সে অনেক দিন আগের কথা….

বই পত্রে ও পরিচিতদের মুখে যখন প্রাচীন কালের হজ্জ সম্পর্কে শুনি বা পড়ি, তখন প্রতিনিয়ত আশ্চর্য হই। সেসব সময়ের তুলনায় এখন আমাদের জন্য সকল কার্যাবলী অবিশ্বাস্য রকমের আরামদায়ক ও নিরাপদ হয়েছে। অথচ মাত্র অর্ধ শতাব্দি পূর্বেও মুসলমানেরা অপরিসীম কষ্ট স্বীকার করে এই পূন্যময় যাত্রায় শরীক হতেন!

রাসুল (সাঃ) এর সময়কার ও তাঁর পরবর্তী কয়েকশ বছর উট ছিল অন্যতম বাহন। দূরবর্তী দেশসমূহ থেকে হজ্জ যাত্রীরা, মৃত্যুর হাতছানিময় হাজারো মাইল বিস্তীর্ণ মরুভূমি অতিক্রম করে অথবা জাহাজে করে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বাইতুল্লাহতে হজ্জ ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আগমন করতেন।

রোগে- শোকে, শত্রুর আক্রমণে ও আরো নানাবিধ কারণে, এই বিপদ সঙ্কুল দীর্ঘ পথে অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হতেন। আবার অনেকে শত পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে শেষ পর্যন্ত সফল হতেন মক্কা পর্যন্ত পৌঁছতে। যারা বেঁচে যেতেন, তাদের অনেকের দেশে ফিরতে ফিরতে এক বা একাধিক বছরও গড়িয়ে যেতো।


বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার হজ্জের বর্ণনা শুনলে, তেরশ শতাব্দীর হজ্জ যাত্রা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

ইবনে বতুতা সুন্নি ইসলামের একজন অন্যতম আলেম ছিলেন। তিনি মাত্র বিশ বছর বয়সে হজ্জের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েন। মোট চার বার হজ্জ করে, তিরিশ বছর পর স্বদেশে ফেরত যান।

বর্তমান পৃথিবীর মানচিত্র হিসাবে দেখলে, উনি অন্তত চল্লিশটি দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং তৎকালীন মুসলমান শাসকের শাসনাধীন প্রায় সব দেশেই পা রেখেছিলেন। তিনি সবসময় চেষ্টা করতেন, এক রাস্তা দু’বার ব্যবহার না করতে। তাই যে রাস্তা দিয়ে কোন দেশে প্রবেশ করতেন, অন্য রাস্তা দিয়ে বের হতেন। সে সময় উট বা ঘোড়া ছিল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার দ্রুততম মাধ্যম।

নিজ দেশ তাঞ্জিয়ার থেকে বহু দেশ অতিক্রম করে ইবনে বতুতা দামাস্কাসে পৌঁছান, সেখানে রমাদান মাস পালন করে, মিসর হয়ে মদিনা যান ও অতঃপর মক্কা গমন করেন। বিশাল হজ্জ কাফেলার সাথে ইবনে বতুতা যে পথ দিয়ে মক্কা গিয়েছিলেন, তা ছিল সে যুগে মক্কা যাবার সর্বাধিক নিরাপদ পথ।

তখনকার দিনে কাফেলার সাথে না গিয়ে, একা যাবার কথা কল্পনাও করা যেতো না। তাহলে পথ হারাবার অথবা ডাকাতের কবলে পরে নিঃস্ব হবার সম্ভাবনা ছিল অনস্বীকার্য।

যে ব্যাক্তির হজ্জের নেশা হয়, সে কোন এক অদ্ভুত আকর্ষণে বার বার মক্কায় ফিরে ফিরে আসে। ইবনে বতুতাও ছিলেন সেই নেশাগ্রস্ত মানুষদের একজন। তিনি প্রথমবার হজ্জ সম্পাদন করার পর একবছর আরবেই রয়ে যান। তারপর শুরু করেন বিশ্ব ভ্রমন। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করার ফাঁকে ফাঁকে আরও দুবার হজ্জ করেন। সবশেষে চতুর্থ বার হজ্জ করে তিন দশক পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

ঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁ ঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁ ঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁ ঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁ ঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁঁ

প্রাচীন কালের ঘাত প্রতিঘাত পূর্ণ হজ্জ যাত্রা থেকে এবার শত বৎসর পূর্বেকার গল্পে অবতরণ করছি। আমার নানীর মুখে সব সময় তার বাবার হজ্জে যাবার কাহিনী শুনতাম। উনি গত শতাব্দীর প্রথম দিকে, তার বিধবা জমিদার পত্নী বোনের মাহরাম হয়ে হজ্জে গিয়েছিলেন।

তখন অবশ্যই প্লেনের সুবিধা ছিল না। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে সৌদি গমনের সহজতম মাধ্যম ছিল জাহাজে করে যাওয়া। দীর্ঘ ও কষ্টকর যাত্রার কারণে, সংসার-সন্তান পেছনে রেখে, আমাদের দেশ থেকে, সে যুগে মহিলাদের হজ্জে যাওয়ার রীতি একরকম ছিলো না বললেই চলে। হয়তো গুটিকয়েক মহিলা এই সৌভাগ্য অর্জন করতেন। সেই জমিদার পত্নী ছিলেন কতিপয় সৌভাগ্যবানদের একজন।

হজ্জ গমনেচ্ছুগণ, সাধারণত জীবনের সকল হিসাব কিতাব শেষ করে, ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে, সহায় সম্পত্তির দেখ-ভাল, বিশ্বাসী কোন ব্যাক্তিকে বুঝিয়ে দিয়ে, আত্মীয়-স্বজন-পরিচিত সকলের নিকট থেকে ক্ষমা চেয়ে, সকল দেনা পরিশোধ করে, অতঃপর আল্লাহ্‌র ঘরের উদ্ধেশ্যে রওনা দিতেন।

এবং সেই যাত্রা হত অনেকটা অগ্যস্ত যাত্রার ন্যায়। এতোসব কার্যাবলী সম্পন্ন করতে করতে দেখা যেতো তাদের অধিকাংশই পৌঁছে যেতেন, প্রৌঢ়ত্বে অথবা বার্ধক্যে।

আমার নানীর বাবা পরিবারের অন্যান্যদের কাছে স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে, হজ্জ কাফেলার সাথে রওনা হন মক্কার পথে। বাংলাদেশ থেকে তখন জেদ্দাগামী জাহাজ ছাড়তো না। তাই বাঙালীদের প্রথমে বাস/ট্রেনে করে, কলকাতা যেতে হত, তারপর কলকাতা বন্দর থেকে জাহাজে রওনা হতে হতো। পথে পথে বহু বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়ে প্রয়োজনীয় রসদ- পাতি ও পানি সংগ্রহ করা হতো।

এভাবে একাধিক বার যাত্রা বিরতি দিয়ে, প্রায় মাস খানেক পর নৌযান জেদ্দা বন্দরে নোঙর ফেলতো। জেদ্দা থেকে গাড়ি/ বাসে করে মক্কায় যেতেন সবাই। বলা বাহুল্য, পুরো যাত্রায় সামুদ্রিক ঝড় থেকে শুরু করে, মহামারী, সহযাত্রীদের মৃত্যু, ইত্যাদি নানাবিধ বিপদের মুখোমুখি হতে হতো যাত্রীদের।

জাহাজে মহামারী অথবা অন্যান্য কারণে যদি কারো মৃত্যু হত, সেই লাশ চিরাচরিত নিয়মে দাফন করাও সম্ভব হত না। তার ঠাঁই মিলত আত্মীয় পরিজন হতে দূরে কোন এক অচেনা সাগরের অথৈ জলরাশিতে।

আমার মায়ের নানাও সেই পথেই রওনা হয়ে বহু কষ্ট সহ্য করে একসময় মক্কা পৌঁছেন। আমরা এখন যারা মক্কা যাচ্ছি, তারা গাড়িতে, হোটেলে, মসজিদুল হারামে প্রায় সর্বত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় থাকি। সায়ী করি এসির সুশীতল বাতাসে, টাইলস লাগানো মসৃণ মাটিতে।

