এক খন্ড কাপড়

সাইফ নিজের বেডে ভ্রূ জোড়া কুঞ্চিত করে বসে আছে। সে বিরক্ত, খুবই বিরক্ত। কারণ রুমের বাইরের বারান্দায় একেবারে তুমুল হট্টগোল বেঁধেছে। হলের ছেলেরা সাধারনত হট্টগোলওয়ালা পরিবেশে একেবারে অভ্যস্ত হয়ে যায়, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা সত্যিই আলাদা। দুই পক্ষের মুখ তো ছুটছেই, যেকোন মুহূর্তে হাতও ছোটা শুরু হতে পারে। তার উপর, এক পক্ষের প্রধান এবং একমাত্র সদস্য হলো সাইফের রুমমেট আবির। ছেলেটা তুখোড় বিতার্কিক, কিন্তু হ্যাংলা পাতলা শরীরে জোড় বলতে কিছু নাই।

চেঁচামেচির ভলিউম বেড়েই চলেছে। আর পারে না সাইফ, সটান উঠে দাঁড়ায়। সোজা হাঁটা দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে দেখে সবাই একটু থমকে যায়। ব্যাপারটা আগেও দেখেছে, তার উপস্থিতি ছেলেদের আড্ডা প্রায় সময়ই থামিয়ে দেয়। আজকে তো এও শুনতে হল, “আইসে হুজুর!”

সাইফ কোন কিছু পরোয়া না করেই বলে, “এই আবির, আমি একটু মসজিদে যাচ্ছি। তুই যাবি?”

আবিরের মুখ আবিররঙা, হাতে একটা পতাকা। সে হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না, মাথাটা উপর নিচ সামান্য দুলিয়ে রুমে ঢুকে যায়। পতাকাটা রেখে এসেই সাইফের সাথে যোগ দেয় সে। ঝগড়াটা এভাবে শেষ হওয়ায় মনে হয় কেউ কেউ একটু অসন্তুষ্ট হলো। পিছন থেকে কে যেন টিটকারী মারে, “যা যা। নিজের দলের জন্য ভালো করে দোয়া করিস, যাতে গো হারা না হারে!”

আবির পিছনে ফিরে উত্তর দিতে যায়, কিন্তু বন্ধুর ইশারায় নিজেকে অনেক কষ্টে সামাল দেয়। বিড়বিড় করে কি কি সব বলে, ওগুলা যে সব গালি সেগুলো সাইফ না শুনলেও বুঝতে পারে। সে না থেকে অন্য কেউ পাশে থাকলে হয়তো সেগুলো জোড়েই উচ্চারিত হত।

“দেখেছিস ওদের কাজ? নিজেদের দল ভারী বলে আজ ব্যাটাদের মাটিতে পা পরেনা। আমার দলের পতাকাটা খুলে নিজেদেরটা লাগালো, আবার এভাবে মাটিতেও ফেলে রাখলো! মনে যে কি চাচ্ছিলো না…”

পাশের রুমের সবার সাথে আবিরের ভালোই খাতির। কিন্তু ওরা সব কয়টা হয় ব্রাজিল না হয় আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করে। বেচারা অন্য দলের সমর্থক, তাই সে একা পরে গেছে। একা হলেও তার তেজ কম না। প্রতিদিনই তাই ফুটবল নিয়ে ঝগড়া ভালোই জমে উঠে। অথচ লোকে বলে, এসবের লক্ষ্য নাকি ভ্রাত্বিত্ব প্রতিষ্ঠা করা!

আবির এদিকে এক নাগাড়ে বলেই চলেছে, সাইফ সেগুলো খুব একটা কানে ঢুকাচ্ছে না। হঠাৎ একটা কথা কানে ঢুকায় সাইফ একটু চমকে গেল-

“কমিটমেন্ট নাই দলের প্রতি, ফুটবল সম্পর্কে কোন জ্ঞান ও নাই। খালি চার বছর পর পর পতাকা উড়ালেই সাপোর্টার হওয়া যায় নাকি! যত্তসব…” তারপর আবারও বিড়বিড়ানি।

সাইফ কিছু বলেনা, হাঁটতে থাকে। মাথার মধ্যে এখন তার নতুন একটা চিন্তা ঘুরছে- যদি ওয়ার্ল্ডকাপটা ডিসেম্বর বা মার্চে হত, তাহলে বাঙালির কমিটমেন্ট কোন দিকে হেলত বেশি? তখনো কি পুরা দেশ ভিনদেশের পতাকায় ছেয়ে থাকতো? চেতনা জয়ী হত নাকি ভ্রাতৃত্ববোধ?

এসব চিন্তা করতে করতে সাইফ পুকুরপারের কাছে চলে আসে। সেখানেই একটা বসার জায়গায় ধপ করে বসে পড়ে। আবির অবাক হয়, “কিরে, যাবিনা?”

“যাবো, ইন শা আল্লাহ। এখনো যেহেতু সময় আছে, তাই ভাবলাম বসি এখানে, একটু আকাশ দেখি।” সাইফ আকাশের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো। তার পরন্ত বিকালের আকাশ খুব ভালো লাগে।

উত্তর শুনে আবির একটু রাগ করেই বললো, “তাহলে আমাকে এত আগে ডাকলি কেন? ওদের আরেকটু দেখে নিতে পারতাম। আমার পতাকাটা ওরা এভাবে মাটিতে ফেলে রাখলো!”

সাইফ হেসে বললো, “এক খন্ড কাপড়ের জন্য এত কিছু?”

“শুধু কাপড় না। এটা একটা প্রতীক। আর এই প্রতীকের প্রতি সম্মান হলো তোর আনুগত্য আর ভালোবাসার এক রকম বহিঃপ্রকাশ।” আবির খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে, এখনো তাই করলো। ওর গুছানো কথাগুলোয় সাইফের মনটা অগোছালো হয়ে গেল। একটা ঘটনা মনে পড়লো তার।

“ঠিকই বলেছিস। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য আর ভালোবাসা- এর জন্যই সাহাবীরা যুদ্ধের ময়দানে ইসলামের প্রতীকবাহী পতাকাটা এত আগলে রাখতেন। এক যুদ্ধে জাফর বিন আবি তালিব কি করেছিলেন জানিস? শত্রুর আঘাতে শরীর ছিন্নভিন্ন হলেও উনি এক হাতে শক্ত করে পতাকা ধরে রেখেছিলেন। এক হাত কাটা পরার পর উনি আরেক হাতে পতাকা ধরে রেখেছিলেন, তারপর সে হাতও কাঁটা যাওয়ার পর উনি কাঁটা দুই হাত দিয়েই পতাকাটা বুকে আগলে রেখেছিলেন, তবু মাটিতে পড়তে দেননি। উনি শহীদ হওয়ার আগেই সেটার দায়িত্ব নেন আরেক জন। ইসলামের প্রতীকি পরাজয়টুকুও সাহাবারা কেউ সহ্য করেননি। আর আমরা কিনা…”

আবির চুপচাপ সাইফের কথা শুনছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো, “সাহাবীদের সাথে কি আর আমাদের তুলনা চলে রে!”

সাইফ বললো, “তাঁরাও তো রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন, আমাদেরই মত।” আবির মাথা ঝাঁকাল আর বললো, “কিন্তু সেই সময় তো আর এখন তো আর সমান না। চৌদ্দশ বছরে অনেক কিছুই চেঞ্জ হয়েছে।”

“চেঞ্জ হয়েছে শুধু টাইম আর কন্টেক্সট, প্রিন্সিপাল তো না। সেই প্রিন্সিপাল গুলো স্বয়ং আল্লাহই ঠিক করে দিয়েছেন। আমাদের কাজ হলো রাসূল (সাঃ) এর জীবন থেকে সেগুলো সম্পর্কে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবনে খাটানো।” সাইফ আবিরের দিকে তাকিয়ে বুঝলো ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করা দরকার।

“এই যেমন ধর, তুই ফুটবল পছন্দ করিস। তো ওয়ার্ল্ড কাপে তোর কোন দল সাপোর্ট করা উচিত? নিশ্চয়ই আজ রাসূল (সাঃ) জীবিত থাকলে যেই দল সাপোর্ট করতেন সেই দল। তাই না?”

কথা শেষ হওয়ার আগেই আবির হা হা করে হাসতে থাকলো। কোন রকম হাসি থামিয়ে বললো, “নবীজী তো ওয়ার্ল্ড কাপই সাপোর্ট করতেন না, আবার একটা দল!”

“তাই? কিন্তু কেন?” সাইফ খুব জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো।

“কারণ…”

আবির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। কিংবা কারণ জানলেও বলতে পারছে না। মাঝে মাঝে সেরা বিতার্কিকও বুঝি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

বন্ধুর জন্য মায়া হলো সাইফের, ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, “থাক, বলতে হবে না।” আবির মাথা নিচু করে রইলো। সাইফ আরো বললো-

“শুধু পতাকা উড়ালেই যেমন সাপোর্টার হয় না, তেমনি শুধু মুখে বললেই মুসলিম হওয়া যায় না। পার্থিব জীবনের তুচ্ছ সব জিনিসের প্রতি যেই কমিটমেন্ট আমাদের থাকে , তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি থাকলে ইসলামের সেই পতাকা হয়তো কোনদিনও মাটিতে পড়তো না।”

কথা শেষ হওয়া মাত্রই মাগরিবের আজান শুরু হলো। দুই বন্ধু আবারো হাঁটা দিলো। হাঁটতে হাঁটতে আবির সাইফের বলা কথাগুলোই ভাবছিলো। হঠাৎ তার প্রিয় দলের পতাকা চোখে পড়ায় মনের ভিতর টেনশান শুরু হলো। আজ তাদের খেলা আছে। মনে মনে দুয়া করতে থাকলো যাতে তার দল খুব ভালো ভাবে জিতে। তাহলে সে আজকের ঘটনার জন্য প্রতিশোধ নিতে পারবে, খুবই মধুর হবে সেই প্রতিশোধ।

এদিকে আজানের উত্তর দেয়া শেষ করে সাইফও মনে মনে দুয়া করছে। দুয়া কবুলের উত্তম সময় হেলায় হারায় না সে কখনো। আজ সে দুয়া করছে তার পাশের বন্ধুটির জন্য, ওর হিদায়াতের জন্য।

হিদায়াত তো সহজ ব্যাপার না, শুধু এক দুই বারের দাওয়াহতেই তো আর কাজ হয় না। প্রয়োজন দুয়া আর অবিরাম চেষ্টা। এই কথা সাবেক ফুটবলপ্রেমী সাইফ খুব ভালো করেই জানে।

…….

এক খন্ড কাপড়
বিনতে আব্দুল্লাহ

জুন ২৯, ২০১৮ইং