টারনিং পয়েন্ট

১.
শায়লা, রফিক সাহেবের স্ত্রী। ভদ্রমহিলা স্বামীর সাথে আলাপ করছিলেন।

-আবার দাওয়াত! না গেলে হয়না?
-বছরে দু’একবার যেতে হয়, কি করার আছে বল?
-ভালো লাগেনা আমার এসব দাওয়াতে। খুব মেকি লাগে।
-বেশিক্ষণ থাকবোনা, সবার সাথে দেখা করেই চলে আসবো, ঠিক আছে?
-আচ্ছা, বলে চলে আসে শায়লা।

অফিসের কলিগ আলম সাহেবের বাসায় দাওয়াতে যেতে হবে। ঈদের উনি সবাইকে দাওয়াত দেন। রফিক সাহেব অনেকটা উপরোধে ঢেঁকি গেলেন আর কি!

আলম সাহেবের স্ত্রী, মিরা, বেশ সুন্দরী, কখনো মেকাপ ছাড়া তাকে কেউ দেখেছেন কিনা সন্দেহ। আজকে তিনি পরেছেন একটা ভারী লেহেঙ্গা। রুবি দেখেই বলে উঠলো, “ওমা ভাবী, এটা কোথা থেকে নিয়েছেন? একেবারে ইউনিক ডিজাইন।”

মিরা বললো, “এবার রোজায় কলকাতা গিয়েছিলাম, ভাই বলেনি? ওখান থেকেই আনা। এখানে এমন কাজ আর ডিজাইন পাবো কোথায়? ঈদে একটু আলাদা না পরলে হয় নাকি! ওখানকার সবকিছু একেবারে অন্যরকম, যেটা দেখি সেটাই পছন্দ হয়। এর সাথে ম্যাচিং করে জুয়েলারি, জুতা, ব্যাগ, কসমেটিকস সবই এনেছি।”

সবাই খুব প্রশংসা করে ওর রুচি আর সৌন্দর্যবোধের। আলম সাহেব তার স্ত্রীর এই খরুচে অভ্যাসে বিরক্ত হননা, বরং সবার কাছে নিজ স্ত্রীর প্রশংসা তার ভালোই লাগে।

শায়লা যেন এসবের মাঝে একেবারে অন্যগ্রহের মানুষ। এরকম ভারী একটা লেহেঙ্গা উনি কিভাবে পরে আছেন, এটা ভেবেই ওর গা ঘেমে যাচ্ছে। অথচ ও বোরকা পরে বলে, এই ভাবীরাই কেউ কেউ বলে ওঠেন, বাব্বা, এই গরমে ওসব পরা, না বাবা, এসব পারবো না, যা গরম, হিট স্ট্রোক হয়ে যাবে! তাই শায়লা কোন কথা বলেনা এসব নিয়ে, শুধু হাসে মনে মনে। এবার আলম সাহেব দাওয়াত এখনো দেননি, খুশিই হয় শায়লা।

২.
রফিক সাহেব বাসায় ফিরেছেন; হাতে মিষ্টি, মুখে হাসি।
-তোমার দাওয়াত আছে!
-আবার, দাওয়াত!
-কেন, মনেমনে এত করে দাওয়াত চাচ্ছিলে!
-আমি? দাওয়াত চাচ্ছিলাম? কি সব বল!
-হ্যাঁ সবচেয়ে প্রিয়জনের কাছে, সবচেয়ে প্রিয় জায়গায়!
-মায়ের বাসায়?
-নাহ! তারচেয়েও বেশি, অনেক বেশি!
-হেঁয়ালী বন্ধ কর, মায়ের চেয়ে প্রিয় আবার কেউ আছে নাকি? ঠিকঠাক বল। আবার তোমার নতুন কোন কলিগের বাসায়?

উঁহু, এটা তোমার সবচেয়ে কাংখিত জায়গা, দুনিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ন জায়গা, লাখ লাখ প্রাণের স্বপ্নের জায়গা। সেখানে তোমার দাওয়াত। আর তুমি মেহমান কোন সাধারণ মানুষের না, তুমি মেহমান এই দুনিয়ার মালিকের, সবকিছুর রবের, এই বিশ্বজাহানের একছত্র অধিপতির!

