নীলার বয়স এখন পনেরো। বেশ ভাবুক ও চঞ্চল মেয়েটি। এ ধরণের কম্বিনেশন সচরাচর দেখা যায় না। ছিপছিপে, শ্যামলা মেয়েটি মানুষের সাথে প্রাণ খুলে মিশতে পারে। পরিচিত, অপরিচিত সকলের কাছেই স্বচ্ছ কাঁচের মতো নিজেকে তুলে ধরে। বই পড়া, ছবি আঁকা আর পৃথিবীর বিখ্যাত ঘটনা গুলোর পেপার কাটিং সংগ্রহে রাখা ওর শখ।
বয়স পনেরো হলেও শিশুসুলভ। মায়ের সাথে ভীষণ ভাব। কোনো কিছুই মা থেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। যেখানে ওর বয়সী ছেলেমেয়েদের অসংখ্য টপ সিক্রেট ব্যাপার থাকে সেখানে ওর সব কিছুই মায়ের সাথে আলাপ করে।
আশেপাশের লোকজনদের খুব খেয়াল করে , ওর মজা লাগে মানুষের মানসিকতা এনালাইসিস করতে। আঁতেল হবার উপকরণ প্রচুর কিন্তু মেয়েটি তা নয়। পড়াশোনায় ভালো, খুব স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড।
কৈশোরে পদার্পনের পরও নিজের রূপ, লাবণ্য নিয়ে তেমন চিন্তিত নয়। তার বয়সী অন্যান্য মেয়েদের মতো পোশাক, সাজসজ্জা নিয়ে মোটেও ইন্টারেস্টেড না। তাই ওর কাছে জীবনের অনেক বাস্তব সত্য বোঝা কষ্টসাধ্য মনে হয় না। আর্টিফিশিয়াল আর ন্যাচারালের পার্থক্য বোঝে। সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে তার চেতনা সর্বদা সজাগ।
পড়াশোনা করছে একটা মেয়েদের স্কুলে। আজকাল আবার শুধু স্কুলে পড়লে চলে না তাই ওর মা একটা স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়েছেন। সেখানেও মুহূর্তেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে নীলার। তবে বন্ধুসুলভ স্বভাব হলেও ছেলেদের সাথে মিশতে পারেনা, ওর ভালো লাগে না। এরজন্য অবশ্য বান্ধবীরা “সেকেলে” , “খালাম্মা” ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে। কিন্তু তাতে নীলার কিছুই যায় আসে না।
কোচিং এ ওর পার্সোনালিটি ভিন্ন হয়ে যায়। গাম্ভীর্যের জন্য ছেলেরাও কথা বলার সাহস পায় না। পড়াশোনায় ভালো বলে শিক্ষকরা বেশ পছন্দ করেন। আর ওর আসে পাশে কী হচ্ছে, কোন মেয়ে কোন ছেলের প্রেমে পড়েছে, কোন ছেলে কোন মেয়েকে চিঠি লিখেছে- ইত্যাদি বিষয়ে ওর মাথাব্যথা নেই। ক্লাস করে আর বাসায় ফেরে।
বান্ধবীদের একজন একদিন নীলাকে বলল যে সে ক্লাসের কোনো এক ছেলের সাথে প্রেম করতে আগ্রহী। শুনে নীলা চোখের চশমাটা আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করতে করতে বেশ বিজ্ঞভাবেই বলল , “দেখ তনিমা , এই বয়সের প্রেম ক্ষণস্থায়ী। টিনএজ লাভ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিকে না। কি দরকার জীবনে একটা মানুষকে এই বয়সে ঢুকাবার? এই সময় সব ডিসিশন আবেগী হয়। রিয়েল লাইফে আবেগের কোনো বেইল নাই।”
ওর কথা শুনে হেসেই খুন তনিমা। উত্তরে বলল, “কোন যুগে আছিস রে নীলা! this is modern era. Be a little smart. তোর ওই পুরানো খালাম্মা টাইপ কথা বলিস দেখেই কোনো ছেলে তোকে পাত্তা দেয় না। তোকে বলাই ভুল হইসে। আমি সিদ্ধান্ত নিসি সাকিবের সাথে প্রেম করবো, ব্যাস করবো। তুই শুধু আম্মুকে কিছু বলিসনা।”
নীলা মন খারাপ করে বলল, ” এত বড় ভুল করিসনা রে। আন্টিকে না হয় বললাম না কিন্তু তুই বুঝ! এটা ঠিক কাজ হবে না।” তনিমা কিছু না বলে চলে গেলো।
