১.
ভোর সকাল থেকে রাহেলা খানম ঘর গুছাচ্ছেন। আজ তার ছোট দেবর বাসায় আসবেন। দেবর তার বিরাট নামী দামী মানুষ। এককালে সচিব ছিলে্ন, এখন সপরিবারে আমেরিকায় থাকেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় করে দেশে এসেছেন ছেলেমেয়েকে শিকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। শিকড়ের সাথে কিছু আগাছাও পরিচয় করিয়ে দিতে হয়। তাই আজ বড় ভাইয়ের বাসায় আসবেন।
রাহেলা খানমের ঘর গুছাতে রান্না বান্না করতে ক্লান্তি নেই, কিন্তু তার অপদার্থ ছেলেমেয়ের কথা ভেবে ক্ষণে ক্ষণে তার বুক কেঁপে উঠছে। চাচার সামনে এরা না জানি তার মান সম্মান ডুবায়! তিনি গত দুইদিন ধরে ছেলেমেয়েদের নসিয়ত দিয়ে যাচ্ছেন চাচা আসলে চাচাকে সালাম দিবে। কুশল জিজ্ঞেস করবে, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে। ছেলেমেয়েরাও তাকে অভয় দেয় “আম্মা কুনু টেনশন নিবানা, কাক্কা আমগো সুনাম করতে করতে বাড়িত ফিরব।”
এমন অভয়বাণীর পরও রাহেলা খানমের বুক ধরফর করে। প্রেশার লো হয়ে যায়। কেন যে সব চিন্তা তাঁকেই করতে হয়! ওদিকে সাঈদ সাহেব ঘরঘর করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। ছেলেমেয়ে সব হয়েছেও তার মত।সভ্য সমাজে চলার মত কোনো বৈশিষ্ট্যই তাদের নেই।
ঘর গুছানো শেষ। সাঈদ সাহেব ঘুম থেকে উঠেছেন। বগল চুলকাতে চুলকাতে রান্না ঘরে এসে খানিক্ষণ স্ত্রীকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর হাই তুলে হাউমাউ করে যা বললেন তা আর কেউ বুঝতে না পারলেও রাহেলা খানম বুঝেছেন। চুলায় গরম পানি দিতে বলা হয়েছে, বহুদিন পর আজ তিনি গোসল করবেন। চুলায় পানি দিয়ে ছেলেমেয়েদেরকেও উঠিয়ে দিলেন ঘুম থেকে। বললেন একটু পরই তোমাদের সচিব চাচা আসবে। সুন্দর জামা কাপড় পরে ফিটফাট হয়ে থাকো।
মোটামুটি কোনো ঝামেলা ছাড়াই ওরা সুন্দর জামা কাপড় পরল। ছোট ছেলেটা অবশ্য প্রথমে বলেছিল “আম্মা আমি কিন্তু লুঙ্গিই পিন্দা থাকমু!” এক ধমকে ওকেও সাইজে আনা হয়েছে। অনেক্ষণ ফিটফাট হয়ে বসে থাকার পর ছোট ছেলে যখন ভাবছে লুঙ্গিটা আবার পরবে কি না, তখনই চাচা আসলেন। কোনো এক কারণে বাচ্চাকাচ্চা আর স্ত্রীকে সাথে আনেন নি।
ছেলেমেয়েরা সমস্বরে সালাম দিল। বড় ছেলে কুশল জিজ্ঞেস করল “কাক্কা কিবা আছুইন?”
সচিব চাচা ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। “আমেরিকাতে কখনোই ছেলেমেয়েরা এভাবে কথা বলে না। এরা এসব কোথা থেকে শিখছে?”
ছেলেমেয়েদের বাবা সাঈদ সাহেব কিছুই বুঝলেন না। আমেরিকার ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষায় কেন কথা বলবে সেটা তার মাথায় ধরছেনা। তিনি তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, যদি কিছু বোঝা যায়। রাহেলার মুখ থমথমে। তারমানে ভয়ংকর কিছুই ঘটেছে। ভয়ংকর কিছু ঘটলে সাঈদ সাহেবের প্রথমেই মাথায় আসে আজ বাড়িতে চা পাওয়া যাবে না। দোকানে গিয়ে খেতে হবে। আর তখনই তার প্রচন্ড চা পিপাসা পায়। তিনি ছোট ভাইয়ের রাগের ধার না ধেরে বললেন, “আমি চা খেতে বাইরে যাব। তুই যাবি?”
