আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, দুনিয়াতে কোন জায়গায় বারবার যেতে চাই, কোন সফরের স্মৃতি রোমন্থন করতে মন আকুল হয়, পছন্দের জায়গা কোনটা, কোন সে জায়গা যেখানে গিয়ে ফিরে আসতে চাইনি, সবগুলো প্রশ্নের জবাব একটাই, কাবা, বাইতুল্লাহ।
জীবনের একটা সময় পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে দর্শনীয় জায়গাগুলোতে যাবার জন্য মনে একটা আকুলতা কাজ করতো। ফেইসবুকের কল্যানে পরিচিতরা কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতো দেখতে দেখতে দেখার আগ্রহ আরো বেড়ে যেত, যতদিন না আমি আল্লাহর ঘরকে নিজের দুচোখে দেখতে পেয়েছি, শুধু চোখে দেখেছি বললে কম বলা হবে, বাইতুল্লাহর ভালোবাসা অন্তরে ধারণ করতে পেরেছি।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয় কিন্তু। মাত্র দুই বছর আগে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখান থেকে আসার পর প্রতিদিন, জি প্রতিদিন বাইতুল্লায় আমার ফেলে আসা দিনগুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকে। বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববীর আজান যে মানুষ শুনেছে, আর তার অন্তর বিগলিত হয়নি, শরীরে মনে কম্পন হয়নি, হৃদয় গহীনে দোলা লাগেনি; এমন মানুষ পাওয়া যাবেনা।
দরদ ভরা কন্ঠে আজান আর সুমধুর তিলাওয়াত সালাতে, লক্ষ লোকের সমাগম, যেন অন্য এক দুনিয়া! যেখানে গেলে মানুষ ভুলে যায় দেশে ফেলে আসা কাছের মানুষকে, যাদের ছাড়া চলতোনা একটা দিনও।
আপনি ভুলে যাবেন সন্তানের কথা, স্বামীর/স্ত্রীর কথা, এমনকি বাবা মায়ের কথাও। মনে হবে এ এক অন্য জগৎ, যেখানে আপনার একমাত্র কাজ শুধুই এক আল্লাহকে স্মরণ করা, বাইতুল্লাহতে তাওয়াফ করা, সময়মত জামাতে সালাত আদায় করা। নাওয়া খাওয়াকে পাশে ফেলে শুধু মন ভরে কাবার দিকে অপলক চেয়ে থাকা!
লক্ষ লক্ষ মানুষের এমন মধুর মিলনস্থল আর কোথাও এমন হয় শুনিনি। চেনাজানা নাই, ভাষায়, গায়ের রঙে, পোশাকে কোন মিল নেই, কিন্তু কি অসাধারণ ভাবে একই কাতারে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আজানের পরই। একজন অপরিচিত মানুষ আরেকজন অপরিচিত ভাইয়ের সেবায় লেগে যাচ্ছে নিজের স্বার্থ বিলিয়ে; হজ্জ ছাড়া এমন দৃষ্টান্ত আর কোথায় আছে!
মক্কায় তাপমাত্রা প্রায়ই ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়, এই তাপমাত্রায় আমরা ঘরের বাইরে যেতেই চাইনা, পারলে ঘরে এসি চালিয়ে বসে থাকি। মক্কায় এই তাপমাত্রায় পিচ ঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকে সালাত আদায় করে, এমন অবস্থা হয়, সেখানে স্থান ধারণ করাও কষ্ট হয়ে যায় এবং এই লোকগুলো বেশির ভাগই বিত্তবান, অথচ কিসের আশায় এই তপ্ত রোদে গা পুড়িয়ে সালাত আদায় করছেন?
শরীরের কষ্টকে ইগনোর করে মনের তৃপ্তিতে তৃপ্ত হওয়া বলে কিছু আছে, সেটা বোঝার জন্য হজ্জের কোন তুলনা হয়না। ষাটোর্ধ বৃদ্ধ মানুষ জনকে যখন কাঁধে বোঝা নিয়ে হাসতে হাসতে পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন, পায়ে ফোস্কা নিয়েও যখন মনের শান্তির জন্য হজ্জের কঠিন পথে বৃদ্ধা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলছেন; আপনি অনুভব করতে পারবেন এই শান্তির জন্য গায়ের কষ্টকে বুড়ো আংগুল দেখানো কত্ত সহজ।
হজ্জ একইভাবে যেভাবে সবরের শিক্ষা দেয় সেটাও অসাধারণ। প্রতিটি কাজের সাথে ধৈর্য্য জড়িয়ে থাকতে হয় ওতপ্রোতভাবে। একইসঙ্গে শারীরিক সামর্থ, আর্থিক সংগতি এবং মানসিক প্রশিক্ষণের জন্য হজ্জের কোন তুলনা হয়না।
কিন্তু আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের যথেষ্ট সামর্থ্য থাকার পরেও তারা বাইতুল্লাহ যাবার ইচ্ছে পোষণ করেন না, হজ্জে যাবার কোনও আগ্রহ নাই। অথচ তারা বছরে বেশ কয়েকবার দেশের বাইরে বেড়াতে যান।
বাইরে বেড়াতে যাওয়া অবশ্যই খারাপ নয়, কিন্তু এই মানুষদেরকে যদি হজ্জে বা ওমরাহতে যাবার কথা বলা হয়, তারা বেশকিছু অজুহাত খাড়া করিয়ে দেন না যাবার পিছনে। সত্যকথা হচ্ছে, কাবাঘর দেখার সৌভাগ্য আল্লাহ সবাইকে দেননা। হজ্জ করার জন্য আল্লাহর দয়া লাগে, তাঁর দয়ায় নিজের মনের কোনে টান লাগে, তার মেহমান হবার জন্য মনে যে আকুলতা দরকার সেটা সবার থাকেনা।
আপনি মুসলমান, সামর্থ্য আছে, দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে, কিন্তু আল্লাহর ঘরে যাবার তামান্না নাই, বুঝতে হবে মনে মনের দরজা -জানালা গুলো বন্ধ। মনে আলো বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা নাই, মন তালাবদ্ধ! মুসলিমের মন, অথচ কাবাঘরের জন্য কাঁদেনা, কিভাবে সম্ভব?!
