বাইতুল্লাহ এক অদেখা ভালোবাসা

– মা .. টিভি তে হজ্জ দেখাচ্ছে। দেখবে না ?

অনুর ডাক শুনে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলেন মায়মুনা বেগম। মেয়েকে বলে রেখেছিলেন হজ্জের অনুষ্ঠান টিভিতে দেখালে যেন তাকে ডেকে দেয়। অনু ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্রী। এক ছেলে আর এক মেয়ে রেখে মায়মুনা বেগমের স্বামী দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন বছর ছয়েক হয়। ছেলে আবীর একাদশ শ্রেনীর ছাত্র শহরের নামকরা এক কলেজের।

টিভির রুম থেকে অনু মাকে একা রেখে সরে আসলো। অনু জানে, তার মা কিছুক্ষণ পর কাঁদবেন। আরাফাহর ময়দানে লাখো মুসুল্লিদের উকুফ আর তালবিয়ার ধ্বনি “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…..” মায়মুনা বেগম কে আবেগ তাড়িত করে দেয়। মায়মুনা বেগম অঝোরে কাঁদতে থাকেন তখন।

অনুর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন নাকি অনুর মা তার বাবার কাছে আব্দার করেছিলেন টাকা পয়সা জমিয়ে হজ্জে যাবার। অনুর বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন “মানুষ টাকা জমিয়ে বাড়ি গাড়ি করে, জমি কিনে। আর তুমি হজ্জে যেতে চাও মুনা? ঠিক আছে, বুড়ো হয়ে গেলে ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়ে আমরা স্বামী স্ত্রী হজ্জ করে আসবো একসাথে ইন শা আল্লাহ।” বুড়ো হবার আগেই অনুর বাবার ডাক চলে আসলো গায়েবের মালিকের পক্ষ থেকে। মায়মুনা বেগমের স্বপ্ন নিভৃতে চাপা পড়ে গেলো কোন এক সময়।

এরই মধ্যে খবর পেলেন মায়মুনা বেগমের শ্রদ্ধেয় বড় মামা এবং মামী গ্রাম থেকে শহরে আসছেন তাদের বাসায়। উদ্দেশ্য হজ্জে যাবেন। ফ্লাইটও ঠিকঠাক। অনুর স্পষ্ট মনে আছে, যেদিন উনারা অনুদের বাসা থেকে ইহরামের কাপড়ে রওনা হলেন, অনুর মা বিদায় দিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। হয়ত ভাবছিলেন, এরকম একটা দিন তার জীবনেও আসার কথা ছিলো।

দীর্ঘ দেড় মাস পর অনুর নানা-নানী হজ্জ থেকে ফিরলেন। মায়মুনা বেগমের চোখে ঘুম নেই। উনাদের কাছ থেকে বাইতুল্লাহ কা’বার গল্প শুনতে শুনতে বুকের কোনায় চেপে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। এরপর থেকেই আত্মীয় স্বজনরা যারাই হজ্জ করে আসতেন, তাদের কাছে ছুটে যেতেন বাইতুল্লাহর গল্প শুনার জন্য। কালো গিলাফে মোড়ানো বাইতুল্লাহর প্রতি অদেখা ভালোবাসাটা যেন বেড়েই চললো মায়মুনা বেগমের।

পনেরো বছর পর…..

অনু তখন দুই বাচ্চার মা। স্বামী-সন্তান নিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার অনুগ্রহে বেশ সুখে আছে। এই এত বছরে মায়মুনা বেগমেরও একটি ছোট্ট সংসার হয়েছে। সেখানে আছেন তাঁর ছেলে আবীর, তার বৌ আর একমাত্র নাতি। ছেলের মধ্যম আয়ে বেশ চলে যায় মায়মুনা বেগমের দিনগুলো।

অনুর সাথে মায়ের প্রায়ই কথা হয়। এরকমই একদিন কথার ফাঁকে মায়ের কাছ থেকে অনু জানতে পারলো, বড় ভাই আবীরের হজ্জে যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে তাদের এক দ্বিনী ভাইয়ের বদৌলতে। মায়মুনা বেগমের যৎসামান্য কিছু জমানো টাকা ছিলো। তার পুরোটা ছেলের হাতে দিয়ে বললো তাঁর গোপন ইচ্ছার কথা। ছেলে মাকে আশ্বাস দিলো কিছু একটা করার।

এরই মধ্যে এগিয়ে আসলেন অনুর ভাবী। অনুর ভাবী একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট টাইম লেকচারার। উদ্ধৃত্ত টাকাটা নিয়ে স্বামীর হাতে দিয়ে বললো মাকে হজ্জ করিয়ে আনতে। অনুর বড় ভাবীরও ততদিনে মায়মুনা বেগমের মত স্বামীর সাথে বাইতুল্লাহ নিজ চোখে দেখার স্বপ্ন লালন করছিলেন মনে মনে।

যুলক্বা’দা মাসের পনের তারিখ! বাইতুল্লাহকে সামনে রেখে দাঁড়িয়ে আছেন মায়মুনা বেগম। দু’চোখ ভরে কালো গিলাফে ঢাকা কা’বা দেখছেন। এ যেন বহু প্রতীক্ষার পর ভালোবাসার মানুষের সাথে সাক্ষাতের মতো। বুক ভেঙ্গে কান্না আসছে তার। পাশে থাকা ছেলে, ছেলের বউ-নাতি এসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।

মায়মুনা বেগমের কৃতজ্ঞতায় মাথা নুঁইয়ে আসছে। তার রব তাকে যা চেয়েছিলেন তিনি, তার চেয়ে বহুগুনে বেশি দিয়েছেন। সে বছর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা মায়মুনা বেগমের পুরো পরিবারকে হজ্জের জন্য কবুল করে নিয়েছিলেন।

টিভির সামনে বসে আছে অনু। হজ্জের অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানো হচ্ছে তাতে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখো মুসুল্লিরা আরাফাহর মুবারক প্রান্তরে দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে দু’আ করছেন। তাঁরা সমস্বরে তালবিয়া পাঠ করে চলেছেন–

“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ….”
“আমি হাজির, ও আল্লাহ আমি হাজির …..”

অনু ভাবছে, এত মানুষের ভিড়ে কোনো এক কোনায় তার ভালোবাসার মানুষগুলোও আছে। ভাবতে ভাবতেই চোখের কোনায় পানিরা এসে জমতে শুরু করলো…!

—————————–
বাইতুল্লাহ…
এক অদেখা ভালোবাসা
নুসরাত জাহান