পর্ন আসক্তি মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি সৃষ্টি করে তা হল, এটি কিশোরদের মাঝে ভালবাসার সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে। পর্দায় আমরা যা দেখি সেটাকেই অনুকরণ করতে চেষ্টা করি। মিডিয়া আমাদের জীবনদর্শনকে ভীষনরকম প্রভাবিত করে। এইসব কিশোর-কিশোরীরা যৌনতা নিয়ে অবাস্তব, অতিরঞ্জিত ধারণা নিয়ে বড় হয়। যৌনশিক্ষার প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে গেছে পর্ন।
কিশোর-কিশোরীরা যৌনতা নিয়ে জানার জন্যও পর্ন দেখে। যৌনতা নিয়ে পূর্ব ধারণা না থাকায় পর্নে তারা যা দেখে সেটাকেই বাস্তব মনে করে।
বর্তমানে পর্নোগ্রাফিতে প্রচুর পরিমাণে নারীর উপর সহিংসতা থাকে এবং দেখানো হয় যে পর্ন অভিনেত্রীরা সেসব উপভোগ করছে। পর্ন দেখার ফলে নারীকে শুধুই একটা বস্তু মনে হয় এবং পর্ন আসক্তরা মনে করতে শুরু করে যে এভাবেই বুঝি সম্পর্ক গড়তে হয়।
মানুষ যা ক্রমাগত দেখতে থাকে এবং পছন্দ করতে থাকে একসময় সে সেটা বাস্তবেও করতে চায়। এইসব কিশোররা একসময় আশপাশের সমস্ত নারীকে নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগতে শুরু করে। সুযোগ পেলে এরাই হয়ে যেতে পারে একজন রেপিস্ট।
সেই সাথে, ক্রমাগত মাস্টারবেশন তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে এবং এই অভ্যাস একজন মানুষের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এরপর সমস্যা শুরু হয় বিয়ের পর। তারা পর্ন অভিনেতাদের মতো আচরণ করতে চায় স্ত্রীর সাথে এবং পর্ন অভিনেত্রীদের মতো আচরণ চায় স্ত্রীর কাছ থেকে। যৌন জীবন সম্পর্কে অবাস্তব ধারণার ফলে দাম্পত্য জীবনে নামে হতাশা এবং ভাঙ্গন। এটা হতে পারে যদি তার জীবন বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় তবে।
কিন্তু তার আগেই পর্ন আসক্তরা জড়িয়ে যায় কলুষিত জীবনে। তারা ভুলে যায় যে কোন সম্পর্ক গড়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে বিয়ে। বিকৃত যৌনতায় পূর্ণ নানা যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তারা। ক্রমাগত বিকৃত ভিডিও দেখতে দেখতে একসময় তারা এই বিকৃতির প্রতি ডিসেনসিটাইয হয়ে পড়ে।
শিশু পর্ন, রেপ পর্নের মতো জিনিসগুলোও হয়ে পড়ে তাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যপার। ফলে তারা সহিংস ঘটনাও ঘটাতে পারে যার অল্প কিছুই মাঝে মধ্যে পত্রিকায় আসে আর বেশিরভাগটাই রয়ে যায় অন্তরালে।
এই পর্যন্ত পড়ে হয়ত ভাবছেন, এর সমাধান কী? যাদের সন্তান ইতিমধ্যেই আসক্ত তাদের জন্য কিভাবে বুঝবেন আসক্ত কিনা, কিভাবে সন্তানের সাথে এই নিয়ে কথা বলবেন (পর্নের ক্ষতিকর দিকটা সন্তানকে বুঝিয়ে বলা অত্যন্ত জরুরী) এবং পর্ন আসক্তি কাটানোর জন্য কিছু টিপস নিয়ে আলোচনা করা আছে “মুক্ত বাতাসের খোঁজে” বইতে। আমি আর এখানে সেসব নিয়ে বলছি না।
যাদের বাচ্চারা এখনো ছোট, তারা কিভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন আসুন সেই নিয়ে জানি।
প্রথমেই, নিজেদের জীবনে আল্লাহকে ভয় করে চলতে চেষ্টা করতে হবে। সেই সাথে সেইসব অভ্যাসকে ছাড়তে হবে যা অশ্লীলতাকে ঢোকার পথ করে দেয়।
