এ বাড়িতে প্রথম এসেছিলাম একটি বিশেষ উৎসবের দিনে। ফুলেল ডিজাইন করা বাক্সে, গোলাপি স্যাটিনে মুড়ে। কিন্তু এ বাড়ি থেকে বিদায়ের দিনটিও যে ওই একই উৎসবের দিনই হবে এ কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।
গোলাপি স্যাটিন সরাতেই আমার সুন্দর সোনালী গিলটি করা কারুকাজ যে ওর মন কেড়ে নিলো বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমাকে পছন্দ করেছিল ও। পরবর্তীতে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর মনের ভাব কিভাবে যেন বুঝতে পারতাম আমি। কি ভাবছে ,কি চলছে ওর মনের মধ্যে, সঅব। সত্যিই এ এক আশ্চর্য যোগ।
অতিথিটি সেই প্রথম এসেছিলেন ওঁদের বাসাতে, ঈদ এর দাওয়াতে। পশ ঘরানার অতিথি , সাথে পশ প্যাকেজে আমি। এ ঘরের ঘরণীর আবার বাহারি জিনিসের শখ নেই বললেই চলে। ওগুলোকে বাতুলতা মনে করেই চলেন উনি। কিন্তু এ যে নিতান্ত অনাসক্তি নয় , বরং সন্তৰ্পন প্ৰচেষ্টা আসক্তি এড়ানোর , তা বুঝেছিলাম পরে।
ওদের ছোট্ট পরিবারটিকে দেখতাম ওপর থেকে। পাখির চোখে।
ডাইনিং রুমের সাথে লাগোয়া ছাদ ছোঁয়া তিনটি সুন্দর তাক। ওরই ওপরতলায় আরও কিছু শৌখিনতার পাশে ঠাঁই হলো আমার, সযতনে।
আস্তে অস্তের সবার সাথে পরিচয় হলো। জাপানি ফুলদানি, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছোট মামা দিয়েছেন। ক্রিস্টাল মোমবাতিদানি, বান্ধবীর পাঠানো । আমাদের নিচের তাকেই ওভেন ভাই। আর পাশেই পরিপাটি রান্নাঘর।
জায়গাটা বেশ যুৎসই , ১৮০ ডিগ্রি ভিউয়ে কিচেন ,ডাইনিং আর লিভিং স্পেসের অনেখানি দেখা যায়।
কত দিবা, নিশি , ভোর , দুপুর, বিকালের নীরব সাক্ষী এই আমি ।
ছোট্টমনিকে নিয়ে দেখতাম ওর চরম স্ট্রাগল। এই ছেড়ে এলো খেলনার কাছে তো মুহূর্তের মধ্যেই পায়ের কাছে বেড়ালছানা হাজির। কোলে না উঠা পর্যন্ত ম্যাও ম্যাও করতেই থাকবেন। বেলা শেষে তাই দেখা যেত একপদই রাধা হয়েছে। তাতেও বিরক্তি নেই বিবির , আর ওই একপদ দিয়ে ভাত খেয়ে মিঞারও।
আর যেদিন অনেকখানি হাত পুড়িয়ে ফেললো ও । কার্পেটে বসে কাঁদছিলো। আহ কি যে মায়া লাগছিলো। উপায় থাকতো তো একটুখানি হাত বুলিয়ে দিতাম।
আবার বিকেল বেলা গ্যারেজ খোলার আওয়াজ পেলেই ছোট্টমনির ছুটে যাওয়া , ‘বাবা এসেসে , বাবা এসেসে’ করে , ও ও অমনি হাতের সব কাজ ফেলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে এগিয়ে যায় , হয়ে যায় ছোট্ট ফ্যামিলি হাগ্। এ সব তো আমার চোখের সামনেই দেখা।
ভালো লাগতো না কেবল রান্নার গন্ধগুলি। শুঁটকি যেদিন হতো , ব্যাপারে বাপ্। ৩ দিন পর্যন্ত নাক টানার জো নেই।
‘শুনছো ,শুঁটকি শেষ হয়ে গেছে , বাংলা দোকান থেকে আনতে হবে আবার।” শুনে জাপানি ফুলদানিকে বললাম ‘আলহামদুলিল্লাহ পড়েন।’
রামাদানটা ভালো যেত। খাবার দাবারের উৎকট গন্ধ গুলি অনেক কম থাকতো।
এরা সবকিছুতেই বাতুলতা পরিহার করে চলে। ওভেন ভাইয়ের পাশেই আমাদের নিচের তলায় বাজতো কুরআন। আমরা সবাই মাইল তন্ময় হয়ে শুনতাম। ওই শুনতে শুনতে ওর রান্না , বাসন ধোয়ার কাজ চলতে থাকতো। কখনও কখনও ছেড়ে দিতো বলিষ্ঠ কণ্ঠের ওয়াজ। ওহ কি শিহরণ জাগানো সেইসব ওয়াজ।
তবে সবচে ভালো লাগতো ও নিজে যখন কুরআন নিয়ে বসতো , মিহি কণ্ঠের সুরেলা তিলাওয়াত , কি মিষ্টি আওয়াজ। একটুখানি পড়তো আর অনেকখানি ভাবতো। ভাবতে ভাবতে কোথায় যে হারিয়ে যেত। এই হাসছে , তো এই কাঁদছে। হঠাৎ ওর তাকিয়ে থাকা দেখে ভাবতাম আমার দিকেই দেখছে বুঝি। লজ্জা পেয়ে যেতাম। পরে বুঝতাম আমার দিকে না , ও আসলে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছে।
ঈদ আসার আগে আগে শুরু হতো বেস্ট টাইম। স্প্রিং ক্লিনিং!
