খুব ক্ষীণ আওয়াজে সেলফোনের এলার্ম বেজে উঠলো। ঐটুকুন আওয়াজেই আনিতার ঘুম ভেঙে গেলো। বালিশের কাছ থেকে তাড়াতাড়ি সেলফোন নিয়ে এলার্মটা বন্ধ করে দিল সে, যাতে আদিলের ঘুম না ভাঙে।
আস্তে আস্তে গায়ের কাথা সরিয়ে খুব সন্তর্পণে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করলো আনিতা। বাথরুমে যাওয়ার সময় আস্তে করে দরজাটা লাগালো, যাতে একটুও শব্দ না হয়। বাথরুম সেরে ওজু করে বের হওয়ার সময় দরজাটাতে আওয়াজ হয়েই গেলো। ঘুম ভেঙে গেলো আদিলের।
বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো আদিল, ‘আবারো আজকে ঘুম ভাঙালে।’ কিছু বললো না আনিতা। অপরাধীর মত তাকিয়ে রইলো আদিলের দিকে। বুকের ভিতর দলা করে উঠা কষ্ট চোখের কোনায় জমা হতে শুরু করে দিয়েছে।
আদিল উঠে বাথরুমে গেলো। বাথরুমের কাজ শেষে সে আবার শুয়ে গেলো। আনিতা জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো তাহাজ্জুদের সালাতে। আনিতা কয়েকটাদিন ধরে তাহাজ্জুদের সময় উঠে সালাত আদায় করার চেষ্টা করছে।
বেশ কয়েকবছর ধরে তাদের নানারকম বিপদ একটার পর একটা এসেই যাচ্ছে। তার উপর আদিলের ইনকাম নেই এক ফোটা। টাকা পয়সা হাতে না থাকলে যা হয় আরকি। নানারকম বিপদ তো আসেই, সাথে থাকে মানুষের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, কারণ আজকাল কাছের মানুষ হোক বা দূরের মানুষ হোক, টাকাপয়সার পরিমাপ দিয়েই অন্যকে বিচার করে মানুষ, ফলে না চাইলেও অন্যের ব্যবহারে নিজেদের মন খারাপ থাকে তাদের।
আনিতার এক শিক্ষক জানেন তাদের অবস্থার কথা। তিনিই একদিন আনিতাকে বললেন, রাতের নামাজের কথা, মানে তাহাজ্জুদের কথা। তিনি আনিতাকে বুঝালেন তাহাজ্জুদের সালাতে যা চাওয়া হয় সেটা পাওয়া যায়। আল্লাহ্ প্রতি রাতের শেষ অংশে প্রথম আসমানে নেমে আসেন, বান্দাকে বলেন, কে আছো, আমার কাছে কি চাও, আমি সব দিবো। কিন্তু বান্দা ঘুমিয়ে থাকে। তিনি বুঝালেন, আনিতার বিপদে কেনো আনিতা তাহাজ্জুদ সালাতে আল্লাহ্’র সাহায্য চাচ্ছে না। উনার কথার প্রেক্ষিতেই কয়েকদিন ধরে তাহাজ্জুদ সালাতে উঠার চেষ্টা করছে আনিতা। কিন্তু খুটখাট আওয়াজে আদিলের ঘুম ভেঙে যায়, আর আদিল বিরক্ত হয়।
আদিলের বিরক্ত হওয়া নিয়ে কষ্ট পায় আনিতা। এমনিতেই তার অনেক কষ্ট আর অভিমান বুকে জমে আছে। সে তো শুধু নিজের জন্য চাইতে তাহাজ্জুদের সালাতে দাঁড়ায় না। সে তো সবার ভালো চায়। সে আদিলের জন্য চায়, বাচ্চাদের জন্য চায়, মা- বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, মুসলিম উম্মাহ, সবার জন্য ভালো চায়। আদিল যখন বিরক্ত হয়, তখন বুকের ভিতর জমে থাকা কষ্টের পাথরগুলো চোখের পানিতে গলে গলে বের হয়ে আসে।
আজকে তাহাজ্জুদে আনিতা অন্য কোনো দু’আ করতে পারছে না। শুধু একটাই দু’আ করছে আর চোখের পানি ঝরাচ্ছে। ‘আল্লাহ্, আদিল যেনো বিরক্ত না হয়, সে যেনো তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে’, বলেই যাচ্ছে একনাগাড়ে।
ইদানীং আনিতা তার কষ্টের কথাগুলো তাহাজ্জুদের সেজদায় বলে ফেলে আল্লাহ্কে। তার অভিমানের কথা, কষ্টের কথা অন্যকে কখনো বলে না সে। সে চায় না অন্য কেউ তার দুঃখগুলো নিয়ে হাসাহাসি করুক, উপেক্ষা করুক বা পাত্তা না দিক। তাহলে তো কষ্টগুলো আরো বাড়বে।
সেজদায় গিয়ে যখন নিজের কথাগুলো হাউমাউ করে চোখের পানি ফেলে বলে ফেলে, তখন মনে হয় বুকের জমাট ভাবটা কেটে যায়। অনেক হালকা লাগে মন। তার ভিতরে এক অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হয়। কোথা থেকে যেন শক্তি পায় সে, বুকের ভিতর বিশ্বাস জন্মে যে তার সমস্যার সমাধান হবে। সেজদায় দু’আ চাওয়ার মজা সে অনুভব করে।
আজকেও যখন হাউমাউ করে কেঁদেকেটে বুকের পাথর গলাচ্ছিল আনিতা, তখনো সে ভাবতেও পারেনি পরেরদিন তার জন্য কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল।
পরেরদিন খুব সাবধানে উঠে বাথরুম থেকে ওজু করে এসে আনিতা দেখে, ঘুম ভেঙে বিছানার উপর আদিল বসে আছে। কোনো কথা না বলে আনিতার দিকে তাকিয়ে বাথরুমে গেলো সে।
আনিতার বুকে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হচ্ছে। কি জানি কি হয়। এত গম্ভীর কেনো আদিল। পানি খেলো আনিতা। জায়নামাজ বিছাতে বিছাতেই বাথরুম থেকে আদিল বের হয়ে আসলো। নিজের জায়নামাজটা নিয়ে আনিতার পাশেই বিছিয়ে দিলো আদিল। বিশ্বাস করতে পারছে না আনিতা। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আদিলের দিকে। শুধু বললো, ‘কি হয়েছে তোমার?’ উত্তরে আদিল বললো, ‘তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করবো’।
আনিতা ভাবতেও পারেনি এত তাড়াতাড়ি আল্লাহ্ তার দু’আ কবুল করবেন। চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেলো তার। চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই সে সাথে সাথে শুকরানার সেজদা দিল।
এরপর আনিতার তাহাজ্জুদের সেজদায় করা আরো অনেক দু’আ কবুল হয়েছে। সেগুলোর গল্প না হয় আরেকদিন বলবো ইন শা আল্লাহ্।
(সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা।)
পুনশ্চঃ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অত্যন্ত পছন্দের একটি ইবাদত হল তাহাজ্জুদের সালাত। অনেকে ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও এই ইবাদতটি অভ্যাসে পরিণত করতে পারেন না। উত্তম এ কিয়ামুল লাইলকে দৈনন্দিন জীবনের অংসে পরিণত করার জন্য, ইন শা আল্লাহ্ রামাদান হতে পারে শ্রেষ্ঠ সময়।
সারপ্রাইজ
-তাহনিয়া ইসলাম খান
(১৫/০৫/১৯)