ছাগলটা অনেক্ষণ থেকেই ব্যাঁ ব্যাঁ করে যাচ্ছে। রাশেদ আর আমেনা সব সময়ই খেয়াল রাখে ছাগলটার৷ আজ ওদেরও মন ভাল নেই। ঘরে চুপচাপ বসে আছে।
অথচ…
আনন্দের আমেজ চারদিকে। ঈদের চাঁদ দেখে হৈ-হুল্লোড় করছে সব। কত পরিকল্পনা করে রেখেছিলো আমেনা। কিন্তু সব মিথ্যা হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে আমেনা। সবে ৯ বছরে পা রেখেছে মেয়টা। বাবা বলতে অজ্ঞান। গত পরশু আজহার আলীর বাসায় এসে পৌছাবার কথা। কিন্তু ঈদের রাতেও তিনি এসে পৌছান নি। মুঠোফোন বন্ধ দেখাচ্ছে তার। যোগাযোগ করার আর কোন উপায় নেই।
রাশেদের মনটাও বড্ড খারাপ। আব্বু বলেছিলো তার জন্য নতুন জুতো আর খেলনা পিস্তল নিয়ে আসবে। দু’ দিন হয়ে গেছে আব্বুর সাথে ফোনে কথা পর্যন্ত বলতে পারেনি রাশেদ।
কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না মমতাজ। ভেতরে ভেতরে দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। সারাদিন রোজা রেখে রাতেও কিছু মুখে তুলতে পারছেন না। ঘুম তো হারিয়েছে বহুদুরে। শরীর ভেঙ্গে আসতে চাইছে কিন্তু বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে শক্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তিনি।
আমেনা বড্ড বেশী ভালোবাসে তার বাবাকে। এমনিতেই কাঁদছে, তার ওপরে মা কে কাঁদতে দেখলে ওকে সামলানো দায় হয়ে পড়বে। রাশেদের বয়স সবে ৫ বছর। এত কিছু না বুঝলেও বাবার অভাব সেও বুঝতে পারছে। বড় বোনকে কাঁদতে দেখে রাশেদ একেবারে গুটিসুটি হয়ে আছে।
আশে – পাশের সব বাসা থেকে কত কোলাহল শোনা যাচ্ছে। কেউ সারা রাত জেগে মেহেদী দেবার প্ল্যান করছে, কেউ রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত আর কেউ বা নতুন জামার সাথে কোন অর্নামেন্ট ম্যাচ করবে তা ঠিক করতে মহাব্যস্ত। গৃহিনীরা পরদিন মাংসের বন্দোবস্ত ঠিকমত করার আয়োজন করছে।
অথচ, আমেনা দের ঘরটা যেন মৃত। তিনটা মানুষই চুপচাপ। মমতাজের মনে একটা বিশ্বাস ছিলো, আজ বিকালের মধ্যেই তার স্বামি এসে পড়বে। কিন্তু রাত হয়ে গেল। বাচ্চাগুলো দুদিন ধরে প্রশ্ন করতে করতে পাগল করে দিচ্ছিলো আজ ওরাও চুপ হয়ে গেছে। দুদিনে হাজার বার ফোন দেয়া হয়েছে। ফোন বন্ধ আজহার সাহেবের।
এশার নামাজে মায়ের সাথে আমেনাও শরীক হল। মোনাজাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো সে। রাশেদও চুপচাপ খাটে শুয়ে আছে। অন্য সময় ঘর দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখে সে।
অনেক চেষ্টা করেও আমেনা কে খাওয়ানো গেলনা। রাশেদ সামান্য একটু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মমতাজ কিছুই খেতে পারলো না। নানা মুখী দুঃশ্চিন্তা চেপে বসেছে তার মনে। মোবাইল চুরি হতে পারে, কিন্তু তাতে আসতে তো অসুবিধা হবে না। গাড়ি একসিডেন্ট হলে খবর পাওয়া যেত। তাহলে কি অজ্ঞান/ মলম পার্টির খপ্পড়ে পড়ে অচেতন হয়ে কোথাও পড়ে আছে না কি…………???
আর ভাবতে পারে না মমতাজ। আমেনা কে বুকের সাথে সজোরে চেপে ধরলো মমতাজ। ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে উঠলো মেয়েটা।
রাত এত দীর্ঘ হয় তাও কি মমতাজের জানা ছিলো?? মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে আমেনা বললো-
আম্মু, আব্বু আসেনি?
এখনো পৌছায় নি মা।
ফোন করেনি?
ঘুমিয়ে পড়ো এখন।
দীর্ঘশ্বাস চাপে আমেনা। চোখ বন্ধ করে দুবার ফোঁপায় সে।
মমতাজ সিদ্ধান্ত নিলো কাল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে সে যেভাবেই হোক। আজহার আলীর কর্মস্থলে গিয়ে খোঁজ নেবে।
দীর্ঘ ঘন্টা, দীর্ঘ মিনিট পরে ফজরের আযান শোনা গেল। মমতাজ যেন এরই অপেক্ষায় ছিলো। উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে। বাথরুমে যাবে অযু করতে এমন সময় গেটে শব্দ শুনতে পেলো মমতাজ। বুকের ভেতরে ছ্যাঁৎ করে উঠলো তার। দুরু দুরু বুকে দরজার দিকে গেল মমতাজ। দরজাটা খুলে দিতেই আজহারের ক্লান্ত মুখ টা দেখতে পেয়ে চমকে উঠল মমতাজ। ব্যাগ হাতে আজহার দাঁড়িয়ে আছে।
পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল মমতাজ। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আমেনা আর রাশেদ দুজনকেই দেখতে পেল। বাবার দিকে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ওরা। ভেতরে এসে ব্যাগটা রেখে দু হাত বাড়িয়ে বাচ্চাদের টেনে নিলেন তিনি। ক্লান্ত মুখে হাসি টেনে তিনি বললেন-
তোমাদের ছাড়া ঈদ কাটাতে পারি? তাই শত অসুবিধা সত্ত্বেও তোমাদের কাছে পৌছে দিলেন আল্লাহ।
আমেনা আর রাশেদ বাবার বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করার ভাষা নেই যেন। বরাবরের চাইতে এবারের ঈদটা তাদের কাছে ব্যতিক্রম কিন্তু সেরা ঈদ তাতে কোনই সন্দেহ নেই।
ঈদের খুশি
জাকিয়া সিদ্দিকী
অগাস্ট ১৩, ২০১৯ইং