পরিবারের সবাই একসাথে বসে টিভিতে বিভিন্ন দেশ-বিদেশের চ্যানেলে সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, সিনেমা, আইটেম সং দেখা বাদ দিতে হবে। এসব চলাকালীন আপনার সন্তানের মুখের দিকে শুধু লক্ষ্য করবেন, তাহলেই বুঝবেন আপনি যা অবলীলায় দেখে যাচ্ছেন তা তার ছোট মনে কত গাঢ় প্রভাব ফেলছে।
বর্তমানে পত্রিকাগুলোর পাতায় অনেক অশালীন ছবি ছাপানো হয়। পর্নস্টারদের খবর এখন পত্রিকার পাতাতেই পাওয়া যায়। তাই ঘরে পত্রিকা ও আশালীন ছবিযুক্ত ম্যাগাযিন না রাখতে চেষ্টা করতে হবে বা বাচ্চার কাছ থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করতে হবে। খবর পড়তে চাইলে ইন্টারনেটেই পড়তে পারেন।
সন্তানকে ছোট বয়সে পার্সোনাল গ্যাজেট দেবেন না। একদম ছোট থেকেই তার স্ক্রিণ আসক্তির পথ রোধ করতে চেষ্টা করুন কারণ এটাই একসময় পর্ন আসক্তিতে রূপ নিতে পারে।
তার কোন প্রয়োজনে বাসার কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ব্যবহার করতে হলে এমন জায়গায় করতে দিন যেখানে বসলে সহজেই স্ক্রিন দেখা যায়। তার স্ক্রিন টাইম নির্ধারন করে দিন।
কম্পিউটারে বা মোবাইলে কিভাবে পর্ন সাইট, বাজে বিজ্ঞাপন ঢুকতে দেয়া রোধ করা যায় এই নিয়ে Lostmodesty ওয়েবসাইটে আর্টিকেল আছে, দেখতে পারেন। সন্তানকে দৃষ্টির হেফাযত করা, পর্দার গুরুত্ব শেখান।
বিপরীত লিঙ্গের সহপাঠী, আত্নীয়দের সামনে, সেটা সমবয়সী কাযিন হলেও, পর্দা করার কথা বলুন। তাকে লজ্জা, শালীনতাবোধ শেখান।
কন্যাশিশু যত ছোটই হোক তাকে বলিউড নায়িকাদের মতো পোশাক পরানো অনুচিত। এসব অনেক কিছুই আপনার বেশি বেশি মনে হতে পারে কিন্তু আমাদের প্রজন্ম সাক্ষী এসব না মানার ফল কত মারাত্মক হতে পারে!
সন্তানকে সময় দিন প্রচুর। সন্তানকে রেখে বাইরে গেলে সে কার কাছে কিভাবে থাকবে, সেটা আপনার মূল্যবোধের সাথে মিলবে কিনা ভেবে দেখুন।
তেমন উপযুক্ত কেউ না থাকলেও শুধুমাত্র “পড়াশোনা করেছি কিছু একটা করব” এই চিন্তা থেকে বাইরে যাওয়া আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য আশংকার কারণ কিনা বিচার করে দেখুন।
সন্তান একটু বড় হওয়ার পর সে কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, কী খেলে, কী নিয়ে গল্প করে এসব জানতে চেষ্টা করুন। কেউ আপত্তিকর কিছু দেখাতে বা শোনাতে চাইলে তাকে “না” বলতে শেখান।
ছোট থেকেই প্রোডাক্টিভভাবে সন্তানকে সময় কাটাতে শেখান। ভালো হবি খুঁজে দিন। ভালো বই পড়া, খেলাধুলা, ব্যয়ামে উৎসাহিত করুন। অবসর সময়কে কাজে লাগাতে শেখান কারণ অবসরেই অনেকসময় মানুষ অনৈতিক কাজের পথে পা বাড়ায়। সন্তানকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যান। হালাল বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিন।
সিনেমার নায়কদের পরিবর্তে ইসলামের নবী, রাসুল, সাহাবাদের ও ইসলামি ইতিহাসের বীরদের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিন। ভালো রোল মডেল দিন তার সামনে। মিডিয়া যেভাবে পর্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের “স্টারে” পরিণত করেছে তাতে ভালো রোল মডেল এই প্রজন্মের জন্য খুব দরকার।
