১
ঠিক যেমনটা কল্পনা করেছিল, ঠিক তেমনটাই যেন আজরার স্বপ্নপুরুষ – আনন্দ। প্রথমে দেখেই মনে হয়েছে – এই সে যাকে খুঁজে পায়নি এতদিন। বিপাশা, আনন্দর ছোটবোন; আজরার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী; এভাবেই পরিচয়।
স্বপ্নপুরুষ বলে কথা; আনন্দর সবকিছুই স্বপ্নিল মনে হয় আজরার। ওর তাকানো, কথা বলার ধরন, পছন্দ-অপছন্দ সব! ঐদিনতো মনে হয়েছিল আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে ; যেদিন আনন্দ ওকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল।
শুরু হলো কথা বার্তা। খুব ভদ্র আর সৌম্য ছেলেটা। পড়াশোনাতেও খুব ভালো। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আর আজরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষ। খুব ভালো ক্রিকেট খেলে; অসম্ভব সুন্দর গানের গলা। কোনোদিক দিয়ে খারাপ বলার কোনো উপায় নাই।
দিন যতই যায় আজরার যেন আরো হাবুডুবু অবস্থা। এরই মধ্যে ওদের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। এটাকে ঠিক প্রেম বলা যায় না আবার কেমন জানি প্রেম প্রেম ভাব। আজরা আবার একটু অন্যরকম মেয়ে। অনেক ভালো লাগলেও কোন ছেলেকে গিয়ে সেটা বলবে সেরকম নয়।
আনন্দ জানায় ও প্রায় আজরাকে মিসড কল দিবে এতে তার কোনো আপত্তি আছে কি না। স্বাভাবিক ভাবেই আজরা বারণ করে না। চলতে থাকে প্রায়ই মিসড কল মিসড কল খেলা। ভালোই লাগে আজরার। মনে মনে ভাবে বলে দিলেই হয়! এতো ইঙ্গিত না দিয়ে।
একদিন আনন্দ কল করে বলে ওদের ইউনিভার্সিটির খেলার মাঠে যেতে; ওদের বলে একটা ম্যাচ আছে আর আনন্দ চায় আজরা যেন দেখতে আসে। খুব লজ্জা লজ্জা লাগছিলো আজরার, একে তো নিজের ভার্সিটি না এর উপর বান্ধবীর বড় ভাইয়ের খেলা। কেমন কেমন জানি শোনায়। বিপাশা কে সাথে নিয়ে যায় খেলা দেখতে।
তবে গ্যালারিতে অল্প কিছু সংখ্যক ছেলে ছাড়া আর কোনো মেয়ে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ দুইটা মেয়েকে আসতে দেখে গ্যালারি ও মাঠের সবার দৃষ্টি যেন এদিকটায় আটকে গেল! বিপাশা কে সবাই চেনে কারণ ও আনন্দের বোন কিন্তু এই আগন্তুককে কেউ চেনেনা তাই উৎসাহ যেন আরো একডিগ্রী বেশি।
আধুনিক হলেও আজরার সেদিন ওই দৃষ্টি গুলো ভালো লাগে নি। যদিও আনন্দ একবার এসে ওর দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির হাসি হেসে গেছে। কিন্তু আজরা বেশিক্ষন বসতে পারেনি। সর্বসাকুল্যে ১৫ মিনিট বসেই বিপাশাকে অনুরোধ করে চলে এসেছে। আনন্দের কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগে নি। সন্ধ্যায় কল করে জিজ্ঞেস করেছে
– ” চলে আসলা যে আজকে ? “
-” আসলে ভাইয়া! এতগুলা ছেলে যেভাবে তাকিয়ে ছিল খুবই অস্বস্তি লাগছিলো। “
আজরা ভেবেছিলো ওর এই কথা শুনে আনন্দ খুশি হবে। বুঝবে, মেয়েটা ভদ্র, নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে চায়। কিন্তু আজরা কে অবাক করে দিয়ে আনন্দ বলল:
-” কেন? এর আগে কি কখনও এরকম চাহনি দেখ নাই ?” বলেই কলটা কেটে দিলো!
