হজ্জে করণীয় এবং বর্জনীয়

হজ্জে কাবাঘরকে খুব কাছ থেকে, মনভরে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু কাবাঘর এত কাছে থেকেও চোখে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে, কাছে যাবার উপায় নাই। মানুষ আর মানুষ! এত কাছে তবুও দূরে। চাইলেই ধরা যায়না। তবে বলে রাখি কাবা ঘরে নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ছাড়া বাকি অংশগুলোতে ধরা,ছোয়া বা চুমু খাওয়া সুন্নতসম্মত না।
যারা হজ্জে বা ওমরাহ্‌ করতে যাবেন, তাদের কিছু জিনিস জেনে যাওয়া আবশ্যক।

যেমন, দুয়া কবুলের স্থান, সময়, নিষিদ্ধ কাজ, বিদআত, শিরক। একই কাজ স্থানভেদে ইবাদত আবার বিদআত।
যেমন, কাফেলা থেকে মক্কা, মদিনার অনেক জায়গায় ঘুরে দেখাতে নিয়ে যাবে।
মক্কায়
* জাবালে সূর (পাহাড়)
* জাবালে নূর (এই পাহাড়ে হেরা গূহায় পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছিল)
* জাবালে রহমত (আরাফার ময়দানের পাহাড়), 
জান্নাতুল মুয়াল্লা (বিবি খাদিজা সহ নবীজি (সাঃ) এর পরিবারের অনেক সদস্যদের কবর আছে, হাজিদেরকেও এইখানে কবর দেয়া হয়)
* হুনাইনের যুদ্ধ এ শহীদদের কবরস্থান
* মসজিদে জি’রানা ।
এসব জায়গায়, বড়বড় পাথর, পাহাড়গুলোর কাছে দাঁড়িয়ে কেউ একাকী, কেউ দলবদ্ধ ভাবে হাত তুলে দোয়া করছেন। যেহেতু নবিজী (সাঃ), এবং সাহাবীরা এই কাজ করেননি, তাই এসব জায়গায় দোয়া করা ঠিক না। একই কথা কবরস্থান এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মেয়েদের কবরস্থান এ যেতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে কবর জিয়ারত এর প্রশ্নই আসেনা।

★ দুয়া কবুলের স্থান এবং সময়ঃ

* মুলতাযামঃ শব্দের অর্থ “আকড়ে ধরার স্থান”। এটি হাজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজার মধ্যবর্তী জায়গা। এখানে আকড়ে ধরে দুয়া করা সুন্নাহ, এটি দুয়া কবুলের অন্যতম স্থান।
* হাতীমঃ শব্দের অর্থ “ভাঙা বা ভগ্নাংশ”। অর্ধ বৃত্তাকার একটি জায়গা। এটি কাবাঘর এর অংশ। এখানে ২ রাকাত সালাত আদায়ে কাবার ভিতর সালাত আদায়ের নেকি পাওয়া যায়। এখানে দুয়া কবুল হয়।
* মীযাবে কাবা বা মীযাবে রহমতঃ এটি কাবার ছাদ থেকে পানি পড়ার নল। হাতিমের ভিতরে, এটি দুয়া কবুলের জায়গা।
* তাওয়াফ ও সাঈ করার সময়
* জমজমের পানি পানের সময়
* সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের উপরে বা কাছে
* মিনায়
* ৯ জিলহজ্জ আরাফার ময়দান
* ছোট ও মধ্যম জামারায় পাথর মারার পর
* মদিনায়ঃ রওদাতুল জান্নাতে।

★ সম্পূর্ণ হজ্জ সফরে একমাত্র “হাজরে আসওয়াদ ” ছাড়া আর কোথাও চুমু খাওয়ার কোন বর্ননা সহিহ হাদিস থেকে পাওয়া যায়না। হাজরে আসওয়াদ সেই পাথর যা জান্নাত থেকে আনা। এই পাথরের আলাদা কোন বিশেষত্ব নাই ; কিন্তু নবিজী এই পাথরে চুমু দিয়েছিলেন। কিন্তু এর থেকে রহমত বা বরকত পাওয়ার আশা করা যাবেনা। আল্লাহর দয়া এবং রহমত প্রাপ্তির জন্য শুধুমাত্র বায়তুল্লাহ শরীফে দোয়া এবং জমজমের পানি খেতে হবে।

★এছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান

রুকনে ইয়ামনিঃ হাজরে আসওয়াদ যে প্রান্তে তার আগের প্রান্তকে বলা হয়। এখানে স্পর্শ করা যাবে।তবে ওখানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বা চুমু খাওয়া বা ইশারা করা যাবেনা।
মাকামে ইব্রাহীমঃ কাচে ঘেরা, গম্বুজ আকৃতির ঘর, এর ভিতরে ইব্রাহীম (আঃ) এর পদচিহ্ন অংকিত পাথর আছে। এখানে জড়িয়ে ধরা, চুমু দেয়া কোনটাই সুন্নাতসম্মত না। শুধু দেখা যাবে।

★ অনেকে কাবাঘর এর যেকোন প্রান্ত ধরে দাড়িয়ে, জড়িয়ে ধরে থাকেন। এতে কোন ফায়দা নেই। কেউকেউ জায়নামাজ, মাথার রুমাল কাবাঘরে ঘষে সেটা নিজের শরীরে মোছেন। কাবায় হাতঘষে সেটা মুখে ঘষেন, চুমু দেন।এতে কোন রহমত বা বরকতের আশা করে। এগুলো করা যাবেনা। এমনকি হারামের মাটি সেখান থেকে বের করা যাবেনা এবং নিচে পড়ে থাকা কোনও কিছু কুড়ানো যাবেনা।

★ অনেকে বলেন, হজ্জে গেলে পর্দা শিথিল করা যায়। একেবারেই ভুল একটা কথা। হজ্জের মত ফরজ 
কাজে যেয়ে পর্দায় হেলাফেলা করা একেবারে অনুচিত। তবে অনেকেই জেনেবুঝে আবার কেউকেউ না জেনে না বুঝে পর্দার অবহেলা করেন।
যেমন ধরেন,একই রুমে ৪/৫ জন মহিলা বা পুরুষ থাকেন; সবাই সবার অপরিচিত। একজন মহিলার মাহরাম যখন তার সাথে সেই রুমে দেখা করতে প্রবেশ করলেন, সেখানে থাকা বাকি মহিলাদের জন্য তিনি নন মাহরাম। এবং এতে বাকি সবার পর্দা নস্ট হচ্ছে। আপনি যদি কিছু বলতে বা বুঝাতে যান; আপনাকে উলটা বুঝিয়ে দেবে। অনুরোধ বা নিষেধ কোনটাই শুনবেনা, অযথা রাগ হবে। তাই, নিজেদের পর্দা রক্ষার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

★ মক্কায় যেহেতু তাওয়াফ হয়, আজানের পর খুব দ্রুত নামাজ শেষ করে, তাওয়াফের জন্য জায়গা খালি করে দেয়া হয়। এই সময় বেশ তাড়াহুড়ো শুরু হয় জায়গা পাওয়ার জন্য। ছেলেরা যেকোনো জায়গায় দাঁড়াতে পারেন, কিন্তু মেয়েদের মাতাফে সাধারণত দাঁড়াতে দেয়া হতনা, তবে ইদানীং মেয়েদের জন্য মাতাফে আলাদা জায়গা করা থাকে, অবশ্যই সেখানে নামাজ পড়বেন, ছেলেদের সাথে না।
এখানে অনেকেই একটা ভুল করেন, ছেলেদের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে যান। অনেকেই জানেন না, মহিলা পুরুষ একই সাথে দাঁড়াতে পারবেন না। মহিলাদের অবশ্যই পুরুষদের পিছনে দাঁড়াতে হবে। কোন মহিলার পিছনে বা পাশে দাঁড়ালে ঐ পুরুষদের নামাজ শুদ্ধ হয়না। এই ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। মহিলারা আযানের আগেই জায়গা খুঁজে মাতাফ থেকে চলে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। নাহলে আপনাকে ভলান্টিয়াররা বের করে দিবে।

