পেট কাটা মা

আমি কখনও ভাবি নি আমার সিজার হবে। কিন্তু হলো। একটা না, দুইটা না, তিনটা।

ভাবি নি, চাই নি। প্রথমবার আমার বয়স পঁচিশ বছর ছিল। পুরা প্রেগ্নেন্সিতে কোন অসুস্থতা ছিল না। শুরুর তিন/চার মাসের স্বাভাবিক মর্নিং সিকনেসের পরেই আমি সুস্থ। ডায়বেটিস ছিল না। কত কাজ করেছি আর হেঁটেছি প্রতিদিন। ওজন খুব বেশি বাড়ে নি। বাবু হওয়ার সপ্তাহেও চাকরি করেছিলাম।

‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ হিসাব করলে, আমার তেমন কোন রিস্ক ফ্যাক্টরই ছিল না। মানুষ বলে যা যা করলে নরমাল ডেলিভারি হয়, সবই করেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই লাভ হলো না!

৩৮ সপ্তাহে হুট করে পানি ভেংগে গেল। ভেবেছিলাম, পানি ভাংলেই লেবার পেইন শুরু হয়ে যায়, হুড়াহুড়ি করে হাসপাতালে যাওয়ার পথেই বাবু হয়ে যায়–আমি তো ভয়ে অস্থির তেমন কিছু হয়ে যাবে! আল্লাহ বাঁচিয়েছেন, তেমন কিছু হয় নি। কিন্তু ব্যাথাও উঠে নি।

সেদিন উঠে নি, পরের দিনও উঠে নি।

নার্সরা পিটোসিন লাগিয়ে দিল পরের দিন সকালে। পিটোসিন দেয়ার সাথে সাথে নাকি মানুষের উথাল পাথাল ব্যাথা উঠে বাচ্চা হয়ে যায় কয়েক ঘন্টার মধ্যেই।

আমাকে বারো ঘন্টা টানা পিটোসিন দেয়া হলো, অথচ ব্যাথা সহনীয় পর্যায়ের চেয়ে একটুও বাড়লো না। জরায়ুর মুখও খুললো না। ওদিকে পানি তো বের হচ্ছে, হচ্ছেই।

অনেক অপেক্ষার পরে প্রথম সিজারের কথা যখন ডাক্তার বলতে শুরু করলেন, আমি পুরাটা সময় কোন কথা বলতে পারি নি। সেদিন পনের মিনিটে যেভাবে কাঁদলাম, সেটাকেই বোধ হয় অঝোর ধারায় কান্না বলে। শব্দ করে আমি কাঁদতে পারি না জীবনেও, অতএব মুখ দিয়ে টু শব্দটা হলো না, কিন্তু চোখের পানি মাপলে এক লিটার তো হতোই। শেষ মেষ ডাক্তারেরও মায়া লেগে গেল। আমাকে নাকি দেখতে ঠিক তাঁর অভিমানী মেয়ের মত লাগছিল।

নার্সরা এসে রেডি করলো ইমারজেন্সি সিজারের জন্য। গাউন পরালো। ক্যাথেটার পরালো। পায়ে শক্ত মুজা পরালো। আমি কেঁদেই যাচ্ছিলাম। বেচারীরা শুধু হাত ধরে সান্তনা দিয়ে যাচ্ছিল। এমন পাগল নিশ্চয়ই ওদের অনেক দেখা!

এনেস্থেটিশিয়ান এক ভদ্রলোক ছিলেন। মা হওয়ার এই ব্যাপারটা অদ্ভূত। সারা জীবন আমি বিশাল বড় পারসোনাল স্পেইস নিয়ে চলেছি, প্রাইভেসির সেন্স প্রখর ছিল। মাথায় হিজাব পরি দশ বছর বয়স থেকে। অথচ এক ধাক্কায়, কোন রকম কোন মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া, আমি প্রচন্ড ভালনারেবল অবস্থায় কয়েকজন পুরুষ ডাক্তার আর নার্সের হাতে সেদিন। লজিক্যালি সব বুঝছি, কিন্তু নিজেকে লুকিয়ে ফেলার যেই প্রচন্ড ইচ্ছা হচ্ছিল সেদিন, সেই অনুভূতি এখনও মনে পড়লে নিজেকে খুব একলা লাগে।

