গত ১৫ দিন ধরে একটা তীব্র অস্থিরতা ভিতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে নবীনাকে। প্রেগ্ন্যান্সী স্ট্রীপে দুই দাগ দেখার পর থেকেই………কী হবে এখন! আদনান একটা ইন্টার্নশিপে অন্য শহরে গেছে, আসবে আরো দিন পনেরো পর। খুব প্রেস্টিজিয়াস একটা কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ এটা। যখন পেয়েছিলো তখন এতদিন মেয়েকে নিয়ে একা থাকতে হবে জেনেও খুব খুশি ছিলো ওরা দুজনেই। কিন্তু এখন এই সুযোগটাই গলার কাঁটা হয়ে বিঁধছে। যেমন নামীদামী কোম্পানী, তেমন খাটুনি। সারাদিনে একবার কথা হয় নাকি সন্দেহ। খবরটা জানিয়েছে ওকে, কিন্তু এমনই অবস্থা যে মন খুলে একটু কথা বলারও সুযোগ হয় নি এটা নিয়ে!
এদিকে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ইন ফ্যাক্ট নবীনা টেরই পায়নি এতদিন যখন পেয়েছে তখন প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেছে। হাল্কা অসুস্থতা ছিলো, কিন্তু একা একা মেয়ের দেখভাল করতে গিয়ে পাত্তাই দেয় নি সেসব। আজকে একাই গিয়েছিলো ডাক্তারের কাছে। ঊনি আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে দিলেন, সব কিছু ঠিকই আছে।
ফেরার পথে কী মনে করে দীপার কাছে গেলো। কারো সাথে প্রাণ খুলে কথা না বলতে পারলে দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে নবীনা।
দীপা খুব হাসিখুশী চঞ্চল টাইপ। মনটা খুব ভালো! ঘটনা শুনেই নবীনাকে জড়ায় ধরে বলে আরে বন্ধু এতো মারাত্মক আনন্দের খবর! আজকে এখানেই থেকে যা, আম্মুকে বলি মিষ্টি বানাতে! ওর এই খুশি দেখে নিজের অজান্তেই মেজাজ চড়ে গেলো নবীনার। ওর বলে টেনশনে ঘুম হচ্ছে না, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, আর ঊনি আছেন ঘটনা উদযাপনের ধান্ধায়!
আস্তে করে গলা থেকে ওর হাতটা সরিয়ে দিলো নবীনা। ওর এহেন রিঅ্যাকশনে কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে দীপা বললো কিরে তুই খুশী না?
ওর কণ্ঠের মাঝে এমন একটা আন্তরিকতা ছিলো যে এতদিনের অস্থিরতা, টেনশন সব চোখের পানি হয়ে অঝোরে বেয়ে পরতে লাগলো! ওকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলে নবীনা বললো আমার খুব ভয় লাগছেরে! অনন্যার বয়স তো মাত্র সাত মাস। এর মাঝেই আরেকটা বাবু হলে বিদেশে একা হাতে আমি সব সামলাবো কিভাবে! এত কম গ্যাপে দুইটা সিজার হলে নানা জটিলতাও হতে পারে শুনেছি। কিভাবে কী হয়ে গেলো কিছুই বুঝলাম না, আমরাতো যথেষ্ট সাবধানই ছিলাম!
ওকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ ওর কথাগুলো শুনলো দীপা। তারপর আলতো করে ওর চোখের পানি মুছে দিলো। তারপর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো তুই কি দেড় বছর আগের এই সময়টার কথা ভুলে গেছিস?
প্রথমে ওর কথাটা ঠিক বুঝলোনা নবীনা। দীপা কিছু বলছে না……ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। হঠাৎই বুঝতে পারলো দীপা কী বলতে চাইছে। আর তাতেই হঠাৎ বুকটা কেঁপে উঠলো ওর। নিজের অজান্তেই চোখটা নামিয়ে নিলো নবীনা।
দীপা ধীরে ধীরে বলে যেতে লাগলো- জীবনের দৃশ্যপটগুলো কি আমরা নিজের মত করে সাজাতে চাই? চারপাশে আর কত ঘটনা ঘটলে আমাদের হুশ হবে যে জীবনটা আমাদের মনের মত করে চলবে না?
দীপার শেষের কথাটার মাঝে এমন কিছু ছিলো যে নবীনার চোখে আবার পানি চলে এলো! সত্যিতো! এমন অকৃতজ্ঞ কিভাবে হতে পারলো নবীনা! বিয়ের প্রায় ছ বছর পর যখন অনন্যা পৃথিবীতে আসার ব্যাপারটা টের পেয়েছিলো, কী খুশিটাই না ও হয়েছিলো! কত অপেক্ষার প্রহর গুনেছে এই দিনটার জন্য। আর এখন অনুরূপ খবরে এত অস্থির হচ্ছে স্রেফ ঘটনাটা ‘ওদের পরিকল্পনা মত’ ঘটেনি বলে?
দীপা বলে চললো………অনন্যা পেটে থাকতে তোর কত কমপ্লিকেশন ধরা পড়েছিলো, কত অসুস্থ ছিলি তুই! আর এবার দ্যাখ চার মাস হয়ে গেছে তুই টেরই পাস নি! এটাই কি একটা বিশাল লক্ষণ না যে আল্লাহ কাউকে সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা দেন না? কত মানুষ একটা সন্তানের জন্য হাহাকার করছে তা কি তোকে বলে বোঝাতে হবে? তোর তো তাও একটা আশা ছিলো যে অপেক্ষা করলে একসময় সুসংবাদ মিলতে পারে, অনেকেরতো সেই অপেক্ষা করার দরজাটাও বন্ধ!
শেষের কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা একটু কি ধরে এলো দীপার? ওর এই হাশি খুশী চঞ্চলতার পিছনে কী গভীর একটা বিষাদ লুকিয়ে আছে তা কি আর অজানা নবীনার? বিয়ের দু বছরের মাথায় কার অ্যাক্সিডেন্টে দীপার হাজব্যাণ্ড মারা যাওয়ার পর থেকে দীপার মাঝে বিশাল পরিবর্তন এসেছে! ইসলাম পালন করা শুরু করেছে, ও প্রায়ই বলে যে ওই ঘটনাটা এখন ওর কাছে আল্লাহর রহমত মনে হয়, নাইলে তো ও ইসলামের ব্যাপারে সিরিয়াসই হত না!
দীপাকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে ফেললো নবীনা। কিন্তু এবারের কান্নাটা পুরা অন্যরকম! এটা একটা লজ্জা মিশ্রিত কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে উঠে আসা কান্না! জীবনের চিত্র নাট্যটা শ্রেষ্ঠ নির্মাতা নির্মাণ করছে এই অমোঘ সত্যটা মনে করে মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বললো নবীনা।
জীবনের চিত্রনাট্য
উম্মু যাইদ
এপ্রিল ০৫, ২০১৮ইং