“পতনের আওয়াজ পাওয়া যায়” নামে একটি ইউটিউব ভিডিও চোখে পড়ে একদিন হঠাৎই। ভিডিওটা দেখে টিনএজারদের মাঝে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া পর্নোগ্রাফি নিয়ে একটা ভালো ধারণা পাওয়া যায়। অনেকগুলো শকিং স্ট্যাটিস্টিক্স জানতে পারি।
জানতে পারি যে এখনকার দিনে কিশোর-কিশোরীরা খুব সহজেই পর্নোগ্রাফি এডিক্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি কেউ ভালো থাকতে চাইলেও পিয়ার-প্রেশার তাকে সেটা থাকতে দিচ্ছে না।
ভিডিওটার শেষে নিষ্পাপ চেহারার এক কিশোর বলছিল যে তারা যেভাবে জীবনটা গড়তে চায় সেভাবে হয়ত তারা পারবে না যদি এগুলোতে দিন দিন আরও বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে। খুবই মন খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো একটা কথা!
ভিডিওটা বানিয়েছিল Lostmodesty নামে একটা দল। আগ্রহী হয়ে ওদের আরও কাজের খোঁজ করতে পেয়ে গেলাম ওদের Lostmodesty নামে ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ যেটার নাম “পর্নোগ্রাফিঃ মানবতার জন্য হুমকি”।
হাতে পেলাম ওদের প্রকাশিত বই “মুক্ত বাতাসের খোঁজে” যেটার পিডিএফ ভার্সন ওদের সাইটে ফ্রি দেয়া আছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ওরা নিজেদের কন্টেন্ট সাজিয়েছে। যতই পড়লাম পর্নোগ্রাফি নিয়ে আমরা ধারণা বদলে গেল!
পর্নোগ্রাফি শুধুই নারীকে বস্তুরূপে প্রদর্শন না। এটা শুধুই নারীর অবমাননা না। এর বিস্তৃতি আরও ব্যাপক, আরও বিধ্বংসী কারণ এটা অগোচরেই একদম ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে পারে এবং সকলের অজান্তেই ধীরে ধীরে একটা তরতাজা জীবন ক্ষয় করে ফেলতে পারে।
পর্নোগ্রাফির সাথে লাখ লাখ মানুষের রুটি-রুজি জড়িত, অর্থনীতি জড়িত। পর্ন ইন্ডাস্ট্রি বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লাভ করে। বছরে তারা লাভ করে ১৫ বিলিয়ন ডলার যেখানে হলিউডের লাভ ১০ বিলিয়ন ডলার!
এর সাথে মানবপাচারের রয়েছে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পর্নোগ্রাফি মানবপাচারের চাহিদা বৃদ্ধি করে যেখানে শিশু ও নারীরাই মূলত টার্গেট যাদের পরবর্তীতে ইউরোপ, আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে যৌনসাদীতে পরিণত করা হয়, কারণ পর্নোগ্রাফি যে বিকৃত যৌনাচার দেখায় সেটা স্বাধীন মানুষের ওপর মেটানোর সুযোগ কম।
পর্নোগ্রাফির প্রচার প্রসারে রয়েছে বিশাল এক জনগোষ্ঠির প্রভাবশালী হাত। যেখানে এত বিশাল পরিমাণ লাভ জড়িত সেখানে বুঝতে আর অসুবিধা হয় না মানুষকে ধবংস করার কাজে মানুষই কেন এমন উঠেপড়ে লেগেছে!