এরপর থেকে তনিমা আর নীলার সাথে বসে না। অন্যান্য বান্ধবী যারা ওর সিদ্ধান্ত কে স্বাগত জানিয়েছে , ওদের সাথেই বসে আর ওদের সাথেই কথা বলে। নীলা কিছুটা দুঃখ পেলেও স্বাভাবিক থাকলো। মনে মনে ভাবলো- একদিন ঠিক বুঝবে তনিমা, শুধু যেন খুব দেরিতে না বুঝে।
একদিন ক্লাস শেষে ক্লাসের বাইরে তনিমাকে ওর সদ্য পাতানো বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে আলাপ করতে দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি রে, কী হয়েছে? এতো হাসাহাসি কেন?” তনিমা হাসি থামিয়ে বলল, “ঐ যে এসে গেছে আমাদের হুজুর আপা! আচ্ছা নীলা তোর কথায় কেমন হুজুর হুজুর গন্ধ পাই। তুই বোরকা পরিসনা কেন? তখন যেখানে সেখানে শরীয়ার কথা বলে বেড়াবি।” কথাটা শেষ না হতেই তাচ্ছিল্যের অট্টহাসিতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে তনিমার সখীরা।
নীলা কিছু বলবেনা ভেবেছিলো। ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে আবার ওদের দিকে ফিরে বলল, “ইনশাআল্লাহ, একদিন বোরকা পড়বো। তোদের শরীয়া বোঝাতে নয়; নিজের পরিত্রানের জন্য। আমি যা ভাবছি আর যা বলছি তা তোদের খারাপ লাগলেও আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার সাথে আছেন।” তনিমার মুখের তাচ্ছিল্য তখনও বর্তমান।
কয়েকদিন পর, ক্লাসে তাড়াতাড়ি চলে গেছে নীলা। এখনো কেউ আসে নাই, একাই বসে ছিল হঠাৎ তনিমা এসে বলল, “তুই বিশ্বাস করবিনা কি কান্ড হইসে! সাকিবের বন্ধু আছে না, ওই যে নাদিম। ও না তোকে যা পছন্দ করে। কিন্তু তোর সাথে এসে কথা বলতে ভয় পায়। যা মুড নিয়ে তুই থাকিস, বাব্বা! আজকে আয় তোর সাথে আলাপ করিয়ে দিবো। বেচারা ক্লাসের বাইরেই আছে। ক্লাসে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না।”
নীলা অবস্থার আকস্মিকতায় কিছুটা বিচলিত হলেও আরো গম্ভীরভাবে বলল, “তনিমা, তুই ভাবিস না আমি আমার ব্যাপারে কোন ভিন্ন ভাবি। তোকে যে উপদেশ দিয়েছিলাম তা আমি বিশ্বাস করি। আমার বাবা মা আমাকে অগাধ বিশ্বাস করেন। কোন কিছুর বিনিময়ে সেই বিশ্বাস ভাঙা পসিবল না। আর তাছাড়া তোর ঐ নাদিম ফাদিম আমার সাথে যায় না। আমি হলাম হুজুর মনস্কা আর ও তো তোদের মতো মডার্ন, তাই না?” তনিমা বক্তৃতা দিয়ে তাচ্ছিল্য নিয়ে চলে গেলো। নীলা খুব প্রশান্তি পাচ্ছে। নিজের নীতি প্রতিষ্ঠার প্রশান্তি।
এর মধ্যে একমাস পার হয়ে গেছে। তনিমাকে বেশ কয়েকদিন থেকে দেখা যাচ্ছে না। যেদিন আসলো সেদিন ওকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে, খুবই উদাসীন। নীলা ক্লাস শেষে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তোর? আমাকে বলতে পারিস। আমি তোকে সাহায্য করতে পারি।”
তনিমা আর কান্না আটকাতে পারলোনা। কেঁদে কেঁদে বলল, “নীলা তুই ঠিক বলেছিলি। আমার সাকিবের সাথে প্রেম করা উচিত হয় নাই। ও আমাকে কোচিং শেষে বাসায় দিয়ে আসত। রিক্সা করে অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে নিয়ে যেত আর…. আমার লজ্জা লাগছে তোকে বলতে। ও আমার সাথে……. আর এখন হঠাৎ আমার সাথে কথা বলছে না। আমার ফোন ধরে না। আমাদের ক্লাসে নতুন যে উগ্র টাইপ একটা মেয়ে আসছে না, সামিরা। সাকিব এখন ওর সাথে ঘুরে। আমি যে ওর গার্লফ্রেন্ড সে পরিচয়ও দেয় না।”
– ” কী ? ওকি তোর গায়ে হাত দিয়েছে ? ”
– “হ্যাঁ”
– ” তুই কিছু বলিস নাই?”
