পরিবর্তিত রামাদান

নীল রঙের ডাইরীটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে শান্তা। রমাদান আসতে আর বেশী দিন বাকী নেই। দোয়ার লিষ্টটা করে ফেলা দরকার। গতবছর থেকে এই সুন্দর নীল ডায়েরীতে দোয়া লিখা শুরু করেছে।

এর আগের দুই তিন বছরের দোয়া লিষ্ট অন্য একটা ডায়েরীতে লিখা আছে। লিখতে বসে নস্টালজিক হয়ে গেলো শান্তা। ওর জীবনের পরিবর্তিত রমাদান আর এই দোয়া লিষ্ট নিয়ে কত স্মৃতি।

ছোটবেলা থেকে শান্তা বাংলাদেশের আর দশটা সাধারণ মুসলিম পরিবারের মতোই একটি মিক্সড পরিবেশে বড় হয়েছে। ছোটবেলায় হুজুরের কাছে কুরআন পড়া শিখতো আবার অন্যদিকে নাচের স্কুলের ফার্স্ট গার্ল ছিলো। আলহামদুলিল্লাহ্‌ হাই স্কুলে ওঠার পর নাচ ছেড়ে দিয়েছিলো শান্তা নিজেই।

শুদ্ধ কুরআন পড়া না শিখালেও হুজুর এতটুকু বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলো শান্তাকে যে নৃত্যকলা ইসলামে নিষেধ। তাছাড়া মেয়ে বড় হয়েছে এখন আর নাচার দরকার নাই এটা পরিবারের লোকজনও অনুভব করায় বাদ দেওয়া সহজ হয়েছিলো।

হিজাবের ব্যাপারে পরিবার উদাসীন থাকলেও নামাজের ব্যাপারে পরিবারে যথেষ্ট জোর দেওয়া হতো। তাই রমাদানে ইফতার উৎসবের পাশাপাশি বাসায় নিয়মিত তারাবীহ পড়া, সেহেরী খেতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস পরিবারের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছিলো। সাথে কুরআন খতম তো ছিলোই।

৮ বছর আগে প্রথম যখন দেশের বাইরে রমাদান আসলো, তখন শান্তা প্রথমবারের মতোন নতুন করে যেন রমাদানকে চিনতে শুরু করলো। আগে নামাজের রাকাআত সংখ্যা অনেক ইম্পর্ট্যান্ট মনে হলেও সেইবারই প্রথম জানতে পারলো নামাজের খুশু খুযু কি জিনিস।

সাথে এটাও জানলো এই মাসে স্পেশাল দোয়া কবুল হওয়ার সময়গুলো কখন। ইউনিভার্সিটির একজন কলিগের সৌজন্যে কুরআনের একটা বাংলা অর্থও যোগাড় করে পড়া শুরু করলো। যত পড়ছিলো ততই যেন এক অন্য জগতের সন্ধান পেয়ে যাচ্ছিলো।

ওই বছরই প্রথম মসজিদে গিয়ে তারাবীহ নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হলো। সেই রমাদানের আগেই অবশ্য মসজিদে কুরআন ক্লাস শুরু করেছিলো তাজউইদ শিখবে বলে। সাথে শান্তা ও তার জামাই মিলে ঠিক করে নিয়েছিলো কি কি দোয়া চাইবে এই রামাদানে। ইফতারের আগে, তাহাজ্জুদে, ফরয সালাতের পর এভাবে দোয়া কবুলের সময়গুলোতে দোয়া করে গেলো আল্লাহ্‌র কাছে।

এর ঠিক দুই বছরের মাথায় যখন রমাদান আসলো তখন শান্তারা অন্য আরেকটি দেশে। সেই রমাদানের আগে শান্তা একদমই ফ্রি ছিলো; যাকে বলে শুধু দুইজনের সংসারের কাজ; না কোন পড়াশুনার ঝামেলা না অন্য কোন দায়িত্ব। তখনই প্রথম শান্তা জানতে পারলো রমাদানের জন্য প্রিপারেশান আগেই নেওয়া উচিত এবং এটাও নাকি আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এর সুন্নাহ।