চোখে পানি, মুখে হাসি শায়লার। রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে তাহলে, আলহামদুলিল্লাহ্‌।

কি, আমি হেঁয়ালি করছিলাম? এবার বল, দাওয়াত কবুল?

এই দাওয়াত কে না কবুল করবে? এত বছরের আশা আর ত্যাগ, গায়ে কৃপণতার, অসামাজিকতার ট্যাগ লাগিয়ে, হাসিমুখে, এই দাওয়াতের অপেক্ষাতেই তো ছিলাম।

-তবে দেরী কেন, প্রস্তুতি শুরু কর, এখন থেকেই?
-এত্ত তাড়াতাড়ি! এখনো তো কয়েকমাস বাকি?
-এত বছর ধরে যে দাওয়াতের অপেক্ষায় ছিল, সেখানে যাবে বিনা প্রস্তুতিতেই?
-কি করতে হবে?

-তুমি কি দাওয়াতে কখনো খালি হাতে যাও। কিছু না কিছু তো নিয়েই যাও? আল্লাহর মেহমান হয়ে খালি হাতে যাবে?

লোকের বাসায় দাওয়াতে গেলে তাদের প্রয়োজনীয় অথবা পছন্দের কিছু নিয়ে যাই। কিন্তু মহান আল্লাহর তো কোন কিছু প্রয়োজন নেই, তিনি তো অমুখাপেক্ষী।
তাহলে তাকে খুশি করার জন্য কিছুতো করা যেতেই পারে।

-তাতো পারেই। কিন্তু এখানে আলাদাভাবে তাকে কিভাবে খুশি করবো? আমরা তো যতটা সম্ভব তাঁর আদেশ নিষেধ মনে চলি, তাঁর অনুগত থাকি, এভাবেই তো খুশি করার চেষ্টা করি।

-হজ্জের ও কিছু নিয়ম আছে ফরজ, সুন্নাহ, নফল আছে। আবার কিছু নিষিদ্ধ কাজও আছে। সেগুলো না জানলে কিভাবে মানবে? না জানার কারনে, ভুল করে ফেললে তিনি নারাজ হলে আমাদের সব চেষ্টাই বৃথা। তাইনা? তুমি কি জানো হজ্জের প্রয়োজনীয় সব হুকুম আহকাম?

-নাহ! কিন্তু আমরা তো আর একা একা যাবোনা, যাদের সাথে বা যে কাফেলায় যাবো তারা নিশ্চয়ই জানেন। আর তারা যেহেতু অনেক বছর ধরে যাচ্ছেন; তারা অনেক ভালো জানেন। তাদেরকে ফলো করবো।

-আচ্ছা, এক কাজ কর, কালকে তোমার ছেলের পরীক্ষা নিয়ে এত্ত টেনশন না করে, তুমিই পরীক্ষা দিয়ে দাও, তোমার এক্সপেরিয়েন্স তো বেশি, ওর জায়গায় তুমি দিলে বেশি ভালো করবে।

-কিসব বল! ওর পরীক্ষা আমি কেন দিব। আমি দিলে কি আর ও পাস করবে?

-তাহলে কেন ভাবছো, এতবড় পরীক্ষা, সম্মান, এরজন্য নিজেরা কিচ্ছু না জেনে বুঝে শুধু অন্যকে ফলো করবো, আবার পাস ও করে যাব? এই পরীক্ষা পাসের মানে জানো তো? কবুল হজ্জের বিনিময় শুধুই জান্নাত। আর যে কাজের ফলাফল জান্নাতের মত অমূল্য কিছু, সেটা পাবার জন্য, কাজটা নিখুঁত হবার জন্য, পূর্ণ সুন্নাহ মোতাবেক হবার জন্য কারো অন্ধ অনুসরণ বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। দিনশেষে কাজটা আমাদের, আমরা যেমন আমাদের পুরস্কারের ভাগ কাউকে দিবনা, আমাদের ভুল ভ্রান্তির দায় ও অন্য কেউ নেবে না।

-কিন্তু গতবছর ই তো চাচা চাচী হজ্জে গেলেন, কৈ তাদের তো কোন পড়াশোনা করতে শুনিনি। চাচীকে জিজ্ঞাসা করলে একটা ছোট বই দেখিয়ে বললেন, কিছু নিয়ম লেখা আছে, সেগুলো শিখে যাচ্ছেন শুধু। আর কি কি করবেন সেগুলো কাফেলার সবার সাথে সাথে করবেন।

