উদহিয়া

-শাবনাজ রাফনী
কিছু দুনিয়াবি জিনিসের প্রতি আমার ভীষণ দুর্বলতা। কালো স্করপিও গাড়ী, অ্যাপাচে রেড বাইক, অ্যারবিয়ান হর্স এবং ছাগল। জ্বি ছাগলই বলেছি। ছাগল, ভেড়া জাতীয় প্রাণীগুলো আমাকে ভীষণ টানে। পোষার জন্য ঠিক না। কুরবানীর জন্য।

যত সুন্দর গরু হোক, প্রাইস যতই অ্যাফোর্ডেবল হোক আমার ছাগল-ভেড়াই পছন্দ। সুঠাম, শিং ওয়ালা। রাস্তায় চলতে চলতে কোন সুন্দর সুঠাম ভেড়া-ছাগল দেখলেই আমার মনে হত ইশ! এটাকে যদি ঈদের সময় কুরবানী করতে পারতাম! সবথেকে সুন্দর পশুটাকে যদি আমার রব্বের জন্য উৎসর্গ করতে পারতাম! আল্লাহ যদি কবুল করতেন! উনি যদি খুশি হতেন যে আমার বান্দী আমার সন্তুষ্টির জন্য সবচেয়ে সুন্দর পশুটা খুঁজে খুঁজে বের করেছে। ইশ! আমার কুরবানীটা যদি কবুল হত!

প্রোডাকশনের কাজ হয় যে গার্মেন্টসে সেটা একটা হিন্দু-পাড়ার মাঝে অবস্থিত। কাজের তদারকির জন্য প্রতি মাসে বেশ কয়েকবার আমাকে যেতে হয়। পুরো এলাকাটা হিন্দু অধ্যুষিত। গার্মেন্টসের সামনে বিশাল কালী মন্দির। আশেপাশের ৯৫% বাড়ী হিন্দুদের। নামাজের সময় ওজু করার জন্য কয়েকবার গিয়েছি এর ওর বাড়ী। ওরা ছাগল পোষে। যতবারই দেখতাম তাকিয়ে থাকতাম। ছাগল তো নয় যেন ঘোড়ার বাচ্চা। এত্ত সুঠাম, এত্ত সুন্দর, মাশা’আল্লাহ।

এবারের কুরবানী ওদের ওখান থেকেই কিনব বলে ঠিক করেছিলাম। ছাগলের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা দেখে গার্মেন্টসের ম্যানেজার অনুমতি নিয়ে একটা প্রশ্ন করেই বসলেন,

“আপনার ছাগলের প্রতি বিশেষ দুর্বলতার কারণ কি?”

আমি ওনাকে সঠিক কোন জবাব দিতে পারিনি। পরে নিজে অনেক্ষণ চিন্তা করে দেখলাম যে, আমার বরাবরই ইচ্ছা আমার সাধ্যের মধ্যে সবথেকে সুন্দর পশুটা কুরবানী করা। কিন্তু সবথেকে সুন্দর গরুটা কেনার সামর্থ্য আমার নেই। এজন্য আমি চেয়েছি আমার যতটুকু সাধ্য এরমধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ছাগলটা কিনে ফেলতে।

আচ্ছা সবথেকে সুন্দর ছাগল কিনলেই কি কুরবানী কবুল হবে?

নাহ। এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেনা। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর ছাগলটার খুঁজে পাওয়ার জন্য আমার যে প্রচেষ্টা সেটা নিশ্চই আমার রব্ব দেখবেন। দয়া করে যদি কবুল করে নেন!

……………..

গতকাল সন্ধ্যায় তাকে সিএঞ্জি থেকে নামানো হল। আমি ভয়ে ভয়ে দড়িটা ধরলাম। প্রচন্ড শক্তি তার। একেবারেই অবাধ্য। মাথায় হাত দিতে চাইলাম, মাথা সরিয়ে নিল। আশ্চর্য। এর আগে এমনটা কখনও হয় নি। বিসমিল্লাহ বলে মাথায় হাত দিলেই পশুগুলো শান্ত হয়ে যেত। ওকে গ্যারেজে নিয়ে আসলাম। আরও কয়েকবার চেষ্টা করলাম মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। মাথা সরিয়ে নিল। সবাই সরে পড়লে, সুরাহ আর-রাহমান তিলাওয়াত করতে করতে ওর মাথায় হাত রাখলাম…একদম চুপচাপ, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সুরাহটা পড়ে যেতে থাকলাম। একটা বার নড়ল না, চুপচাপ শুনে গেল।

রাতে আরও কয়েকবার গেলাম কাছে,…শান্ত…
মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে দিলাম। সারা রাতে একবারও চিৎকার করেনি।

একদম শান্ত।

আজ সকালে খুব বিচলিত লাগছিল ওকে। আমার নানী বললেন এই ছাগলটার কি ভাগ্য, ও আল্লাহর জন্য কুরবানী হয়ে যাচ্ছে, ওর জীবন সার্থক।

আমি ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম, কি বুঝল জানিনা। আল্লাহকে বললাম ওর জন্য সহজ করে দিতে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকল…অনেক্ষণ।

…… সবাই ওকে বেঁধে শোয়ালো। আমি গলায় ছুরি চালালাম, বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার।

ক্বুল ইন্না সলাতি, ওয়া নুসূকি ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়াল মামাতি, লিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামীন।

……লিল্লাহি রাবীল ‘আলামীন।

আল্লাহ আমার কুরবানী কবুল করে নিন আপনাদের কুরবানীও কবুল করুক। আমি জীবনে প্রথম বার উপলব্ধি করলাম যে রাহমার সাথে কুরবানী করা যায়। আপনি যাকে ভালবাসেন তাকে আল্লাহর জন্য তাকে কুরবানী করতে শক্ত মন লাগে না, পাথর হতে হয় না রাহমাহ ওয়ালা মন লাগে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তৃষিত মন লাগে।

তাক্বব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম।

আল্লাহ আমাদের আর আপনাদের (ভালো কাজগুলো) কবুল করুন।

………….

#রৌদ্রময়ী_ঈদ