সাদাকাহ

ফুলকো বেগুনীগুলো দেখলেই টুপ করে মুখে পুরতে মন চায়। ধোঁয়া ওঠা গরম গরম বেগুনীর শরীর থেকে আসছে মন মাতানো ঘ্রাণ। জিভে পানি এসে পড়ল রাঈয়ানের। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে জিভ কাটল ও। যাঃ আল্লাহ্ নারাজ হবেন। রোজা রেখে বুঝি খাবার কথা ভাবতে আছে? রাহেলা খালা একমনে বেগুনী ভাজছে। বিষন্ন মুখ খানা ভারি শুকনো দেখাচ্ছে তার। চোখ দুটো তার বেগুনীর মতই ফোলা।

আপনার খিদে পেয়েছে খালা? ইফতারের আর সত্তুর মিনিট বাকী। রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বলল রাঈয়ান।

শুষ্কভাবে হাসল রাহেলা। না বাবা, খিদা লাগেনি। তোমার লাগছে?
নাহ্, সজোরে মাথা নাড়ল রাঈয়ান। ঢোক গিলল একবার।
পিয়াস লাগছে বাবা?
নাহ তো, আগের চাইতেও জোরে মাথা নাড়ল রাঈয়ান।

এবার হেসে ফেলল রাহেলা। এতটুকু বাচ্চার ইবাদাতে কি আগ্রহ! ভাবতেই মনটা ভরে উঠল রাহেলার। নয় বছরে সবে পা দিল ছেলেটা। বাবা মা’র সাথে বায়না করেই রোজা রাখছে। বিকেলের পর থেকে বার বার ঢোক গেলে আর সময় দেখে কিন্তু কাউকেই কিছু বলে না।

মা কখন ফিরবে খালা? প্রশ্ন করল রাঈয়ান
ইফতারের আগেই আসব বাবা। চিন্তা কইরো না।
আচ্ছা। সুবোধ বালকের মত মাথা নেড়ে ব্যাট হাতে হলরুমে চলে গেল রাঈয়ান।
আহারে, মা আর সন্তানের কি গভীর টান!! বাবা আমার কেমন কইরা আমাকে ছাইড়া আছে? বুক চিরে নিঃশ্বাস বেরুলো রাহেলার।

প্রেসক্রিপশানগুলো ফাইলে রাখলেন ইয়াসমীন হক্ব। কপালের ভাঁজে দুঃশ্চিন্তা নয় বরং প্রগাঢ় বিষন্নতা। চিন্তা যতটা না নিজের তার চাইতে অনেক বেশী ছেলেটার জন্য। কত নেক আমল করার ছিল!! সময় তো আল্লাহ্ কম দেন নি, কিন্তু কাজে লাগাতে পারেন নি সেভাবে। এখন শুধু বিদায়ের অপেক্ষা! দু’মাস আগে ব্লাড টেস্টে ক্যান্সারের জীবাণু দেখা দিয়েছে তার। তখন থেকেই চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছেনা এখনও পর্যন্ত।

আপা, ইফতারির তো দেরী নাই, আসেন। রাহেলার ডাকে ফিরে তাকালেন ইয়াসমীন।

আসছি। স্মিত হাসলেন ইয়াসমীন। আজ তোমার কষ্ট হল তাইনা? আমি হেল্প করতে পারলাম না একটুও।
মাথা নেড়ে ইয়াসমীনের কথার প্রতিবাদ করল রাহেলা।
তোমার চোখগুলো আজ বড্ড ফোলা ফোলা লাগছে যে!