অনেকেই হয়তো জানিনা, দুনিয়াতে আসল জান্নাতের একটা বাগানের অংশ আছে, সেটা মদিনায়। নবী (সাঃ) কবরের পাশেই জায়গাটা, রিয়াদুুল জান্নাত। যেখানে দুই রাকাত সালাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে, এখানে দুয়া কবুল হয়। সেখানে দুয়া করতে পারা অবশ্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আমরা পৃথিবীর দর্শনীয় স্থানঘুরে জান্নাতের মত শান্তি খুঁজে বেড়াই, অথচ সত্যিকার জান্নাতের টুকরো আমাদের দুনিয়াতেই আছে, কিন্তু আমরা সেখানে যেতে চাইনা!!
একজন অন্ধ যেমন আঁধার আলোর পার্থক্য জানেনা, বর্ণান্ধ জানেনা রং কেমন? কি দিয়ে বোঝাবেন তাকে সাদা বা কালো? একজন সন্তান জন্ম দিতে মায়ের যে কষ্ট, আর সন্তানের মুখ দেখার যে আনন্দ, তা একজন। মা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে কি বোঝা সম্ভব?
তেমনি যিনি আল্লাহর ঘর দেখেননি, হজ্জের ময়দানে থাকেননি, তিনি কখনো বুঝতে পারবেন না কাবার আকর্ষণ কি মোহময়! আপনাকে টানতেই থাকবে চুম্বকের মত, দেখার জন্য মন কাঁদবে। পরিবার পরিজন, স্বামী-সন্তানের টানের চেয়েও এ টান অনেক বেশি।
যারা ভাবছেন বাড়িয়ে বলছি, একবার যেয়েই দেখুন, আপনিও প্রেমে পড়ে যাবেন বাইতুল্লাহর। যাওয়ার পরে আমার মত মনে আফসোস হতে থাকবে, আরো আগে কেন এলাম না?
যাদের এখনো আল্লাহর ঘর দেখার সৌভাগ্য হয়নি, মনকে বাঁধুন, আল্লাহর কাছে মিনতি করতে থাকুন, তার ঘর না দেখে, হজ্জ না করে যেন আল্লাহ মৃত্যু না দেন। অনেকেরই আর্থিক সংগতি না থাকার পরেও, মনের আকুলতা আর একান্ত দোয়ায় আল্লাহ অনেককেই হজ্জের সৌভাগ্য দান করেন।
সংগতি থাকলে যত দ্রুত সম্ভব হজ্জের নিয়ত করুন, যখন আপনি যেতে চাইবেন, তখন আর্থিক সংগতি, শারিরীক সামর্থ্য থাকবে কিনা কে জানে? অথবা এই দুনিয়া থেকে অন্য দুনিয়ায় বাসিন্দা হয়ে যাবেন না, তারই বা গ্যারান্টি কি? একটু ভাবুন তো, আপনার পরিচিতদের মধ্যে কতজন যারা কবরবাসী হয়েছেন ফরজ হজ্জ আদায় না করে? এই লিস্টে আপনি যেন যুক্ত না হন সেটা মনস্থির করুন এই মুহূর্তেই।
ফরজ হজ্জ না করিয়ে আল্লাহ যেন মৃত্যু না দেন সেই দুয়া করতে ভুলবেন না। নবীজী (সাঃ) যে ব্যাক্তি ফরজ হজ্জ না করে মারা যাবেন তার জন্য শাফায়াত করবেন না। আপনি যেন সেই দুর্ভাগাদের অন্তর্ভুক্ত না হন।
আর যাদের সামর্থ্য নেই, কিন্তু মন ব্যাকুল হয়ে থাকে সেখানে যাবার, দুয়ার বিকল্প নেই। আল্লাহ যদি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন, আপনাকে হজ্জে নিয়ে যাওয়া তার ক্ষমতার বাইরে নয় অবশ্যই। তাই, দুয়ার উপর থাকুন।
মহান আল্লাহ তার প্রত্যেকটি বান্দাকে তার ঘর জিয়ারত করার, নবীজী (সাঃ) কে কাছ থেকে সালাম দেয়ার, অন্তত একবার হজ্জ পালন করার তওফিক দান করুন।
ভালোবাসার অনুভূতি
ফাহমিদা হুসনে জাহান
অগাস্ট ৮, ২০১৯ইং