আনন্দ রাগ করেছে দেখে অস্থির হয়ে উঠলো আজরা। সাথে সাথে আবারো কল করে ক্ষমা চাইলো। আনন্দ যেন সেটার অপেক্ষাতেই ছিল।
২
বিপাশাদের বাসায় ছোটখাট প্রয়োজনেও যাওয়া শুরু করেছে আজরা। আজকাল অনেক জায়গায় ঘুরে, বিপাশা, আজরা আর সাথে থাকে আনন্দ। আনন্দের কিছু বন্ধু বান্ধবদের সাথেও আলাপ করিয়ে দেয় আজরার। আজরা মনে মনে খুশি হয়। একদিন আনন্দ কল করে বলে
-“জানো আজরা। নকিব বলেছে তুমি অনেক কিউট!”
কি বলবে বুঝতে পারছিলো না আজরা। কিন্তু অপ্রস্তুত পরিস্থিতি সামলাতে বলল :
” শুধু ওনারই কিউট লাগলো ? তাও ভালো আপনি জানালেন।”
বলেই খুব লজ্জিত হলো। আজরা কিউট না কি আনন্দ বন্ধুদের কাছে ভোটাভোটি করছে? মনের কোথায় খুব অভিমান হলো !
আনন্দের মিসড কল এ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে যেন আজরা। মিসড কল লিস্টে এই নামটা দেখলেই খুশি হয়ে যায়। ও মিসড কল এর রিপ্লাই মিসড কল দিয়েই দেয়। খুব ইনোসেন্ট একটা সম্পর্ক ভাবে আজরা। হ্যাঁ, ভালোবাসে, কিন্তু ও বলবে না। মেয়েরা বলে নাকি! এসব ছেলেদেরই কাজ।
একদিন রাত ১ টায় ফোন বেজে ওঠে আজরার। ও ভাবে মিসড কল, কিন্তু না ফোন বেজেই যাচ্ছে! কি ব্যাপার এতো রাতে আনন্দের কল?
ফোন ধরে আজরা
“হ্যালো কী ব্যাপার ভাইয়া ? এতো রাতে ?”
-” ঘুমিয়ে পড়েছিলা?”
-“অবশ্যই।”
– “ও ! তাহলে রিয়েলি সরি”
-“না ঠিক আছে ভাইয়া। কালকে সকালে কথা হবে। “
দুইজন শুভরাত্রি বলে বিদায় নিলো। আজরা এসব পছন্দ করে না। কী এমন দরকার যে এতো রাতে কল করতে হবে। বুদ্ধিসুদ্ধি নাই ছেলেটার। আঁতেল টাইপ তো!
৩
ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল চলছে তাই ফেসবুক বন্ধ। মিসড কল চলছে। আজরার মনে হতো জীবনটা অনেক সুন্দর। ওদের ভালোবাসার প্রকাশ টাও খুব কিউট। কিন্তু কেন যে বলছে না! এর মধ্যে একদিন বিপাশা বলল, “আজরা তুই আমার ভাবী হলে আমি যে কি খুশি হবো। বল না তোর কি কোনো সমস্যা আছে?” আজরা লাজুক হয়ে বলেছিলো
-” ফাজলামো করিস না। ফাইনাল পরীক্ষায় মন দে। “
আজরা ভাবলো এতো যখন দরদ সরাসরি বললে কী হয় ?
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। বেশ কিছুদিন আনন্দ মিসড কল দিচ্ছে না। তাই আজরাই দিলো। সাথে সাথে মিসড কল ব্যাক। আজরার মন ভালো হয়ে যায় কল লিস্টে আনন্দের নামটা দেখলেই!
