সূর্য্যি মামা উঁকি মারছেন সবে৷ বকুলতলা মাড়িয়ে বিশ-পঁচিশ জন ক্ষুদে শিক্ষার্থী ছুটে চলছে মক্তবে। তাদের ছুটে চলা পায়ের দুপ দাপ আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠেছে রাস্তাটা। সবাই বুকে জড়িয়ে রেখেছে আমপারা। বেশী ছোটদের হাতে আছে কায়দা।
মসজিদ প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠেছে বাচ্চাদের সুললিত কন্ঠে। উস্তাজের শিখিয়ে দেয়া হরফগুলো সম্মিলিত কন্ঠে উচ্চারণের আওয়াজে এক অদ্ভূদ মায়াবী পরিবেশ রচিত হয়েছে।
বাচ্চাগুলো পড়া শেষ করে বের হবার সময় আবারও সেই হুটোপুটি। বকুল তলায় পায়ের চাপে ফুলগুলো পিষ্ট হবার আগেই কে কত তাজা ফুল তুলে নেবে তারই প্রতিযোগীতা চলে। বুক ভরে শ্বাস নেয় ওরা। আহ! তাজা ফুলের কি মিষ্টি সুবাস!! বাড়ি ফিরে সেসব দিয়ে মালা গাঁথার প্রতিযোগীতা চলে।
শুধু একটি এলাকার দৃশ্য নয়। প্রতিটি মহল্লার একই চিত্র। প্রতিটি মসজিদেই ভোরবেলা মক্তবে বাচ্চাদের কোরান শেখানো হয়৷ আদব-কায়দা শেখানো হয়। কাক ডাকা ভোরে মহল্লার পাঁচ বছর থেকে শুরু করে সব বাচ্চারা নামাজ পড়েই ছোটে মক্তবে। প্রথমে ভুলভাল নামাজ পড়লেও ধীরে ধীরে শিখে যায় ওরা। অভ্যাস গড়ে ওঠে ছোটবেলা থেকেই।
এরপর বাড়ি ফিরে বই নিয়ে বসা। শীতের রোদে পিঠা-চিড়ে আর মুড়ি আর মুড়কি। আর জৈষ্ঠ্যের গরমে আম-কাঁঠাল আর খৈ- মুড়ি। ভীষণ গরমে মাঝে মাঝে পান্তাভাত। রুটি-পরোটা কালে ভদ্রে। আচার আর খিচুড়ির মজাও চাখা হয় বেশ।
স্কুলের মাঠের সেই সাতমিশালীর স্বাদের কি আর তুলনা চলে? আর বজলু কাকার আমসত্ত্ব? পঞ্চাশ পয়সার আইসক্রীম গুলো ভালই মজা। কিন্তু এক টাকায় পাওয়া যায় নারকেল আইসক্রীম। দুধ-নারকোলের মিশেলে সে কি স্বাদ!! আর দুটাকা হলে তো রীতিমত শাহী কুলফি আইসক্রীম। আইসক্রীম কে বলে? সে তো অমৃত!!
টিফিন পিরিওডে খাবার যাচ্ছেতাই কিন্তু আইসক্রীম আর আমসত্ত্ব না হলে কি চলে?
এরপর বুড়িচিঁ আর ছুটোছুটি খেলা। কাঁসার প্লেটে কাঠের ঘন্টার জোর ঢং ঢং আওয়াজ না হওয়া পর্যন্ত ছুটোছুটি খেলা চলতেই থাকে। ঘন্টার আওয়াজে দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়৷ এবার দাঁতভাঙ্গা বিজ্ঞান নয় খটমটে ইংলিশ। অমনোযোগী ছাত্রের হাই তোলার সাথে সাথে শিক্ষকের কানমলা ফ্রি।
স্কুল থেকে ফিরে আছরের নামাজ সেরে, নাকে মুখে দু’টো ভাত গুঁজে দে ছুট মাঠে৷ একদিকে মেয়েদের কানামাছি, অন্যদিকে ছেলেদের ডাংগুলি। ও হ্যাঁ, মাঠের কোণে পবন কাকার চানাচুর মাখা আর গরম গরম বাদাম ভাজার কথা আর নাই বা বললাম। প্রতিদিন তো আর কেনার পয়সা থাকে না। যেদিন বাবাদের খুব মন ভাল থাকে সেদিন দু একটা পঞ্চাশ পয়সা বা একশ পয়সার কয়েন জুটে যায় কপালে৷
হঠাৎ করে আকাশ পথে বিমান উড়ে যায় বিকট শব্দে। খেলা ফেলে সব ছেলে-পুলে হৈ হৈ করতে করতে বিমানের পিছু নেবার চেষ্টা!!!