-জানোতো, পরীক্ষায় শুধু পাসমার্ক পাবার জন্য যে পড়ে, তার কিন্তু পাস ফেইল নিয়ে টানাটানি লাগে, আমি সেটা চাইনা। আমরা ফুলমার্কস চাই, সেজন্য পুরা সিলেবাসে কিছু বাদ দেয়া যাবেনা।

-আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু কি কি পড়তে হবে, সবকিছু পাবো কোথায়?

-আমি কিছু অথেনটিক বই জোগাড় করব, আর প্রচুর লেকচার আছে আলেমদের, সেগুলো কোথায় পাবে, সেটাও কি বলে দিতে হবে? আর যারা হজ্জ করে এসেছেন তাদের সাথেও কথা বলে তাদের অভিজ্ঞতা শুনে নিতে হবে। হজ্জ একটা প্র‍্যাক্টিক্যাল ইবাদত। দেখা গেল অনেক কিছু পড়ে যাবার পরেও, কার্যত করতে গিয়ে সেটা করা হয়না।

এজন্য বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। যদিও সবার পরিস্থিতি এক হবেনা, কিন্তু কাজে দেবে। আর হজ্জ করার সুযোগ কিন্তু বারবার নাও আসতে পারে। হজ্জ শেষ করে এসে যদি শুনি আমাদের সবকাজ ঠিকমত হয়নি, ভুল ছিল; তবে সে ভুল শোধরানোর সুযোগ আর পাবো না।

শায়লা এবার কিছুটা বুঝতে পারছে, যেমনটা ভাবছিল ব্যাপারটা তেমন না। তাকেও সবকিছু সঠিকভাবে জানতে হবে, নাহলে পালন করবে কি করে?

৩.
রফিক সাহেব খুব দ্রুত কাজ গুছাচ্ছেন। কয়েকদিন ধরে তাকে বেশ ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। আলম সাহেব জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন, “ভাই এত্ত তাড়া কেন? ছুটিতে যাবেন নাকি?” রফিক সাহেব হেসে বললেন, “হ্যাঁ ভাই, ছুটিতে যাব, লম্বা ছুটিতে। কিন্তু ওনাকে সাধারণত ছুটি নিতে দেখা যায় না।”

-কদিনের ছুটিতে যাচ্ছেন ভাই? দেশের বাইরে কোথাও?
-জ্বি ,৪০ দিনের ছুটিতে।

-কি বলেন? এত্তদিনের জন্য? চিল্লায় যাবেন নাকি?

-জ্বি না, হজ্জে যাবো ইন শা আল্লাহ।

হজ্জে যাবেন এই লোক, কিভাবে সম্ভব! একই বেতনের চাকরিতে তিনিতো সবার আবদার মেটাতেই হিমসিম খান! ওনাকে কেউ পছন্দ করে না, বলে অসামাজিক, বউটাও একই, এজন্য এবার ঈদে আর দাওয়াতই দেন নাই। আর এই লোক কিনা আল্লাহর ঘরের মেহমান হতে যাচ্ছে?

আলম সাহেব কিছুক্ষণ উশখুশ করে, জিজ্ঞাসা করেই ফেলেন, ভাই এত টাকা জোগাড় কিভাবে করলেন?
রফিক সাহেব বললেন, তিনটা কাজ করেছি শুধুঃ নিয়ত, চেষ্টা আর দুয়া।

আমি নিয়ত করেছিলাম কয়েক বছর আগে, স্ত্রীকেও সেভাবেই বলেছি। উনিও সাহায্য করেছেন যতটা সম্ভব। নিজের শখ, আহ্লাদ গুলো সীমিত করে ফেলেছেন। সংসার খরচের টাকা বাঁচিয়ে, নিজের হাত খরচের টাকা থেকেও জমাতেন। বাচ্চাদেরকে একইভাবে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হতে দেননি।