Lostmodesty এর কাজে তারা সন্তান, বাবা, ভাই, স্বামী বা স্ত্রী (অবাক করা মনে হলেও সত্যি যে মেয়েরাও পর্ন দেখে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট পর্ন দেখা দেশের তালিকায় এবং পর্নের মহিলা-দর্শক সংখ্যা এই দুই দিক থেকেই ইন্ডিয়ার অবস্থান তৃতীয়।
ইন্ডিয়ার আরেকটি বৈশিষ্ট হচ্ছে এখানে রেপ পর্ন অত্যন্ত জনপ্রিয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন সেখানে রেপের সংখ্যা এত বেশি। ইন্ডিয়াকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করা আমাদের দেশের মানুষরাও, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, পর্নের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে এবং আমাদের দেশেও ভয়ানক সব রেপের ঘটনা দিন দিন বাড়বে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।), বন্ধুসহ সব শ্রেণীর মানুষকে এই সমস্যার আওতায় এনে কথা বলেছে।
ওদের কাজ থেকে উপকৃত হয়ে অনেকে এই অন্ধকার জগত থেকে বেরিয়ে এসেছে আলহামদুলিল্লাহ্ এমন বেশ কিছু নজিরও আছে। সত্যিটা হচ্ছে অনেকেই হয়ত একটা সময় পরে এই আসক্তি থেকে মুক্তি চায় কিন্তু একা একা লড়াই করা সম্ভব হয় না, বের হয়ে আসার পথ জানা থাকে না আবার লোকলজ্জার ভয়ে কারও কাছে সহায়তাও চাইতে পারে না।
Lostmodesty এগিয়ে এসেছে এই প্রয়োজনীয় শূন্যস্থান পূরণ করতে। আল্লাহ্ তাদের কাজ কবুল করুক, অনেক বেশি বারাকাহ দিক। ওরা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজে গিয়ে এই বিষয়ে ক্যাম্পেইন করছে, অনেককে এই আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করছে। ওদের ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজে গেলে এই নিয়ে আরও জানা যাবে।
তবে, আমি আজকে বলতে চাই সন্তানকে কিভাবে এই বিষাক্ত জগত থেকে দূরে রাখা যায় তা নিয়ে।
প্রথমেই আসুন কিছু পরিসংখ্যান দেখি।
বাংলাদেশে ২০১২ সালে অষ্টম শ্রেণীর কিছু ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে গবেষণা করা হয় যাদের মাঝে ৭৬% শিক্ষার্থীর নিজের ফোন আছে। এর মাঝে ৮২% সুযোগ পেলে পর্ন দেখে এবং ৬২% ক্লাসে বসে দেখে। লক্ষ্য করুন, এটা ২০১২ সালের কথা!
“মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন” পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ঢাকার ৭৭% কিশোর পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। সিকিউরিটি টেকনোলোজি কোম্পানি Bitedefender এর গবেষণা মতে পর্ন সাইটে ঢোকা প্রতি ১০ জনের মাঝে ১ জনের বয়স ১০ বছরের নিচে এবং তারা রেপ পর্নের মতো ভয়ানক সব পর্ন দেখছে!
প্রথমবার পর্ন মুভি দেখার গড় বয়স ১১ এবং সবচেয়ে বেশি পর্ন আসক্ত ১২-১৭ বছর বয়সীরা!
নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পারছেন অবস্থা কতটা ভয়াবহ। আরও ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, বেসরকারি এক হিসাব দেখাচ্ছে যে ফটোকপি আর মোবাইল ফোনে গান/রিংটোন ভরে দেয়ার দোকানগুলো থেকে দেশে প্রতিদিন ২.৫ কোটি টাকার পর্ন বিক্রি হচ্ছে।
২০১৩ সালে BSS প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ঢাকার সাইবার ক্যাফে থেকে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পর্ন ডাউনলোড করা হয় তার মূল্য ৩ কোটি টাকার মতো। লক্ষ্য করুন, এটা ২০১৩ সালের কথা। এখন ওয়াইফাইয়ের যুগে পর্ন তো একদম ঘরের ভেতর হাতের মুঠোতেই। মাদকের চাইতেও এর বিস্তৃতি বেশি, ধবংস করার ক্ষমতা ব্যাপক।