মসজিদের বাহিরের অংশে নামাজ পড়ার সময় মাথার ওপর ঘুরতে থাকে বিশেষ ফ্যান, যা দ্বারা বাতাসের সাথে সাথে ছেটানো হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা, যেন মসজিদ প্রাঙ্গণের পরিবেশ আরামদায়ক থাকে সবসময়। আমরা মিনার তাঁবুতেও এসি এবং তৈরি খাবার পাই।

অথচ মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও এসি তো দূরে থাক, সকল স্থানে ফ্যানও ছিলনা। মিনাতে তপ্ত মরুভূমির মাঝে, তাঁবু খাঁটিয়ে, নিজ হাতে রান্না করে খেতে হত হুজ্জাজগণকে। ক্রোশের পর ক্রোশ হাঁটতে হত। এককথায়, উনারা যখন হজ্জ করতেন, বর্ণনাতীত সংগ্রামের মাধ্যমে সম্পন্ন করতেন যাবতীয় কাজ।

এদিকে নানির বাপজান যাবার পর একাধিক মাস অতিক্রান্ত হল এবং উনার ফেরত আসার কোন নাম গন্ধ পাওয়া গেলো না। দেশে সকলেই ধরে নিল, হয়তো উনি আর ফিরবেন না। বাবার শোকে আমার নানী তার ছোট ছোট ভাইদের নিয়ে প্রতিদিন বিকালে নিয়ম করে কাঁদতে বসতেন। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দূরহ ছিল, দেশে আত্মীয়দের খবর পৌঁছানো সহজ ছিলনা। কয়েক মাস পর অবশেষে আমার প্রপিতামহ কলকাতা পৌঁছেন এবং শর্ট টেলিগ্রাম পাঠান দেশে, যে তিনি কলকাতা পর্যন্ত এসেছেন।

এই খবরে পরিবারের সকলের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রায় সাড়ে তিনমাস পর উনি দেশে ফেরেন। তখন নানী স্কুলে যেতেন, তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তেন। মেয়েদের জন্য এতদূর পড়াশোনাই বিশাল ব্যাপার ছিল।

বাবা ফেরত এসে কন্যাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেন, কারণ মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে, এরপর রাস্তা দিয়ে স্কুলে গেলে এবং সকলের সাথে পড়াশোনা করলে পর্দা হানী হবে। হাজী সাহেবের মেয়ের নিশ্চয় বেপর্দা চলাচল শোভা পায়না। সে আমলে অল্প বয়সে কন্যা বিবাহ দিতে হত, তাই সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী নানীর সাড়ে দশ বছরের ভেতর বিয়ে হয়ে গেল আমার নানার সাথে।

নানী তার জীবনের শেষ সময়ে এসেও, এইসব গল্প বলতে গেলে শৈশবের সুখ স্মৃতিতে হারিয়ে যেতেন। তার বাবা তার জন্য কি কি নিয়ে এসেছিলেন সেগুলো বলতেন অতি উৎসাহ নিয়ে।

তখন হাজীগণ জম জম কূপের পানি আর খেজুরের পাশা পাশি সামর্থ্য মত অল্প বিস্তর শৌখিন দ্রব্যাদি নিয়ে দেশে ফিরতেন। যেমন, বড় আব্বা তার শিশুকন্যা অর্থাৎ আমার নানীর জন্য এনেছিলেন গলার মালা! যে গলার মালা পাওয়ার আনন্দ স্মৃতি আশি বছরেও ফুরিয়ে যায়নি।

তবে তৎকালীন সমাজে কে কি নিয়ে আসলেন, তার চাইতে বেঁচে ফেরত আসতে পারাই ছিল, পরিবারের নিকট সর্বাধিক আনন্দের বিষয়।

সে অনেক দিন আগের কথা…..
হাসনীন চৌধুরী

জুলাই ২৬, ২০১৯ইং