মাগরিবের আযানের পরে বাড়ি ফিরলে মায়ের হাতের মার আর একটিও মাটিতে পড়বে না। তাই মাগরিবের আগেই আবারও ঘরমুখো একঝাঁক ছানাপোনা। সন্ধ্যের আগেই দোকানে দোকানে কেরোসিন তেল আর দেশলাই- মোমবাতি কেনার হিড়িক। লোডশেডিং হলে হয় কুপি, হারিকেন নয় তো মোম। এই তো ভরসা। তবে লোডশেডিংও মন্দ না। অন্ধকারের সুযোগে মেলে লুকোচুরি খেলার সুবর্ণ সুযোগ।
ছুটির দিনগুলো একটু আলাদা। মেহেদী গাছগুলোর সেদিন ভারি দুঃখ। সব পাতা মেয়েরা ছিঁড়ে নিয়ে যায় যে! পাটায় পিষে হাত রাঙিয়ে চলে হাত দেখা দেখি৷ কার হাত কত লাল হল?!!
মেয়েরা সেলাই আর হস্তশিল্পের প্রতিযোগীতা করত অথবা আচার বানানোর প্রতিযোগীতা হত। লেবুর আচার, আমের আচার, চালতার আচার, বড়ই, জলপাই, তেঁতুল, আমলকীসহ বাদ যেতনা কিছুই। ক’দিন পরপর পোস্টমাস্টার বাবু সাইকেলের ঘন্টা বাজিয়ে খাকী খামবন্দী প্রিয়জনের বার্তা নিয়ে হাজির। সেই খাম ঘিরে সবার উৎসুক অপেক্ষা। না জানি কি লেখা আছে তাতে? আসে সুখ-দুঃখের নানা সংবাদ।
কখনও চিঠি পড়ে মায়েদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে আবার কখনও অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে চোখ। এবার সেই চিঠির জবাবে ফিরতি চিঠি লেখা আর স্কুলে যাবার সময় ডাকবাক্সে সেটা ফেলে যাওয়া। বিকেলে কালে-ভদ্রে ঘন্টার ঝুনঝুন আওয়াজে ক্ষুদে সোনাদের ছুটে বেরুনো৷ সুদৃশ্য চারকোণা স্বচ্ছ কাঁচের বাক্সে হাওয়াই মিঠাই তো নয় যেন গোলাপী স্বপ্ন! হাতে নিতে না নিতেই নিমেষে মিলিয়ে যায়!!
এক পিস চার আনা। চার পিস এক টাকা। মুখে দেবার সাথে সাথে কোথায় যে হারায়!! শুধু গোলাপী রং আর মিষ্টি স্বাদটুকু লেগে থাকে জিহ্বাজুড়ে।
আষাঢ়-শ্রাবণে ঘোর বর্ষা৷ লাগাতার ঝুম বৃষ্টি। ঘ্যাঙ্গর ঘ্যাং ব্যাঙের ডাক আর কদম ফুলের সেই বৃষ্টিমুখর দিনে ঘর থেকে বেরোনো দায়। ঘরে বসেই চলে চালভাজা, চানাচুর, মুড়ি আর ভুনা খিচুরির আড্ডা। সাথে ডিমের সালুন৷ বাজার ঘাটের রাস্তা বন্ধ কিনা!
কাগজের ঘর বানিয়ে চোর-পুলিশ আর সাপ-লুডু খেলাই এ কয়দিনের সঙ্গী৷ আর আছে বই। কাঁথার ভেতরে শুয়ে মজার মজার গল্প পড়া৷ রাস্তা ঘাট সব থৈ থৈ পানিতে ডুবুডুবু নয়তো কাঁদায় পিচ্ছিল। লাগাতার বৃষ্টি শেষে শহরের বড় ব্রীজে পানি দেখতে যাবার ঢল৷ কাগজের নৌকা বানিয়ে সেই পানিতে ভাসিয়ে দেয়া!
