কেবল এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। হঠাৎ করেই ঠিক হলো সেবারই আমরা হাজ্জ করতে যাব। আব্বু, আম্মু, ছোট ভাই আর আমি।
হাজ্জ এর মাহাত্ম্য বোঝার ক্ষমতা আমার তখনও হয়নি। ছোটবেলা থেকেই নামাজ, রোজা আর বোরকা পড়লেও আল্লাহ এর সাথে সম্পর্কটা ছিল নড়বড়ে। আমার কাছে তাই হাজ্জের চেয়ে প্লেনে চড়া আর বিদেশ ভ্রমনটাই বেশি আকর্ষণীয় ছিল।
জেনে নিচ্ছিলাম কোন কোন জায়গায় দোয়া কবুল হয়। আমার যে অনেক কিছু চাওয়ার আছে। স্মার্টফোন কি তখনও বুঝতাম না, তবে একটা টাচস্ক্রিণ ফোন লাগবে। আরো অনেক কিছু, যার সবই দুনিয়াবি। একেক জায়গায় একেকটা জিনিস চেয়ে নিব।
আম্মু বোঝাচ্ছে, হাজ্জ অনেক কষ্টের। অনেক ধৈর্য্য পরীক্ষা দিতে হবে। অন্যদেরকে কষ্ট দেয়া যাবে না। যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে।
আর আমার মাথায় ঘুরছে প্লেনের ভেতরটা কেমন হবে?
জেদ্দা এয়ারপোর্টটা কেমন হবে? অন্যদেশীরা কি আমার সাথে কথা বলবে?
আমাদের যাওয়ার সময় চলে এল। হাজ্জ ক্যাম্প থেকে ইহরাম বেধে আমরা রওনা হলাম পবিত্র ভূমির বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে।
প্লেনের ভেতরটা সত্যি সুন্দর। খাবারগুলোতো দারুন। জেদ্দা এয়ারপোর্ট ঘোরা, ভিনদেশীদের দোকানে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া সব খুব উপভোগ করছিলাম। মাক্কা হোটেলে এসেতো খুশিতে আটখানা। হোটেল হিলটনে উঠেছিলাম আমরা। আমাদের রুমটারতো প্রেমেই পরে গেলাম।
একটু ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পরলাম কা’বা শরিফ তাওয়াফ করতে। মাসজিদের বাহির দিকটা দেখেতো আমি থ’। এত সুন্দর, এত সুন্দর সুবহানাল্লাহ। দেয়ালগুলো থেকে যেন মুক্তা ঝরে পরছে। আর দরজাগুলো যেন সোনার তৈরি। এক টুকরো ধুলাবালি নেই। ঝকঝক করছে।
ভেতরে ঢোকার সময় আমাদের হাতে একটা করে পলি দিয়ে দিল জুতা রাখার জন্যে। কি সুন্দর তাদের সিস্টেম।
মাসজিদে ঢুকে আব্বু বলল, সবাইকে মাথা নীচু করে রাখতে। আমরা মাথা নিচু করে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আব্বু যখন বলল মাথা তুলে তাকাতে,
আমি থমকে দাড়ালাম, এ কোথায় আমি? এ তো সেই কা’বা যা আমি এতদিন টিভির পর্দায় দেখেছি। এতো আমার আল্লাহের ঘর। এ তো সেই ঘর যার কাছে আসার জন্যে মানুষ বছরের পর বছর সাধনা করে। আর আমি? আর আমি কিনা দুনিয়ার চিন্তায় মগ্ন?
ইয়া আল্লাহ আমায় ক্ষমা করো।
আল্লাহ আমায় ক্ষমা করো।
ইয়া রাহমানুর রাহিম আমায় ক্ষমা করো।
আল্লাহ আমি শুধু তোমায় চাই। শুধুই তোমায়, আর কোন কিছুই চাই না আমার।
দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর জোয়ার নামল।
সিজদায় লুটিয়ে চিৎকার করে কান্না করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, “ইয়া আল্লাহ আপনি আমায় আপনার ঘরে আসার জন্য কবুল করেছেন, ইয়া আল্লাহ আপনি আমাকেও কবুল করে নিন। আমাকে গুনাহ আর জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন। জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।”
সেদিন আমি কান্না করেছিলাম দুনিয়ার জন্যে না। আমার রবের জন্যে, শুধুই আমার রবের জন্যে। পুরো হাজ্জ সফরে আমি নিজের জন্যে দুনিয়াবি কিছু চেয়েছিলাম বলে মনে পরে না। শুধুই ক্ষমা আর আল্লাহের সন্তুষ্টি চেয়েছিলাম।
কা’বার কালো গিলাফ যে আমার চোখের রঙিন চশমা ভেংগে একেবারে চুরমার করে দিয়েছিল।
আমি প্রথম অনুধাবন করলাম, কা’বা যে ক্বালব বদলের জায়গা।
—————————–
কা’বা, ক্বালব বদলের স্থান
বিনতে আনসারী