তখন সে বিভিন্ন লেকচার শুনে সাথে হালাকা এটেন্ড করে জানতে পারলো দোয়া লিষ্ট করার উপকারিতা কি এবং দোয়ায় শুধু দুনিয়ার জন্য না আখিরাতের জন্যও চাওয়া উচিত। তাই শান্তা সেইবারই প্রথম একটা দোয়ার লিষ্ট বানিয়ে ফেললো।

সে চার ভাগে ভাগ করেছিলো লিষ্টটা আখিরাতের জন্য দোয়া, দুনিয়ার জন্য দোয়া, সম্পর্কের জন্য দোয়া আর মাস্টার লিষ্ট। মাস্টার লিষ্টের দোয়াগুলো সবসময় করার চেষ্টা করতো যেন হাতে দোয়া করার সময় কম থাকলে বড় লিষ্টের পরিবর্তে এই মাষ্টার লিষ্ট থেকে দোয়া করতে পারে।

এরপরের বছরের রমাদানে শান্তা বুঝতে পারলো দোয়ার ক্ষেত্রে শব্দ চয়ন কত ইম্পর্ট্যান্ট। যেমন আগের তিন রমাদানেই শান্তার একটা কমন দোয়া ছিলো ওর বোনের বিয়ের জন্য দোয়া। আলহামদুলিল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ তিন রমাদান ধরে টানা করে যাওয়া দোয়া কবুল করেছিলেন সেই রমাদানের আগেই। কিন্তু বোনের বিয়েতে অনেক ঝামেলা হয়েছিলো সাথে কিছু টানাপোড়েন তখনো চলছিলো।

রমাদানের লেকচার শুনতে গিয়ে বুঝতে পারলো শান্তার দোয়া ছিলো “আল্লাহ্‌ আমার বোনের বিয়ের ব্যবস্থা করো” কিন্তু সুন্দর দোয়া হতো যদি বলতো “আল্লাহ্‌ একজন প্র্যাকটিসিং ভালো ছেলের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করো যেন তারা দুইজন একে অপরের চক্ষু শীতলকারী হতে পারে”।

কারণ লেকচারে শেইখ বলছিলেন দোয়ার ক্ষেত্রে সুন্দর করে বলতে; সাথে কোন ব্লেসিং আল্লাহ্‌র কাছে চাওয়ার সময় কেন চাই তার কারণ সহ বলতে। শেইখ লেকচার এ উদাহরণ দিচ্ছিলেন “যেমন আল্লাহ্‌ আমাকে জব দাও এমন না বলে এভাবে বলা ভালো আল্লাহ্‌ আমাকে একটা উত্তম জবের ব্যবস্থা করে দাও যেন আমি হজ্জ করতে পারি সাথে তোমার রাস্তায় দান খয়রাত করতে পারি”।

এইসব অনেক স্মৃতির অলিগলিতে ঘুড়ে বেড়াতে বেড়াতে আগের করা দোয়া লিষ্টের পাতা উল্টাছিলো। দেখলো আল্লাহ্‌ প্রতিবার মাস্টার লিষ্টের দোয়া হয় পরের রমাদান আসার আগেই কবুল করেছেন নয়তো দুই তিন রমাদানের মধ্যেই তা কবুল হওয়ায় পরের রমাদানের মাস্টার লিষ্ট থেকে তা বাদ দিতে হয়েছে।

আসলেই কত পরিবর্তন আগের রামাদান আর ইসলামের বুঝ আসার পর রমাদানে। এখন ইফতার উৎসব কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত না থেকে অন্য ভালো লাগায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেই বেশি ভালো লাগে।

—————————
পরিবর্তিত রামাদান

আহলিয়া রিফাত

জুন ০২, ২০১৮ইং