-” কী বলব? ও আমার বয়ফ্রেন্ড না!”
-” তোর একটুও মনে হলো না কাজ টা খারাপ?”
– ” এরকমই তো সবাই , আমি কেমনে বুঝব বল। এখন তুই আমাকে হেল্প করতে পারিস।”
-” আমি?”
– ” হ্যা , তুই গিয়ে সাকিব কে জিজ্ঞেস করনা কেন আমাকে এভোয়েড করছে! আমার সাথে কথা বলছে না কেন। প্লিজ নীলা আমার জন্য এতটুকু কর। ”
-” আমি কি বলবো? আমি কি ছেলেদের সাথে কথা বলি? আর আমি বললেই ও আমার কথা শুনবে কেন?”
তনিমা কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করেই যাচ্ছে। তাই নীলা সাকিবের সাথে কথা বলার জন্য ক্লাস থেকে বের হল। ও বিশ্বাস করতে পারছে না ক্লাস নাইনে পড়া ছেলের এতো সাহস যে একটা মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে! নীলা যে কতটা সেকেলে আজ বুঝলো। আজকাল মনে হয় এসব কোনো ঘটনাই না। আর এতসব করে আবার কথা বলছে না! তনিমার allow করে উচিত হয় নাই। সেই সময় কষে একটা চড় বসিয়ে দেয়া দরকার ছিল।
নীলা ওর বিচ্ছিন্ন চিন্তা করতে করতে কোচিং সেন্টারের বাইরে এসে দাঁড়ালো। দেখলো সামনেই একটা চায়ের দোকানে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আছে সাকিব। নীলা কাছে গিয়ে বলল , “সাকিব তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। একটু এদিকে আসবা ?” নীলার কথা গুলা বলার সময়ও ঘেন্না লাগছে।
সাকিব উঠে এসে নীলার সামনে আশ্চর্যজনকভাবে মাথা নামিয়ে দাঁড়ালো। নীলা বলল, “তুমি তনিমার সাথে কথা বলোনা কেন? এসব কি পেয়েছ? যা মনে চায় করবা এরপর ইগনোর করবা! এর জন্যই ওর সাথে রিলেশন করেছিলে?” নীলা কথা শেষ করতে পারলো না।
সাকিব বলে উঠলো, “নীলা প্লিজ, তুমি তনিমার ওকালতি করতে এসোনা। তোমাকে আমি ও আমাদের ক্লাসের অন্যান্য ছেলেরা খুবই রেসপেক্ট করি। তুমি, তনিমার মতো মেয়ের হয়ে কোনো রিকোয়েস্ট করো না। ” একথা বলেই সাকিব চলে গেলো।
নীলা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু সুযোগ পেলো না, “তনিমার মতো মেয়ের হয়ে রিকোয়েস্ট করবো না ঠিক আছে তবে তোমার মতো ছেলেদের থেকে আজীবন মেয়েদেরকে সতর্ক করতেও ভুলবোনা।”
আজ বহুকাল পেরিয়ে গেছে। কৈশোর পেরিয়ে নীলা যৌবনে পদার্পন করেছে। তনিমাকে বলা সেই কথাটি আজ নীলার জীবনে সত্য। নীলা এখন বোরকা পড়ে। হাজার কটুকথা , তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ওকে ওর পথ চলাতে আরো অনুপ্রাণিত করে।
যতবার “সেকেলে” “খালাম্মা” সম্বোধন শোনে ততবার ওর মনে হয় আলহামদুলিল্লাহ সবচেয়ে নোংড়া ছেলেটাও জানে যে ও সম্মানিতা। এখন তো মানুষ আরো কত নামে সম্বোধন করে – “আতেঁল”, “দাদী আম্মা”!! ওর মনে হয় আলহামদুলিল্লাহ্ ওর রব সেই কবে থেকে একটু একটু করে ওকে এই পথে চলার জন্য প্রস্তুত করছিলেন! মানুষের কটু কথা ওকে রবের আরো নিকটে নিয়ে যায়। নীলা ভাবে আর পরিতৃপ্ত হয় -ওর রব, ওর পাশে ছিলেন সর্বদা। এর থেকে বড় সম্মান আর কী হতে পারে!
…………………………
সম্মানিতা
সামান্থা সাবেরীন মাহী
(২৫ জানুয়ারী ২০১৮)