ছেলে হোক, মেয়ে হোক, বয়ঃসন্ধির শুরুতেই তাকে ইসলামের হুকুম আহকাম নিয়ে জানান। বর্তমান সময়ের প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে ফরয গোসল, পিউবিক হেয়ার কাটা, মাস্টারবেশনের মতো বিষয়গুলোর প্রয়োজনীয় বিধানগুলো নিয়ে জানেনা। অথচ এগুলো ছিল বেসিক বিষয় যা তাদের পরিবার থেকেই জানা উচিত।
আমাদের প্রজন্ম এসব জ্ঞান পরিবার থেকে না জানার ফলে বন্ধু বান্ধবের থেকে জেনেছে, ছেলেরা বিশেষ করে। এর ফল ভালো হয়নি একদমই। আর বর্তমান প্রজন্মের সামনে আছে আরেকটি নতুন চ্যালেঞ্জ।
শিশুদের যৌন শিক্ষা দেয়ার নামে এক বিশাল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। মানুষকে যদি স্বাভাবিক যৌনতার ধারণা বদলে অস্বাভাবিক যৌনতায় অভ্যস্ত করে ফেলা যায় তাহলে নানারকম বিকৃত যৌনক্রিয়ার কাস্টমার পাওয়া যাবে।
শিশুকামের স্বপক্ষে কাজ করা তিনটি সংস্থা জাতিসংঘের স্বীকৃতি বাগিয়ে নিয়েছে এবং শিশুদের স্কুলে যৌন শিক্ষা দেয়ার নামে তারা নারীপুরুষের সম্পর্কের, এমনকি নিজ দেহের বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কে খোলামেলাভাবে এমন কিছু শেখাতে চাচ্ছে যা আমরা টিভিতে প্রদর্শন করলেও আশালীন মনে করি।
অথচ এসবই তারা কারিকুলামে রাখতে বলছে যার কিছু বিষয় অনলাইনেও শেখানো হয়, বাবা-মায়ের অগোচরে। একে Comprehensive Sexuality Education Agenda বলা হয় যা স্বাস্থ্যকর, প্রমাণনির্ভর দাবী করে এবং বিভিন্ন প্রতারণাপূর্ণ আপাতঃ ভালো ও উপকারী নামে চালু আছে, যেমন যৌন শিক্ষা।
বিশ্বের কিছু দেশ সচেতন হয়ে একে প্রতিরোধ করেছে। আরও অনেক বেশি জনসচেতনতা প্রয়োজন। বিবিসি নিউজ বাংলার করা একটি রিপোর্ট বলছে বাংলাদেশে সাড়ে তিনশ স্কুলে ২০১৪-২০১৮ পর্যন্ত একটি প্রকল্প চালু ছিল যা পশ্চিমা দেশের যৌন শিক্ষার আদলে তৈরি
যদিও যারা এটি চালু করেছে তারা একে এই নামে বলতে চায় না। তারা এর নাম দিয়েছে “জেনারেশন ব্রেকথ্রু”। যেসব দাতা সংস্থা এটি চালু করেছে তাদের পরিকল্পনা আছে ভবিষ্যতে আরও বেশি স্কুলকে এতে যুক্ত করার ও আস্তে আস্তে দেশের সব স্কুলে এই প্রকল্পের কোর্সটি বাধ্যতামূলক করার।
তাদের সেই পরিকল্পনা মোতাবেক সরকার ২০১৯ সাল থেকে এই কোর্সের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করতে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে আগামী বছরগুলোতে দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের সব স্কুল ও মাদ্রাসায় এটি শুরু করার পরিকল্পনা করেছে।
বাংলাদেশের মতো অসচেতন জনগোষ্ঠীকে সহজেই টার্গেট করা যায়। যদিও খবরে প্রকাশিত যে বাংলাদেশের যে সব স্কুলে এই কোর্স শুরু হয়েছিল সেখানের ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে।
কিন্তু আমাদের মাথায় রাখা দরকার যে পশ্চিমাদের আমদানিকৃত আইডিয়াগুলো সবসময়ই প্রথমে দারুণ কিছু বলে ভ্রম হয়, পরবর্তীতে পচনের গন্ধ এসে নাকে লাগলে আমাদের টনক নড়ে।
The War on Children: The Comprehensive Sexuality Education Agenda ডকুমেন্টারিতে উঠে এসেছে যে বিভিন্ন দেশে যখন এই কোর্স চালু করা হয়েছে তখন দেখা গেছে অনেক কিছু অনলাইনে শেখানোর কারণে বাবা-মা হয়ত জানতেও পারবে না সন্তানরা স্কুল থেকে কী শিখে আসছে!