৪
হঠাৎ একদিন বিপাশা জানালো আনন্দ ওর ইউনিভার্সিটির এক জুনিয়র মেয়ে কে প্রেম নিবেদন করেছে। কিন্তু মেয়েটা কোনো উত্তর দেয় নাই!
কথাটা শুনে আজরার মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। নিজের বাঁধভাঙা কান্না অনেক কষ্টে আটকিয়ে বিপাশার কাছ থেকে কোনোমতে বিদায় নিয়ে বাড়িতে ফিরে খুব কাঁদলো। আনন্দের দুইটা মিসড কল মোবাইলে। দেখে ফোন টা বন্ধ করে রাখলো।
প্রায় ১ মাস পর আনন্দের সাথে ওদের বাসায় দেখা। জানতে পারলো ঐ মেয়ে হ্যাঁ বলেছে। কিছুই প্রকাশ হতে দিলো না আজরা। কিন্তু মনের ভিতর প্রশ্নের ঝড়। যদি পছন্দ নাই করতো তাহলে ওর সাথে এতদিন অনেক কথা হয়েছে তা কেন হয়েছে? রাস্তা পার করার নামে একবার আজরার হাত ধরেছিল, যদিও রাস্তায় কোনো ট্রাফিক ছিল না! ওর কাছে তো সবই ইঙ্গিতপূর্ণ মনে হয়েছিল!
অপেক্ষা করছিলো আনন্দের কাছ থেকে মনের ইচ্ছা টা প্রকাশ পাবার! কিন্তু এ কী হলো? এখন নিজেকে মনে মনে দোষারোপ করছে। তাহলে কী ওর আগেই জানিয়ে দেয়া দরকার ছিল? বিপাশাকেও কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু বিপাশা কিছুটা বুঝতে পেরেছিলো। একদিন বলেই ফেলল
” আচ্ছা ! তুই কি ভাইয়াকে কিছু উল্টাপাল্টা বলেছিলি?”
-” কই না তো ! “
-” তাহলে হঠাৎ তুন্নির পিছে পড়লো কেন ? “
– “আশ্চর্য ! ওনার ভালো লেগেছে তাই! আর আমি কি তোর ভাইয়ের সাথে প্রেম করতাম নাকি?” কথাটা বলতে গিয়ে নিজের প্রতারণায় নিজেই কষ্ট পাচ্ছিলো আজরা।
বিপাশা বলেই চলল, “তুন্নি মেয়েটা যে স্মার্ট ! তুই একটু ঐভাবে চললেই হতো! তাহলে তোকে আমার ভাবি বানাবার ইচ্ছাটা পূরণ হয়ে যেত।” বলেই হো হো করে হেসে উঠলো।
আজরার খুবই মেজাজ খারাপ হলো। ও তার মানে স্মার্ট না! স্মার্টনেস এর ডেফিনেশন কী তাহলে আনন্দের কাছে? কী অমন ঐ তুন্নি? একবার দেখতেই হচ্ছে। বিপাশা কে আবারো মিথ্যা কথা বলল
-“ধুর ! আমি তোর ভাবী হতে যাবো কোন দুঃখে। তবে তোর ভাইয়ার তুন্নি কে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। একবার দেখা করে দিস তো।”
বিপাশাও রাজি হয়ে গেলো।
দিনক্ষণ ঠিক করে বিপাশার সাথে আজরা দেখা করতে গেলো তুন্নির সাথে। আজরার দেখা হলো একজন উগ্র, সুন্দরী ও লাস্যময়ী রমণীর। আজরা ভেবে অবাক হলো যাকে ও এতো ভদ্র, সৌম্য ভাবতো, যাকে ভাবতো স্বপ্নপুরুষ তার কাছে পছন্দনীয় এরকম খোলামেলা পোশাকের সো কল্ড “স্মার্ট” মেয়ে!! এরকম কী আজরা হতে পারে না! নিজেকে বদলে ফেললে কি আনন্দ আবার……
৫
অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারেনি আজরা। হতাশায় যখন মুশরে পড়েছিল তখন ইউটিউবে ড. জাকির নায়েকের লেকচার চোখে পড়লো। অনুপ্রাণিত হয়ে কোরআন ও তার তাফসীর পড়া শুরু করেছে নোট করে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াও শুরু করেছে। ভাবছে আল্লাহ চাইলে হিজাব ও স্টার্ট করে দিবে। এবার ওর বদলাতে কষ্ট হচ্ছে না। কেন জানি বদলানোর জন্য আলাদা করে তৃপ্তি পাচ্ছে।
এরই মধ্যে আনন্দ আবারো মিসড কল দেয়া শুরু করেছে। আজরা অনুভব করলো আগে যেমন আনন্দের নম্বর কল লিস্টে দেখলে শিহরিত হতো , এখন আর তা হচ্ছে না। ও এখন নিশ্চিত আনন্দ কখনোই ওর স্বপ্নপুরুষ ছিল না। বিপাশার কাছে জেনেছে আনন্দ কিভাবে তার বান্ধবীর সাথে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হবার বর্ণনা তার বোন ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে।
কি মারাত্মক ভুলই না করতে যাচ্ছিলো আজরা! একটা মানুষকে চেনা কত কঠিন ! এত ভদ্র একটা ছেলে কি না…..
আজরা ভাবে ও তো কখনোই কারো সাথে প্রেম করে নাই। মাথায় আজেবাজে চিন্তা উঁকি দিতেও দেয় নাই। আনন্দকে এতটা ভালোবাসার পরও নিজের মর্যাদাহানী হয় এমন কিছু বলে নাই , করে নাই , সুযোগ ও দেয় নাই। এরজন্যই মনে হয় আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছেন। আনন্দের নাম্বার টা ব্লক করে দিয়েছে নির্দ্বিধায়।
৬
দুই বছর পর একজন ধার্মিক, আল্লাহ ভীরু মানুষকে বিয়ে করে আজরা। নিজেও পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু এবার সে অন্য কারো জন্য নয় বরং আল্লাহের জন্য পরিবর্তিত হয়।
বিপাশা, আজরার সাথে সম্পর্ক চ্যুত করে। কারণ সব সহ্য করা যায় কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড হুজুর হয়ে যাওয়া ওর একেবারেই ভালো লাগে না। বিপাশা বলেই ফেলে “নিজের জীবনটাকে ধ্বংস করে দিলি। এতো ব্রাইট একটা মেয়ে কাপড় মুড়ি দিয়ে নিজের সব সম্ভাবনার দরজাকে বন্ধ করে দিলি। দ্যাখ কয়দিন ভালো লাগবে এই অসহ্য জীবন।”
কিন্তু যখন দেখে আজরা আগের থেকে অনেক বেশি সন্তুষ্ট জীবন নিয়ে তখন কোন এক অজানা কারণে নিজেকে সরিয়ে ফেলে বিপাশা। আজরা ওর প্রস্থানে কষ্ট পেলেও হিদায়াতের দুআ করে।
অনেক বছর পর খবর পায় আনন্দ বিয়ে করে নাই। আজরার শোকে না! বরং আজ এই মেয়ে তো কাল ঐ মেয়ে করে দিনাতিপাত করছে।
আজরার মুখে শুধু “আলহামদুলিল্লাহ” আর মাথায় সুরাহ নূরের তিন নম্বর আয়াত,
” ব্যভিচারী বিয়ে করে না ব্যভিচারিণী বা মুশরিকা ছাড়া। আর ব্যভিচারিণী তাকে বিয়ে করে না ব্যভিচারী বা মুশরিক পুরুষ ছাড়া, মুমিনদের জন্য এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।”
মিসড কল
বিনতে আমান
জুন ২৭, ২০১৯ইং