ইন্টারনেটে সহজ প্রবেশাধিকার দিয়ে ইনডেক্স করা আছে ৪৫০ মিলিয়ন পর্নোগ্রাফিক সাইট। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের কারণে শিশুদের কাছেও অপ্রত্যাশিতভাবে চলে আসছে এসব সাইটের সাজেশন। আশীর্বাদের পরিবর্তে প্রযুক্তি হয়ে পড়ছে অভিশাপ।
বন্ধুদের মাধ্যমে হাতেখড়ি হোক বা কম্পিউটার গেম অথবা ইউটিউবে ঘোরাঘুরি করার সময়ই হোক, প্রথমবার পর্ন দেখার ফলে যে সাময়িক ভালো লাগাটা মস্তিষ্ক অনুভব করে সেটাই সে আবার পেতে চায়। পর্নোগ্রাফি তাই মস্তিষ্কে মাদকের মতোই কাজ করে।
পর্ন দেখার সময় মস্তিষ্কে ডোপামিন রিলিজ হয় ফলে একটা ভালো লাগার অনূভুতি সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্ক তখন যে কাজটায় ডোপামিন রিলিজ হয়েছিল আবারও ভালো লাগানোর জন্য সেই কাজের কাছে ফিরে যেতে চায়। তখন মানুষ আবারও পর্ন দেখে। বার বার ফিরে যায় এর কাছে।
কিন্তু অবস্থা আরও দূর পর্যন্ত যায়। কারণ এভাবে চলতে চলতে অতিরিক্ত ডোপামিন রিলিয হলে মস্তিষ্ক আর আগের মতো ওই একই জিনিসে উত্তেজিত হয় না। মানে একই জিনিসে আনন্দের মাত্রা কমে যায়।
মস্তিষ্ক তখন আবার আগের মতো আনন্দিত হওয়ার জন্য আরও “কড়া” কিছু খোঁজে। এভাবেই সফটকোর পর্ন থেকে একজন মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে হার্ডকোর পর্নে। আইটেম সং দিয়ে যার শুরু সেটা গিয়ে পৌঁছে শিশু পর্ন, সমকামী পর্ন, রেপ পর্নের মতো জঘন্য জিনিসে। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন, বর্তমানের আইটেম সংকে সফটকোর পর্নের সাথে তুলনা করা যায়।
এভাবেই পর্ন আসক্তি মূলত একজন মানুষের মস্তিষ্কের গঠন বদলে দেয়। সে যত বেশি পর্ন দেখবে তার মস্তিষ্কের তত বেশি ক্ষতি হতে থাকবে এবং সেই ক্ষতি পূরণ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা তার জন্য দুরূহ হয়ে যায় কারণ আমাদের দেহের নার্ভ সেল কখনো পুনরায় তৈরি হয়না।
এবার আসুন দেখি শিশু-কিশোরদের ওপর পর্ন দেখার অন্যান্য ক্ষতিকর দিকগুলো কী।
পর্ন দেখলে একাডেমিক পড়াশোনা খারাপ হয়। কিশোরদের পর্ন দেখার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়লে ছয় মাসের মাঝে রেজাল্ট খুব খারাপ হয়ে যায় এটা গবেষণায় পাওয়া গেছে। পর্ন আসক্তির পেছনে ব্যয় করতে হয় অনেকটা সময় ও শ্রম। এরপর অনুভূত হয় মানসিক শূন্যতা। অন্য কোন কাজে অনীহা। শুধু পর্ন নিয়ে থাকতেই তখন ভালো লাগে। তাই পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া আর হয় না।
পর্ন আসক্তির ফলে জন্ম নেয় হতাশা আর উদ্বিগ্নতা। জীবনের নির্মল সময়টায় এই বিষয়গুলো নিয়ে জেনে ফেলা মনের ভেতর তৈরি করে জটিলতা। মনের মাঝে জমে অবসাদ আর গ্লানি। পর্ন আসক্তির ফলে কিশোররা বাহিরের জগত সম্পর্কে অকারণ ভয় পায়, তারা অসামাজিক হয়ে পড়ে, একাকীত্বে ভোগে। এই হতাশা আর একাকীত্ব থেকে শুরু হয় মাদকের জগতে পা বাড়ানো।
শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ বাঁধা পায়। পর্ন আসক্তি নিয়ে যায় মাস্টারবেশনের দিকে যা ক্রমে নষ্ট করে দেয় স্বাভাবিক যৌন ক্ষমতা।
চলবে….
পর্ন যখন এক ক্লিক দূরে-১
রাবেয়া রওশীন
অগাস্ট ৩০, ২০১৯ইং