★ মসজিদের ভিতরে মেয়েদের আলাদা ওজুর জায়গা আছে। ঘর থেকে ওজু করে গেলে সবচেয়ে ভালো, না পারলে ভিতরে জায়গা খুজে নিবেন। অনেকেই জমজমের পানি খাবার জায়গাতেও ওজু করে নেন। কিন্তু কোন অবস্থায় ছেলেদের অজুখানায় ছেলেদের সাথে ওজু করবেন না। এতে পর্দার খেলাফ হয়।

★ আরেকটা বিষয় খুব ভয়ংকর লেগেছে আমার, সেটা হল, মসজিদের ভিতরে অনেক লোক ঘুমিয়ে থাকে। যখন আজান হয়, তারা উঠে সাথেসাথে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। অথচ ঘুমিয়ে গেলে ওজু নষ্ট হয়ে যায়। সে অবস্থায় নামাজ হবেনা। প্রথম প্রথম মনে হত, তারা ভুলে গেছেন। পরে বুঝলাম, অনেকে জানেন না। কাউকে মনে করিয়ে দিলে, তারা খুশি হন, ওজু করে নেন। আবার কেউ অস্বীকার করেন এই বলে, তিনি নাকি ঘুমাননাই; শুধু শুয়ে ছিলেন। যাই হোক, এই ব্যাপারে সাবধানতা জরুরী।

★ আরাফার ময়দানে মানুষ খুব ঝগড়া ঝাটি করে। যোহর, আসর একসাথে, নাকি আলদা; ৪ রাকাত নাকি কসর? আমাদের দেশে বেশিরভাগ কাফেলা আলাদা পড়েন, ৪ রাকাত পড়েন। তবে নবীজি(সাঃ) একসাথে, কসর পড়েছেন। এখানে মাজহাব রিলেটেড কিছু ব্যাপার আছে। আপনি যেটাই ফলো করেন, অন্তত ঝগড়া করবেন না।

★ এখানে মানুষ খুব সময় নষ্ট করেন। খাওয়া, দাওয়া, গল্প গুজব করে সময় অপচয় হয়। তাবুতে বেশিরভাগ কেবল কি খাবেন, কখন খাবেন, আর খাবার জমাতেই( মুজদালিফার জন্য) ব্যস্ত থাকেন।

★ একদল দুয়া করেন। অনেকেই দলবেঁধে হাত তুলে দুয়া করেন। এভাবে না করে নিজের মত দুয়া করেন। নিজের চাওয়া পাওয়া আল্লাহ কাছে নিজের ভাষায় প্রকাশ করুন। কেউ মুনাজাত করলো, আর তার সাথে হাত তুলে শুধু “আমিন ” বলাতে নিজের চাওয়া পূর্ণ হবে, সেটা আশা করা বোকামি।

★ এছাড়াও জামারায় পাথর মারা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা কাজ করে আমাদের।
প্রথম দিন একটা (বড়) জামারায় পাথর মারতে হয়। এখানে পাথর মারা মানে শয়তানকে মারা নয়। পাথর মারার উদ্দেশ্য আল্লাহর জিকির করা।

★ রাসুল (সাঃ)বলেন, “আল্লাহ জামারার বিধান দিয়েছেন আল্লাহর জিকিরের জন্য। ” লাব্বাইক পড়তে পড়তে জামারাতে যেয়ে, হৃদয়কে আল্লাহমুখি করে ইব্রাহীম (আঃ) যেমন শয়তান থেকে মুক্তি পেয়েছেন, এভাবে আল্লাহর জিকির আপনার অন্তরে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে, শয়তান থেকে মুক্তি দেবে। জামারায় পাথর মারা শেষ হলেই লাব্বাইক পড়া শেষ। তাই মনের আবেগ দিয়ে জিকিরের প্রতি মনোযোগী হতে হবে।

