের জন্য যেন উনি ভুলে যান উনি দূষিত ঢাকা শহরে আছেন, মনে হয় নিরিবিলি মফস্বল শহরের পথ দিয়ে বুঝি হেঁটে যাচ্ছেন।
কিন্তু মালিহা যেদিন আসে সেদিন ফেরার সময়টা অথৈর এতকিছু দেখার সুযোগ হয় না। মালিহা শুধু তাড়া দিতে থাকে। শুধু বলে, দেরী হয়ে যাচ্ছে, জলদি হাঁটো। মালিহাকে ঘরে ফিরেই মাগরিবের সালাত শেষ করে রায়হানের জন্য নাস্তা রেডি করতে হবে। রায়হান আসবে আরও ঘন্টাখানেক পর, এসেই আবার ওর ল্যাপটপ নিয়ে বসে যাবে। হাতে থাকবে ফিশ ফিঙ্গার বা নাগেটের টুকরো আর পাশে থাকবে ধুমায়িত চা। চা খেতে দেরী হলে আবার রায়হানের মাথা ব্যথা শুরু হয়। মালিহাকে তাই তাড়াতাড়ি চুলায় আদা জ্বাল হতে দিতে হয়। রায়হান ভালো করে জ্বাল করা আদা চা খায় সন্ধ্যায়।
দিলারা বেগম আউয়াল ওয়াক্তে ইশার সালাত পড়ে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। পাশে বসে অথৈ শুনছে। এই বয়স্কা মহিলাটি থাকায় তাও ওদের ঘর থেকে কুরআনের আওয়াজ শোনা যায়, নাহলে রায়হান বা মালিহা কারো ব্যস্ত জীবনে কুরআন নিয়ে বসার সময় নেই। হঠাত কী মনে হতে অথৈ রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। আবদারের সুরে বলল, আম্মু প্লিজ তুমি একদিন আমাকে খেলার মাঠে নিয়ে যাবে, আমি তোমার সাথে অনেকক্ষণ খেলব! অথৈর চুলে একটু হাত বুলিয়ে “ইনশাল্লাহ মা, যাব একদিন!” বলেই মালিহা খেয়াল করল বুয়া খুব ধীরে আস্তে কাটাকুটি করছে। তাকে তাড়া দিয়ে পাতিলের তরকারিটা নাড়তে ব্যস্ত হয়ে গেল মালিহা। রায়হান সাড়ে আটটার মাঝে টেবিলে খাবার চায়। চুলার তরকারিটা নামিয়ে কাল দুপুরের জন্য আবার আরেকটা তরকারি বসাতে হবে।
গোধূলির লালিমা মিলিয়ে গেছে কখন! আকাশে কি সন্ধ্যাতারাটা দেখা যাচ্ছে? কী জানি! মালিহার নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই। গত বছর শনিবার মালিহার অফিস ছুটি ছিল। ও চেষ্টা করত সেদিন অথৈর সাথে খেলতে, ওকে বাইরে নিয়ে যেতে। শুক্রবারটা তো ঘরের জমে থাকা কাজ করেই কুল পাওয়া যায় না। এই বছর রায়হান বলে দিয়েছে সামনের বছর ও গাড়ি কিনতে চায়। এখন থেকেই ওর বেতনের কিছুটা জমাবে আর বাকিটা লোন নিবে, মালিহা যেন অথৈর স্কুলের বেতনটা চালিয়ে নেয়। বাড়তি টাকা যোগাড়ের জন্য মালিহা এখন শনিবার ওভারটাইম করে।
এমনিতে আগে থেকেই বাসা ভাড়াটা মালিহার বেতন থেকেই দেয়া হয়। রায়হান চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা শুরু করেছে। ব্যবসা দাঁড় করাতে অনেক টাকা লাগবে। এখন সংসারের পেছনে এত টাকা ও দিতে চায় না, বিশেষ করে মালিহা যেখানে চাকরি করে।
“আর পারি না, আর পারি না, আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগে …” মালিহার যেন মনে হয় জীবনকে ধরার জন্য সে যতই ছুটে চলেছে জীবন যেন ততই তার হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
মরীচিকা
-রাবেয়া রওশীন
(১৬/০২/২০১৯)