মুহূর্তেই বুক থেকে নিচের দিকটা অবশ। ঠান্ডা বরফের একটা টুকরা আমার গায়ের এক পাশ উপর থেকে নিচ করলো ওরা, উপরে কি ঠান্ডা, নিচের দিকে যেতেই কেবল স্পর্শের অনুভূতি, ঠান্ডা গরমের বোধ নেই। পাগুলো নাড়ানোর ক্ষমতা ছিল না নিজের। কয়েকজন নার্স আমাকে ধরে এক বিছানা থেকে আরেক বিছানায় নিয়ে গেল ‘অন কাউন্ট, ওয়ান, টু, থ্রি!’ বলে। মনে হচ্ছিল, মানুষ মরে গেলে যখন নিষ্প্রান শরীরকে ধরাধরি করে নাড়ায়, তখন এমনই লাগবে নিশ্চয়ই!

আমি কিন্তু কেঁদেই যাচ্ছিলাম! মাথার কাছে শুকনো মুখ করে বাচ্চাদের বাবা। এই আরেক মজার ব্যাপার। যারা ভাবেন সিজার মানে খালি পেট কাটলাম আর বাবু বের করলাম, তারা এরকম সময় হাসতে পারেন হয়তো। কিন্তু আমার মাথার কাছে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের মাথায় তখন সিজারের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো ঘুরছে। অতিরিক্ত রক্তপাত, মৃত্যু, হিস্টোরেক্টমি। কত কিছু কেটে ভিতরে ঢুকতে হয়। পথে খুব গুরুত্বপূর্ন নার্ভের ক্ষতি হয়ে যাওয়া।

বেচারা আমার দ্বিতীয় সিজারের ঠিক আগের সপ্তাহে ভয়াবহ এক সিজারে এসিস্ট করেছিল। বাচ্চা বের করার পরে মহিলার আর রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না, জান নিয়ে টানাটানি। ওর চোখে কেবলই ওই গলগল করে বের হতে থাকা রক্তের দৃশ্য ভাসছে।

প্রথম দুই সিজারে এনেস্থেশিয়ায় আমার কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় নি। কিন্তু তৃতীয় বার — মনে হচ্ছিল শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বুকের উপর এক টন ওজন। কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। ওদের বলতেই ওরা বলছিল এটা মরফিনের সাইড এফেক্ট। ওদিকে আমার সিরিয়াসলি মনে হচ্ছিল কবরের চাপ বুঝি এমন হবে!

আমার সামনে প্রটোকল অনুযায়ী চাদর ঝুলানো ছিল, যেন ওপাশের কিছু আমি বা আমার বর দেখতে না পারে। কিন্তু উপরে চোখ যেতেই দেখি লাইটের স্টেইনলেস স্টিল ফ্রেমে আমি! স-অ-ব দেখলাম। লালচে কমলা একটা লিকুইড দিয়ে পরিষ্কার করে ঘ্যাচাং করে ছুরির পোঁচ দিল। তারপরেই খুব তাড়াহুড়া করে সার্জেনরা গ্লাভস পড়া হাতে ছয় ইঞ্চি কাঁটাটাকে টেনে টেনে বড় করছিল! কি বিচ্ছিরি, পশু পশু একটা ব্যাপার, নিজের শরীর ভাবতে পারছিলাম না! পরে জেনেছি আমাদের স্কিন ইলাস্টিক, বেশি না কাঁটার জন্য এই টানাটানি–সাময়িক ভাবে ফাঁকাটাকে বড় করা।

তারপর দেখলাম কত লেয়ার পার হয়ে, হাতগুলো বেশ খানিকটা ঢুকিয়ে বাবুকে বের করে আনলো ওরা!

এই মুহূর্তটার আসলে কোন তুলনা হয় না। সুবহানাল্লাহ, এই মুহূর্তটার জন্য বার বার মা হতে ইচ্ছা করে। জীবনে যতবার একদম বিশুদ্ধ ভালো লাগায় আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে কেঁদেছি, নিজের ভিতর বড় হওয়া বাবুগুলোকে প্রথমবার দেখার পরের কান্নাগুলো একদম শুরুর দিকে থাকবে।

বাবুকে একবার দেখার পরে বুকে না নেয়া পর্যন্ত কি যে খালি খালি লাগতে থাকে! কিন্তু সে পর্যায়ে তো আমি কাজে লাগার মত মা না। বুক থেকে নিচের পুরাটাই অসার। শরীরের মাঝখানে বিশাল এক ফাঁকা। অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই তখন!