ভাইয়ের চা খাওয়ার ইচ্ছা নেই। এখানে চা এর নামে যা খাওয়ানো হয় তা আসলে চা না। চা কী জিনিস বুঝতে হলে আমেরিকায় যেতে হবে। যে আমেরিকার চা খায়নি সে কিছুই খায়নি। চা দোকানে গেলে এই অসভ্য ছেলেপেলেদের অন্তত দেখতে হবে না।
বড় ভাই যে গাইয়া ছিলেন সে গাইয়াই আছেন। ছেলে মেয়ে নিয়েছেন হাফ ডজন, শিক্ষা দীক্ষা কিছুই দিতে পারেননি। একেকজনের মুখের কী ভাষা! ভাইয়ের ভাল মন্দ কিছু হয়ে গেলে তো এরা সব তার ঘাড়েই পড়বে। কিছু করে খাওয়ার মুরোদও তো এদের হবেনা।
২.
চায়ের দোকানে অনেক লোক। সাঈদ সাহেবকে সবাই চিনে। দেখা মাত্র অনেকেই লম্বা করে সালাম দিল। সাঈদ সাহেব ভাইয়ের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার ছোট ভাই।
আমেরিকা ফেরত সাবেক সচিব আবারও অপমানিত বোধ করলেন। ছোট ভাই আবার কেমন পরিচয়? তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন। এক কালে সচিব ছিলেন, এখন আমেরিকায় থাকেন। দেশে এসেছেন শেকড়ের টানে। মাঝে মাঝে দেশি পত্রিকায় টুকটাক আর্টিকেল লিখেন। চায়ের দোকানের সবাই বুঝতে পারল বেশ গণ্যমান্য ব্যক্তির সাথে তাদের সাক্ষাত হয়েছে। একজন এও বললেন তিনি সচিবকে চিনেছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনে তার আর্টিকেল প্রায়ই পড়েন। সচিব সাহেব অবশ্য আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনের নাম শোনেননি, তবে দেশের শীর্ষ পত্রিকা হবে ভেবে আর কিছু বললেন না। সবাইকে নিজের পরিচয় দিতে পেরে এখন তার ভীষণ ভাল লাগছে। ভাইয়ের সাথে খুশিমনে বাসায় ফিরলেন।
বাসায় ফিরে তিনি লক্ষ করলেন ভাইয়ের দুই ছেলের মুখেই দাঁড়ি। আঁতকে উঠলেন তিনি। জংগি না তো? কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
“এই ছেলে এই, তোমরা দাড়ি রেখেছো কেন? আমেরিকায় এই বয়েসি ছেলেরা এত স্মার্ট! কখনোই দাঁড়ি রাখেনা।”
ছোটটা উত্তর দিল, “কাক্কা অগো মনে হয় দাড়ি উডেনা। আমগো উডসে, রাইখা দিসি।”
– “কত বড় সাহস ছেলের! ফালতু কথা বলার জায়গা পায় না! ভাবি এরা দাঁড়ির জন্য নিজেরাও বিপদে পড়বে, আপনাদেরও বিপদে ফেলবে! আমার পরিচয় কিন্তু কোনো কাজে আসবে না!”
রাহেলা খানম নিশ্চুপ। মনে মনে ভাবছেন দুই ছেলের পিঠে আজ কী ভাংবেন। বেশিক্ষণ ভাবতে পারলেন না। বিকট শব্দে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল।
অন্ধকারের মধ্যেই টের পেলেন “আমি এগো কাউরে চিনি না কাউরে চিনি না” বলতে বলতে তার দেবরের দাঁত লেগে গেছে।
জ্ঞান ফেরার পর প্রাক্তন সচিব নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলেন। মোমবাতির আধো আলো ছায়ায় একগাদা মুখ, তার কলিজায় নতুন করে কাঁপ ধরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ধরমড় করে উঠে বসে বললেন, “বুম কেডা ফুটাইসে?”
কেউ একজন বলল বোম না, ট্রান্সফর্মার ফেটে কারেন্ট চলে গেছে। কলিজার কাঁপ তবু থামল না। “মায়া গো মায়া আম্রিকাত ইমুন কইরা ট্রান্সফর্মার ফাটসে না” বলতে বলতে তিনি আবার জ্ঞান হারালেন।
ইউ নো, ‘ম্যারিকাতে এমন হয় না
আফিফা আবেদীন সাওদা
( ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭)