আলোর পথে যাত্রা

১.
বিশাল এক ভার্সিটির ক্যাম্পাস। একশত বিশ একর জমির ওপর। প্রায় ১০০ বছর আগে নির্মিত এই ক্যাম্পাস। সবুজ অরণ্যে ছেয়ে গেছে চারপাশ। বড় বড় প্রকাণ্ড বৃক্ষগুলো যেন সুন্দরবনের গাছগুলোকে হার মানায়।

ইরা হাঁটছে ক্যাম্পাসে। ইরার পরনে লম্বা গোলাপী স্কার্ট আর লেডিস টি-শার্ট। আজ ইরাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট ইরা। ভর্তি হয়েছে বছর খানেক হলো। সাবজেক্ট – ট্যুরিজম এন্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট। ছোটবেলা থেকে ইরার ইচ্ছা ভ্রমন করা। এই দেশ থেকে সেই দেশ। এই দ্বীপ থেকে সেই দ্বীপ। এজন্যই তার এই সাবজেক্ট পছন্দ।

ইরা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রুত হাঁটার উদ্দেশ্য ক্লাস ধরা। ক্লাস শুরু ৮.৪৫ এ, ও ঘুম থেকে উঠেছে ৮.৩৫ এ। আজ কবির স্যারের ক্লাস। তাই পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে হাঁটা শুরু করেছে। খাওয়াটা আজ হলো না। ক্ষুধায় পেট এখনি গুড়ুম গুড়ুম সুর তুলেছে। কি আর করা-অলস হলে যা হয়, সময়মত উঠতে না পারলে পরিণতি তো খারাপ হবেই।

ইরার ক্লাস বিবিএ ডিপার্টমেন্টের নিচ তলায়। হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লাশরুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো। স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন। সাহস করে অনুমতি চাইল স্যারের কাছে ইরা। স্যার রোল কল করছেন।

ইরাকে দেখে স্যার রেগে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, “স্টুপিড গার্ল! তোমাকে কতদিন বলেছি ক্লাশে দেরি করলে তোমাকে কেন কাউকে এলাউ করা হবে না।”

ইরা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “সরি স্যার। নেক্সটে এমন হবে না।”

স্যার ইরার কাঁদোকাঁদো ভাব দেখে বললেন, “এসো, নেক্সটে এমন যেন না হয়। মেয়েদের এই এক প্রবলেম। কান্না যেন চোখের কাছে হাজির হয়ে থাকে। একদম সুইচ চাপার মতো। সুইচ চাপলেই ঝরঝর করে ঝরে পড়ে অশ্রুর বারি। কেঁদেই সব জায়গায় পার পেতে চায়!”

“শোন মেয়ে!”

স্যারের ডাকে ইরা ছলছল চোখ তুলে স্যারের দিকে তাকাল। ওর চোখের অলরেডি সুইচ চাপা হয়ে গেছে। চোখেরা তাদের কার্যসম্পাদন করা শুরু করেছে।

ইরার চোখে অশ্রুর বান দেখে। স্যার আর কিছু বললেন না। ক্লাসের দিকে মনোযোগ দিলেন।

ক্লাস শেষ করেই ইরা হলের দিকে হাঁটা দিল। কেঁদে কেঁদে চোখটা ফুলে গেছে। ইরার লাইফে এটাই প্রথম ধমক! বাবা মার একমাত্র মেয়ে হওয়ায় ছোটবেলা থেকে অনেক অাদর দিয়ে বড় করেছেন। প্রচন্ড জেদী, রাগী আর অহংকারী সে ছোট বেলা থেকে।

২.
“এই ইরা! ইরা! শোন, তোর সাথে কথা আছে” – পেছন থেকে মুহিব ডাকছে ইরাকে। মুহিব ইরার বেস্ট ফ্রেন্ড। বেশ কিছুদিন ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি ওকে। মুহিবের ডাক শুনে ইরা থামলে মুহিব বলল – “কিরে, পুরো চাঁদ বদন মুখখানা গোমড়া করে কই যাস? কী হয়েছে?”

ইরা রেগে গজগজ করতে করতে বলল, “মুহিব সবসময় ফাজলামি মারা কথা ভাল লাগে না। শোন, আজ ক্লাসে যাস নি। তাই কিছু জানিস না। আজ কবির স্যার পুরো ক্লাসের সামনে আমাকে অপমান করলেন। ক্লাশের সবাই মিট মিট করে হাসছিল – বিশেষ করে তুলি, মীরা, অহনা। আমার এতো খারাপ লেগেছে!”

কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলল ইরা।
মুহিব কি বলবে ভেবে পেল না। মনে মনে হাসল ইরার ছিঁচকাঁদুনি দেখে। মুহিব জানে ইরা ক্লাশের সবাইকে প্রতিনিয়ত অপমান করে। ওর অত্যাচারে রীতিমত সবাই অতিষ্ঠ। ওদের ক্লাশের আনিকাকে একদিন যা তা বলে অপমান করেছিল। কারণটা ছিল আনিকা কালো বোরকা হিজাব, হাতমোজা, পা মোজা পরে; সবাইকে নামাযের কথা বলে। এসব ইরার একদম সহ্য হয় না। অথচ আনিকা মেয়েটা এতো ভালো যে, ক্লাশমেটরা মোটামুটি সবাই ওকে সাপোর্ট করে, শ্রদ্ধা করে – যদিও ছেলেদের সাথে আনিকা কথা বলে না। ইসলামের বিধি নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করে।

মুহিব মনের কথা মনে রেখে, ইরাকে সান্তনা বাণী শোনালো। মুহিবের উদ্দেশ্য ইরা কে শান্ত করানো। ওকে এখন শান্ত না করলে আরো কী তুলকালাম কাণ্ড ঘটাবে তা মুহিবসহ ওর সব বন্ধুবান্ধব জানে। মুহিব ইরা কে বলল, “ইরা! চল আইসক্রীম খাই?”

“না মুহিব, আইসক্রীম খাব না। কফি খাব।”

“আচ্ছা চল,তাহলে কফি আড্ডাতে যাই। আচ্ছা ইরা,তোকে একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হয় না। আজ আমার কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবি?”

“বল, কি কথা?”

“কফি খেতে খেতেই বলি।”
ইরা মুহিব কফি খাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা দিল।

ইরা-মুহিব দুজন বিপরীত পাশের দুটি চেয়ারে বসা। পিনপন নীরবতা। দুই মগ কফির অর্ডার দেয়া হয়েছে।

প্রথমে নীরবতা ভাঙল মুহিব। মুহিবের দৃষ্টি নিচু। মুখটা অনুশোচনার দহনে দগ্ধ।

“ইরা, তোকে কয়েকদিন ধরে কথাটা বলবো ভাবছি।তুই কথাগুলো কেমন ভাবে নিবি জানি না। তবে তোকে বলাটা আমার জরুরি। শোন আমি গত এক মাস ধরে কিছু শুভ্রচিন্তার সন্ধান পেয়েছি। চিন্তাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে হয়ত অনেক কষ্ট হবে অথবা সহজ হবে। ইরা আমার জাহিল জীবন আমার কাছে অসহ্য মনে হয়েছে যখন থেকে আমার ফেন্ড তুহিনের সাথে দেখা হয়।

সেদিন কী হয়েছে শোন,
মার্কেটে কী যেন কিনতে গিয়েছিলাম। আমাকে পেছন থেকে কে হাত চেপে ধরল। অপ্রস্তুত আমি পেছন ফিরে তাকাতেই দাড়ি ওয়ালা হুজুর দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

-আরে মুহিব! আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি তুহিন।এই কয় দিনে ভুলে গেলি?
-তু-তুহিন! তুই মিয়া এক্কেবারে দেবদাস হয়ে গেছিস। তো বল,কেমন আছিস? হুজুর হলি কবে থেকে?
-আছি আলহামদুলিল্লাহ। তারপর তোর খবর বল।

তুহিন বুয়েটে চান্স পাওয়ার পর আর কথা হয় নি। ইরা সেদিন তুহিনের সাথে দেখা হওয়াটা আমার লাইফের সবচাইতে ইম্পর্ট্যান্ট ছিল। ওর সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা হলো। ওর ইসলামের পথে আসার কাহিনীটা ছিল অসাধারন! ওর কথাগুলো যেন আমার অন্তরের অন্ত:স্থলে বিধে যাচ্ছিল।

আমার এই অন্ধকার জগত থেকে আলোর পথে যাত্রাটা সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল।
ইরা, শুনছিস?”

“হুম,শুনছি।”

“কফি ঠান্ডা হয়ে গেল, খেয়ে নে।
ইরা আমি গত একমাস আমাদের মেয়েদের সাথে কথা বলা বাদ দিয়েছি আল্লাহর ইচ্ছায়। সাথে সলাত, সহীহ কোরআন প্রশিক্ষন নিচ্ছি।
তোকে জাস্ট একটা কথা বলবো আমি তোকে বোনের মতো ভাবতাম, কিন্তু এটা কখনো পসিবল না। আমাদের মধ্যে গায়ের মাহরাম সম্পর্ক। সো, তোর সাথে আগের মতো কথা বলা হবে না। তাই আজ তোকে একটা কথা বলব….

ইরা তোর জীবনটা কিন্তু অন্ধকারে ঢাকা। তোকেও আলোর পথে যাত্রা শুরু করতে হবে। আমরা কেউই এই পৃথিবীতে স্থায়ী আবাস গড়তে আসিনি। সবাইকে চলে যেতে হবে।
তোর আচরণটা একটু চিন্তা করে দেখিস। তুই এমন অহংকারী ভাব দেখাস, সবাই অনেক কষ্ট পায়। সেদিন আনিকাকে যেরকম অপমান করেছিলি। আমিও তোকে তখন সাপোর্ট দিয়েছিলাম না বুঝে। কিন্তু এখন বুঝি ওটা কতোটা অন্যায় হয়েছিল ওর সাথে। পর্দা নিয়ে অপমান মানে তো ইসলামকে অপমান করা হয়।

আনিকা তোকে ইসলামের পথে ডাকতো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে মেয়েটা তোর কাছে আসতে ভয় পায় হয়তো। আমি তোকে এভাবে ডেকে বলতাম না। একাকি গায়ের মাহরাম ছেলে মেয়ে কথা বলা ঠিক না, গুনাহ। তবুও আজ তোকে বললাম। কারন তুই একটু বেশি কেমন যেন হয়ে গেছিস।

আর কথা বলবো না। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। গেলাম ইরা। আল্লাহ তোকে হিদায়াত দিন।”

এতক্ষণ ধরে কথা বলছে তবুও ইরার দিকে একবারো তাকায়নি মুহিব।

৩.
সেদিন কফিশপ থেকে ফিরে একদম চুপচাপ রুমে চলে গেল ইরা। সারারাত ধরে ইরা ভেবেছে ওর জীবন নিয়ে। কী পাপের কাজ করেছে এতদিন। আনিকার সাথে করা আচরণটা ভেবে কান্না পাচ্ছে। কী কঠিন বাক্যগুলোই না ছুড়েছিল আনিকাকে তবুও আনিকা ওর সাথে কথা বলতে এসেছিল। ওদিকে কর্ণপাত করেনি ইরা।

পরদিন ইরা আনিকার সাথে দেখা করে সেদিনের ওই ব্যবহারের জন্য মাফ চেয়ে নেয়। আনিকা খুব খুশি হয়েছিল ইরার এই পরিবর্তন দেখে। ধীরে ধীরে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেল তারা।

৪.
প্রায় দেড় মাস পরে রমাদান। ইরা এবারের রমাদানে সিয়াম পালন করবে ঠিক করেছে। আনিকার কাছ থেকে সলাত, পর্দা, সহীহ কোরআন শিখছে ইরা।

শুরু হলো তার আলোর পথে যাত্রা, উদ্যম গতিতে।

……………………
আলোর পথে যাত্রা
খাদিজা খাতুন

এপ্রিল ১৭, ২০১৮ইং