★ এখানে সবাই একটা ভুল করেন। আমাদের কিছু ভুল ধারণা আছে পাথর মারা নিয়ে। প্রচলিত কথা অনুযায়ী এখানে শয়তান থাকে। আসলে এখানে শয়তান থাকেনা। আর পাথর শয়তানকে মারা জন্য নয়। এখানে পাথর মারার উদ্দেশ্য, জিকিরের মাধ্যমে হৃদয় থেকে শয়তান কে বিতাড়ন। ইব্রাহীম (আঃ) এখানে হজ্জের সময় শয়তানকে তাড়িয়েছিলেন। ইসমাইল (আঃ) কে নিয়ে সহীহ রেয়াওয়াত থেকে কোন বর্ননা পাওয়া যায়না। রসুল (সাঃ) ইব্রাহীম (আঃ) এর সুন্নাতকে জিন্দা করে, জিকির করতে বলেছেন, যেন অন্তর থেকে শয়তান চলে যায়।

★ আমরা এখানে যে ভুল করি, মনে করি শয়তানকে মারছি। এতে আক্রোশ প্রকাশ পায়, অনেকে আবেগে জুতা, সেন্ডেল, লাঠি মারেন, এতে মূল ইবাদত, অর্থাৎ জিকির করা হয়না। অতিরিক্ত আবেগ প্রকাশ শয়তানককে তাড়ায় না, উলটা শয়তানকে ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলে। এবং প্রকৃত ইবাদাত থেকে বঞ্চিত হই।

★ এখানে জিকির করতে হবে রাসুল(সাঃ) এর পদ্ধতিতে, শুধুমাত্র “আল্লাহু আকবার ” বলতে হবে। অনেকেই “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ” বলেন। হাদীসে শুধু “আল্লাহু আকবার ” আছে। ৭ টি তাকবীর অন্তর দিয়ে, মুহাব্বাত সহকারে বলতে পারলে তা অন্তরে চিরস্থায়ী অবস্থান করবে।

★ আরেকটা ভুল করি, সেটা দ্রুত জামারাত মেরে ফ্রি হওয়ার প্রবণতা। রাসুল (সাঃ) প্রথম, দ্বিতীয় জামারায় পাথর মেরে দীর্ঘ সময় ধরে, কান্নাকাটি করে দুয়া করেছেন। এটা দুয়া কবুলের অন্যতম জায়গা। তৃতীয় জামারায় পাথর মারার পর আর কোন দুয়া নেই। অধিকাংশ লোক এখানে দুয়া করেন না। পাথর মেরেই চলে যান।
তবে এখানে খুব ভীড় হয়, যেকারনে পুলিশ খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে দুয়া করতে দেয়না। তবুও অনেক মানুষ পুলিশের বাধা তোয়াক্কা না করে দাঁড়িয়ে দুয়া করেন। যারা জানেন, এখানে দুয়া করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তারা কষ্ট করেও হলেও এখানে দুয়া করার সুযোগ ছাড়তে চাইবেন না।

★ আর কিছু লোক আছেন, যারা জামারায় পাথর মারতেই যাননা। পাথর মারা ওয়াজিব। অসুস্থ, দূর্বল লোকদের জন্য অন্যকাউকে দিয়ে পাথর মারানোর অনুমতি আছে। কিন্তু এর বাইরেও অনেকে আছেন। বিশেষ করে মহিলারা, জামারায় পাথর মারতে যাননা বিভিন্ন অযুহাতে। তারা মিনাতেও থাকেন না, সোজা মক্কায় চলে যান।

★ আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন, পাথর মারতে যাবো কিনা? আমার কাজ আমি না করে অন্য কাউকে দিয়ে করালে, আমার হজ্জে যাবার প্রয়োজন কি, বদলি হজ্জ করালেই হয়।

হজ্জ কষ্টের কাজ, তবে এই কস্টের পর যে শান্তি সেটাও অতুলনীয়। প্রতিবছর বহুলোক জেনেবুঝে এই কষ্ট পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। এর পর যে শান্তি আর রহমত সেটা অপরিমেয়। এই রহস্য বুঝতে হলে, সেই কষ্ট অনুধাবন করতে হবে প্রতিটি পর্যায়ে। হজ্জের আসল কাজগুলো বাদ দিয়ে, নিজের খেয়াল খুশিমতো করে সেই শান্তির খোজ পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে যত্নবান হব, ইনশা আল্লাহ।

হজ্জে করণীয় এবং বর্জনীয়
ফাহমিদা হুসনে জাহান

জুলাই ২৯, ২০১৯ইং