আর আমিও মাস শেষে বাকি টাকা, বোনাসের টাকা এসব রেখে জমিয়েছি বহুদিন ধরে। আমাদের বহুদিনের আশা হজ্জে যাবার। যে কারনে এসব কোন কিছুই আমাদের কাছে কষ্টকর মনে হয়নি, বরং স্বপ্নপূরনের পাথেয় মনে হয়েছে। আপনি যখন কোন স্বপ্ন দেখবেন, সে স্বপ্ন পুরনে কোন বাঁধা, কষ্ট আর কষ্ট লাগেনা, যখন আপনি তার ফলাফল দেখতে পান।

ধরেন, আপনি যখন বি সি এস দিয়েছিলেন, এই গল্প করছিলেন একদিন মনে আছে? কত রাত, কত রাত জাগার ফলাফল ছিল ক্যাডার হওয়া। এটা আপনাকে এনে দিয়েছে সম্মান, খ্যাতি, অর্থ। এখন কি আর সেই কষ্টের কথা মনে পরে? বরং সাফল্যের কাছে চাপা পরে গেছে সে দিনগুলো, তাই না?

আলম সাহেব এতক্ষণ শুধু শুনে যাচ্ছিলেন, এবার বললেন, আচ্ছা, এই বয়সে হজ্জে করার চেয়ে একটু বয়েস বেশি হলে, করলে ভালো হয়না? শুনেছি, হজ্জে সব পাপ মাফ হয়ে যায়, তাহলে হজ্জের পরের পাপগুলোর কি হবে যদি হজ্জ ধরে রাখতে না পারেন?

হজ্জ কিন্তু আসলে যৌবনের ইবাদাত। হজ্জে যথেষ্ট শারীরিক সামর্থ্য প্রয়োজন হয়, যেটা বৃদ্ধ বয়সে থাকে না। আর মৃত্যুর কথা বলছেন! আমাদের কলিগ, আনোয়ার সাহেবের ছোট ভাই, যে আমাদের অনেক ছোট, হঠাৎ মারা গেল মনে নেই। আমাদের কার মরণ কখন সেটা শুধু আল্লাহই জানেন।

তাই, মরার আগে হজ্জ করে সব পাপ মাফ করিয়ে নিব, এটা একদিকে ভুল চিন্তা অন্যদিকে প্রতারণা। কারন, পাপ আল্লাহ মাফ করে দিবেন, এই ভাবনা কখনো আমাদের পাপ থেকে বের হতে দিবেনা বরং পাপের সাগরে ডুবিয়ে দেবে। আর হজ্জ ধরে রাখা তো নির্ভর করে আল্লাহর ইচ্ছা আর নিজের চেষ্টার উপর।

অনেকের জন্য হজ্জ একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যায়। আর এই নিয়তেই হজ্জে যাওয়া উচিৎ, ফিরে এসে আর আগের জীবনে ফিরে যাবো না। যদি কেউ সেটা নাও করতে পারে, হজ্জ ফরজের পর তা পালন না করার কারনে যে পাপ হচ্ছিল, অন্তত তা থেকে তো বেঁচে যাবে।

আলম সাহেব এবার ভাবনায় পড়লেন, এভাবে তো ভাবিনি কখনো! মনে মনে ভাবছেন, এই লোক যাবে না তো কে যাবে? যে মাসের মাইনে পেয়ে সবার সাথে বাইরে খেতে যায় না, ভ্যাকেশনে বিদেশে ঘুরতে যায়না, বাসায় জমকালো পার্টি দেয়না বলে সবাই ভাবতো কৃপণতা করছে, অসামাজিক। যাকে এবার বাসায় দাওয়াতেও ডাকেনি কেউ পছন্দ করে না বলে। এই লোকের উদ্দেশ্য শুনে নিজকে নিজের আয়নায় দেখতে মনে হল।

সত্যিই তিনি কোন সাধারণ মানুষের মেহমান না হয়ে মহান আল্লাহর মেহমান হবার যথার্থ হকদার। আল্লাহর ঘরে দাওয়াত এমনি আসেনা বটে, তার জন্য নিয়ত আর সদিচ্ছা চাই। আর সঠিকভাবে,সুন্নাহ মোতাবেক পালিত একটা কবুল হজ্জ হয়ে যেতে পারে আমাদের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।

——————————-
টারনিং পয়েন্ট

ফাহমিদা হুসনে জাহান