রামাদ্বান আর ঈদ জুড়ে উৎসবের আমেজ। ছোট থেকে ছোট বাচ্চাটিরও নামাজ রোজার প্রতিযোগীতায় লেগে যাওয়া। সাথে রয়েছে বাবা-মা সহ বড়দের উৎসাহ। সবচাইতে সুন্দর মুহূর্ত ইফতার বিলি করার সময়। পাড়ার প্রতিটি ঘর থেকেই কোন না কোন দিন ইফতার বিলি করা হয়ে থাকে।
ঈদের আগে ঈদকার্ড কেনার হিড়িক৷ মনের কথা নানা রকম ছন্দে সাজিয়ে গুছিয়ে সমবয়সীদের হাতে পৌঁছে দেয়া৷ ঈদের কাপড় লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। ঘূর্ণাক্ষরেও যাতে কেউ টের না পায়! নইলে পুরাতন হয়ে যাবে যে!!
ঈদের নামাজ সেরে সবার কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখ করা। সবার বাসায় খেতে আর খাওয়াতেই দিন কাবার।
ফুড়ুৎ করে কিভাবে যেন কেটে যায় স্বপ্নের ঈদ! রাত পোহালেই আফসোস! আহারে, ঈদ শেষ!!!
ও পাড়ার রতনের জন্য সালিশ ডাকা হল। তার অপরাধ? আকিজ বিড়িতে দু’টো টান দিয়েছে৷ সেটা হেডমাস্টার মশায় দেখে ফেলেছে। ও পাড়া ছাপিয়ে এ পাড়া পর্যন্ত ছিঃ ছিঃ রটে গেল। পরদিন হেডমাস্টারের হাত ধরে রতনের বাবা বলে গেল—“আপনাকে দিলাম। দোষ-ত্রুটি পেলে চামড়া গোস্তের খোঁজ নেবনা। হাড় ক’টা ফিরিয়ে দিলেই হবে।“
ব্যস, রতন বাবাজী সোজা। বিড়ি টানার সাধ তার শেষ। আরেকদিন বাদল কার বরই গাছে যেন ঢিল ছুঁড়েছে। সেটা দেখলেন বদরুল আলম স্যার। কান ধরে এক পায়ে স্কুলের টানা বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন দু’ঘন্টা। সবাই যায় আর দাঁত বের করে হাসে।
কি বাবা বাদল? অন্যের গাছে ঢিল ছোঁড়া? যাবি ফের?
তওবা, নাক খপ্তা!!
কারও কোন দোষ প্রকাশ পেলে মায়েরা ছেলে মেয়েদের তাই বলে লজ্জা দিত। অমুকের মত হবি? দেখিস তোরও তেমনি পানিশমেন্ট হবে। খুব ভাল হবে তাইনা? ব্যস, কেল্লা ফতে!
সেদিন পাড়ায় এক আমেরিকান বাবু এল। তার হাতে কালো আর লম্বামত এক জিনিস। সেটা কানে ঠেকিয়ে আবার হেসে হেসে কথাও বলে বাবু। জ্বিন ভূত আছে নাকি বাপু সাথে?! তার -তুর কিছু নেই ওটা আবার কি জিনিস? দূরের মানুষদের সাথে টেলিফোনে কথা বলা যায় কিন্তু সেটাতে তো অনেক তার লাগে৷ তার ছাড়াও আবার কথা বলা যায়?!! আজব ব্যাপার!
সেই বাবু আবার বলে, খুব তাড়াতাড়ি মানুষ কম্পিউটারে দূরের মানুষকে দেখতেও পাবে!
সত্যিই কি এমন হবে নাকি আবার???!!!
যাঃ তাই হয় নাকি? এ যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী!!
একটি অবৈজ্ঞানিক সত্যকাহিনী
জাকিয়া সিদ্দিকী
জুলাই ০৭, ২০১৯ইং