না, কিছু না। যোহরের পরে ঘুমাইছিলাম তো! ব্লেন্ডারে লাচ্ছি প্রস্তুতে মন দিল রাহেলা।
সেহরী সেরে ফজর পরে একটু ঘুম। তারপর ঘরের কাজ আরম্ভ করতে হয়। ইয়াসমীন হক্ব স্কুলটিচার। রামাদ্বানে স্কুল ছুটি থাকে৷সালাত শেষ করে আবার ওয়াশরুমে গেল রাহেলা। বের হবার মুখে ইয়াসমীন কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন থমকে দাঁড়াল ও। ইয়াসমীন হক্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
তোমার কি শারীরিক কোন সমস্যা আছে রাহেলা? স্বাভাবিক কন্ঠেই জানতে চাইলেন ইয়াসমীন।
না তো আপা। কোন সমস্যা নাই। শুকনো মুখে বলল রাহেলা।

আসার পর থেকেই দেখছি তুমি একটু পর পরই ওয়াশরুমে যাও। কোন অসু্বিধা হচ্ছে না তো?
মাথা নিচু করে ফেলল রাহেলা।
আমাকে বল তোমার কি সমস্যা হচ্ছে?
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ধীরে ধীরে রাহেলা যা বলল তার সারমর্ম হল-
বাংলাদেশে তার নয়মাসের একটি ছেলে আছে। স্বামি আজ বহুদিন হল নিখোঁজ। বউ-বাচ্চা কারই খোঁজ নেয়না। বৃদ্ধ বাবাও অসুস্থ। দুঃসহ অভাবের তাড়নায় ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে প্রবাসে আসতে বাধ্য হয়েছে গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়ে। সন্তান তার দুধ খেত। এখানে আসার পর জমানো দুধ ফেলে দিতে হচ্ছে একটু পর পর।

কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে রইলেন ইয়াসমীন। তার জীবনঘাতি রোগের কারণে ছেলেকে ছেড়ে অচিরেই হয়ত চলে যেতে হবে কোনদিন। আর রাহেলাকে জীবন যাপনের তাগিদে ছেলেকে ছেড়ে প্রবাসে আসতে হয়েছে!

নিজের চিকিৎসার জন্য জমানো টাকা হতে হিসেব মিলিয়ে রাহেলার তিন বছরের টাকা আলাদা করলেন ইয়াসমীন।

দেশে ফিরে যাও। ছেলে বড় হলে তারপর না হয় এসো আবার। তবে দো’আ করি আর যেন না আসতে হয়। দেশেই যেন আল্লাহ্ তোমাদের ভাল রাখেন। রাহেলার হাতে টাকা দিয়ে বললেন ইয়াসমীন।
হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রাহেলা। কিছুটা সময়….বাকরুদ্ধ রাহেলার চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝড়তে আরম্ভ করেছে।

আল্লাহু আকবার!! আমি আমার পনের বছরের মেডিকেল লাইফে এমন কেইস কখনই হ্যান্ডেল করিনি। আপনার রক্তে কোন জীবাণুই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। রিপোর্ট পুরোপুরি স্বাভাবিক। উচ্ছ্বসিত কন্ঠ ড.ফয়সালের।

পুরো শরীর জুড়ে কেমন ধাক্কা অনুভব করলেন ইয়াসমীন। কোন…. কোন ভুল তো হতে পারে ডক্টর!! কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন তিনি।
সে সম্ভাবনা নেই। আমরা একাধিকবার ল্যাব করেছি। পুরোপুরি শিউর হয়েই জানাচ্ছি আপনাকে।
বাঁধভাঙ্গা কান্নাটা চেপে রেখে টলমল পায়ে হসপিটাল থেকে বের হলেন ইয়াসমীন হক্ব। পুরো শরীর তার সাজদার জন্য আঁকুপাকু করছে। লুটিয়ে পড়তে মন চাইছে মহান রবের দরবারে। বার বার মনে পড়ছে-
রাসূল (সাঃ) বলেছেন- “সাদাকাহ্ পাপ মুছে দেয় যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়।“ (সহীহ্ আল জামিঃ-২৯৫১)

সাদাকাহ
জাকিয়া সিদ্দিকী

(২০/০৫/১৯)