অথচ এই জ্ঞানটা বাবা-মাই পারেন ঘর থেকে সন্তানকে দিতে তার প্রয়োজন ও বোঝার উপযোগী করে, সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধ যোগ করে।
২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে গড়ে দিনে ৩,২৭১টি গর্ভপাত হয়েছে। ১৬-১৯ বছর বয়সী ১৫০ জন স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে তাদের শতকরা ৬০% ছেলেমেয়ের অনিয়ন্ত্রিতভাবে যৌনমিলনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
যৌনতা, পর্ন এসব আমাদের সমাজে ট্যাবু শব্দ। কিন্তু আমরা চুপ করে চোখ-কান বন্ধ করে রাখলেই এই সংক্রান্ত সমস্যা মিলিয়ে যাচ্ছে না। অশ্লীলতার প্রতি আমাদের শিথিলতা অনেক বড় ক্ষতি ডেকে আনবে গোটা মানবজাতির জন্য।
স্বীকার করে নিন যে আমাদের সমাজ এখন অনেক বেশি যৌনায়িত, রাস্তার বিলবোর্ড থেকে শুরু করে পত্রিকা, শিশুতোষ কার্টুন পর্যন্ত সব জায়গায় যৌনতা প্রবেশ করেছে। সন্তান পর্ন দেখছে মানেই সে বখে গেছে এই অভিমান করার আর সময় নেই।
আপনার দেয়া সাধারণ মোবাইল বা ট্যাব দিয়ে আপনার সন্তান আলগোছে নেট ব্রাউজ করার সময় হঠাতই কোন বাজে বিজ্ঞাপন চলে আসা বা পর্ন সাইটের খোঁজ পেয়ে যাওয়া এখন অতি সাধারণ বাস্তবতা।
বাবা-মাকেই সচেতন হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সন্তানের সুস্থ ভবিষ্যতের জন্য। কিভাবে সহজভাবে এই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় সন্তানের সাথে এই নিয়ে Lostmodesty এর ওয়েবসাইটে ভালো আর্টিকেলও আছে।
হতে পারে পর্ন ইন্ডাস্ট্রি অনেক প্রভাবশালী, বিদেশী দাতা সংস্থার হাত অনেক লম্বা কিন্তু প্রত্যেকে নিজ পরিবারের সংরক্ষণের প্রতি সচেতন হলে এভাবেই একটা একটা করে জীবন ও পরিবার রক্ষা পাবে ইনশাল্লাহ।
তথ্যসূত্রঃ
১। Lostmodesty ওয়েবসাইট (http://lostmodesty.com/)
২। পিডিএফ বই “মুক্ত বাতাসের খোঁজে” (http://lostmodesty.com/2018/09/lmpdf1/)
৩। ইউটিউব ভিডিও “পতনের আওয়াজ পাওয়া যায়” (https://www.youtube.com/watch?v=VlWB0yQhzII)
৪। বিবিসি নিউজ বাংলার রিপোর্ট “স্কুলে যৌন শিক্ষা: বাংলাদেশে ‘জেনারেশন ব্রেকথ্রু’ প্রকল্পের ক্লাসরুমে যা পড়ানো হচ্ছে” (https://www.bbc.com/bengali/news-47694959)
৫। বাংলা ট্রিবিউনের নিউজ “দেশের সব স্কুল-মাদ্রাসায় চালু হচ্ছে যৌন-প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা” (http://www.banglatribune.com/national/news/
৬। ডকুমেন্টারি The War on Children: The Comprehensive Sexuality Education Agenda (http://www.drjudithreisman.com/…/20…/03/the_war_on_chil.html)
পর্ন যখন এক ক্লিক দূরে-২
রাবেতা রওশীন
অগাস্ট ৩১, ২০১৯ইং