আস্তে আস্তে রিকভারির পরে বাবুকে বুকে নিয়ে স্বস্তি। কিন্তু ততক্ষন নিজেকে নতুন করে চেনা শুরু হয়। পা নাড়ানো, একলা দাঁড়ানো, ধাপ ফেলে ফেলে হাঁটা, বাথরুম করা। আর অপেক্ষা করা সেলাইয়ের ব্যাথা কবে সারবে। সেলাইয়ের ব্যাথা প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বার বেশি ছিল। তৃতীয়বার আরও বেশি।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি মানসিক কষ্টে ছিলাম প্রথমবার। মানতেই পারছিলাম না, আবার ওদিকে সার্জারির ফলে দুধ আসছিল না। সে কি কান্না কাটির দিন গিয়েছিল!

মনে আছে, যেদিন বাসায় ফিরেছিলাম, সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল অন্য কাউকে দেখছি–এত বিচ্ছিরি পোস্ট সার্জিক্যাল শরীর! ওই হাপুশ কান্নার সময় বার বার আমার বর একটা কথা বলছিল, যেটা আসলে মানতে আর বুঝতে অনেক দিন সময় লেগেছিল আমার। ও বলছিল, ‘আল্লাহ তোমাকে সুস্থ একটা বাচ্চা দিয়েছে, তুমি সুস্থ আছো–এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার।’

মানতে আসলেই অনেক দিন লেগেছিল। জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার পরে আস্তে আস্তে এই বোধ আসল। চোখের সামনে স্টিল বার্থ দেখলাম–পেটের বাচ্চা দুনিয়ায় আসার আগেই মরে গেল। ভুল এনেস্থেশিয়া থেকে আজীবন পংগু হয়ে যাওয়া দেখলাম। বাচ্চা বের করতে দেরি হওয়ায় বাচ্চার অসুস্থ হয়ে যাওয়া দেখলাম। তারপর এই বোধ আসল। আল্লাহ মাফ করুক।

আস্তে আস্তে বুঝলাম, মানুষ ব্যাংগ করে ‘এখন পেট কাটার যুগ’ বলে কারন এদের ধারনাই নাই পেট কাটার যুগ আসার আগে আমার মত যাদের পানি ভাংগার পরে হাজার চেষ্টাতেও লেবার পেইন উঠে নি তাদের কি হত! তারা মারা যেত বোন, মারা যেত! তাদের বাবুরা মারা যেত!

অপ্রয়োজনীয় সিজার ভালো না। কিন্তু অনেক সিজার প্রয়োজনীয়। সিজার আবিষ্কারের পরে প্রসূতি আর নবজাতক মৃত্যুর হার কমেছে অনেকে। আলহামদুলিল্লাহ, এদিক দিয়ে সিজার আমার মত মায়েদের জন্য অসীম রহমত।

তারপরেও, অবুঝ মন তো, নরমাল ডেলিভারি না হওয়ার দুঃখটা থেকে থেকে উথলে উঠে। সেদিন একজনকে বলতে শুনলাম জান্নাতে গিয়ে উনি নরমাল ডেলিভারির অভিজ্ঞতা চান। হাসতে গিয়েও মায়া লেগে গেল। কেমন একটা শূন্যতা লাগে সত্যি, মনে হয়, মা হওয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অভিজ্ঞতার অংশ হতে পারলাম না, চোরা একটা ব্যর্থতার অনুভূতি আসতে চায়।

এবার, তৃতীয়বার সিজারের আগেও এই অনুভূতিগুলো থেকে থেকে আসছি। তখন মনে হলো, নরমাল ডেলিভারির দোয়া কম করি নি। আল্লাহ দেন নি। কিন্তু অজস্র মিনতির দোয়াগুলো ব্যর্থ যায় নি, আল্লাহর কাছে কোন দোয়াই ব্যর্থ যায় না। জমা আছে কোথাও, ইন শা আল্লাহ একদিন সব নিশ্চয়ই পাবো!

এর আগ পর্যন্ত একদম ভুলতে চাই না যে আমার জীবনে সিজারগুলো রহমত ছিল। অনেক কিছু হয়ে যেতে পারতো। আল্লাহ সব বিপদ দূরে রেখে আমাকে আর আমার বাচ্চাদের এই জটিল সার্জারি থেকে তিন তিনবার বের করে আনলেন অক্ষত অবস্থায়–এটা মিরাকেল না হয়ে যায় না। আলহামদুলিল্লাহ।

———————
সাদিয়া হোসাইন
পেট কাটা মা