ওই একবারই অত উঁচুতলা থেকে নামা হতো আমার । খুব সযতনে মুছে , স্প্রে ক্লিন করে আবার রেখে দিতো সাবধানে। মনে হতো একদম ফ্রেশ স্পা করলাম যেন!
কিন্তু জাপানি ফুলদানিকে আর রাখা হতো না। ঈদের দিন ওই একটা ব্যাপারেই ভীষণ হিংসে হতো। আর কোনো শৌখিনতা না থাকলেও ফুল কিনতে খুব ভালোবাসতো আমাদের গৃহকর্ত্রী । আর সেই সতেজ , সুরভিত ফুল নিয়ে জাপানি ফুলদানি থাকতো ঈদ টেবিলের মধ্যমনি হয়ে । মেহমানদের সে কি প্রশংসা ! সবই দেখতাম এখান থেকে। পাখির চোখে।
সেবার ঈদে ওর কি যে মনে হলো। আমাকে নামালো। নামানোর আগের ইতস্তত ভাবটুকু আমার চোখ এড়ালো না। ভয় পাচ্ছিলো ও। কিসের যেন ভয়।
ব্রাউনি বেক করেছিলো অনেক। ইজি জব আবার বাচ্চারাও পছন্দ করে। মখমলের মতো মোলায়েম চকোলেট ব্রাউনি নিয়ে অভিজাত এই আমি এই প্রথম হলাম ঈদ টেবিলের সেন্টারপিস। বাচ্চারা সব হুমড়ি খেয়ে পড়লো। জাপানি ফুলদানির মত ঢাউস না হলেও আমার গড়নও কিছু কম সুন্দর নয়। সোনালী কারুকাজ করা তিন স্তরের পরিবেশন ট্রে আমি , মাঝের ফুলেল আংটাটা সবার নজর কাড়তে বাধ্য। চারপাশে ওর রুচির প্রশংসা আর স্তুতির বন্যা বয়ে যেতে লাগলো।
কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ও মরমে মরে যাচ্ছিলো। ভিতরে ভিতরে আস্তাগফিরুল্লাহ আর আউযুবিল্লাহ পড়েই যাচ্ছিলো। শো অফ হয়ে যাচ্ছে না তো আবার ! আসলে ঈদ এর আয়োজন তো করে সবাই একসাথে হওয়ার জন্য , দাওয়াতী কাজ হিসেবে আর বাচ্চাটাকে হালাল উৎসবের আমেজ দেয়ার নিয়তে । ওর বড় মূল্যবান কয়েকটি নিয়ত । যা বার বার ধুয়ে মুছে ও পরিষ্কার করে চলে। “ইন্না সলাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়া ইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন পড়ে।
ও কত বাহারি পদ রাঁধতে পারে , কত বাহারি ক্রোকারিজ ওর আছে এই সব ধুলো জঞ্জাল ভাবনা যেন কখনো মলিন করতে পারেনা ওর যত্নের নিয়ত সে ব্যাপারে সদা তৎপর থাকে।
তীক্ষ্ণ কাঁচ ভাঙার আওয়াজে ভাবনার মায়াজাল ছুটে যায় ওর। বিস্ফোরিত নেত্রে দেখে ওর সাধের এই আমি পড়ে আছি টুকরো টুকরো হয়ে। সারা ঘরময় ছিটিয়ে আছে আমার গিলটি করা সোনালী অংশ আর মোলায়েম ব্রাউনি। বড় চঞ্চল ছেলেটা ওর এ কাজটি করেছে , তাড়াহুড়ো করে ব্রাউনি নিতে গিয়ে। রিফ্লেক্স এর মতো একটা চড় দেয়ার জন্য যেন হাত উঠে। পরক্ষনেই প্রচন্ড এ ইচ্ছাকে দমন করে ও। বলে আলহামদুলিল্লাহ। ইন্নালিল্লাহ।
এভাবেই শিখিয়েছিলো ওর বান্ধবী মিলি । কোনো বিপদ ঘটলে প্রথমে আলহামদুল্লিল্লাহ বলতে , তারপর ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন দুয়াটা পড়তে।
মেহমানদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। কেউ চুক চুক করে আহারে করছে , কেউ বিরক্ত হয়েছে , কেউ বাচ্চাদের সরিয়ে রাখছে যাতে কাঁচ পায়ে না বিঁধে। শোরগোল নীরবে পাশ কাটিয়ে একটা একটা করে আমার অংশ গুলো তুলে নিলো ও। এবার আমি চলে যাব বিন এ। তারপর গার্বেজ ট্রাক এ , তারপর অনেক দূরে রিসাইকলিং সেন্টারে।
এ জীবনের জন্য দেখা এখানেই শেষ। ছোট্ট এ জীবনে এক অসাধারণ মানুষের সান্নিধ্যে কিছুকাল কাটিয়েছিলাম এইটুকুই আমার পাওয়া।
শেষবারের মতো ডাস্ট প্যানে লেগে থাকা আমার ধ্বংসাবশেষের তাকিয়ে দেখলো ও। চোখে ব্যাথাময় চাহনি। ব্যাস বন্ধ হয়ে গেলো বিনের ঢাকনা ।
এভাবে যেমন করে এক ঈদের দিনে এসেছিলাম , সেভাবেই চলে গেলাম আরেক ঈদের দিনে। তবে হ্যাঁ , পাখির চোখে আমার দেখা ওর প্রতিটি ভালো কাজের সাক্ষী আমি। যদি ওর কখনো সাক্ষীর প্রয়োজন হয় আমি হবো সেই সাক্ষী। এ প্রয়োজনটুকু তো সবারই হতে পারে একদিন । না ?
ঈদ মুবারক
উম্ম ঈসা
জুন ০৫, ২০১৯ইং