১.
সেদিন রাতে হুট করেই চাপ খেয়ে আফিয়ার চশমাটা ভেঙে গেলো। আফিয়ার অনেক প্রিয় চশমা এটা, পাঁচ বছর ধরে ব্যবহার করছিলো। সহ্য হচ্ছিলো না প্রিয় চশমার এই প্রস্থান।
সে ঠিক করার চেষ্টা করে, জোড়া দিতে চায়, কিছুই হয় না। এতোদিন যেই চশমা ঠিকঠাক কান আর নাকের উপর বসে থাকতো, সে আজ ঝুলে ঝুলে পড়ে যাচ্ছে।
ভেঙেছেও এমনভাবে যে ঠিক করা যাচ্ছেই না।
“প্লিজ আল্লাহ্, প্লিজ চশমাটা যেন ঠিক হয়ে যায়”- আফিয়ার গাল বেয়ে অশ্রু রূপ নেয় হাউমাউ কান্নায়।
এমন না যে সে আর চশমা কিনতে পারবে না বা তার কাছে এখন চশমা কেনার মতো টাকা নেই অথবা চশমা ছাড়া সে চোখে দেখেই না একদম। তা-ও কান্না পাচ্ছে। কারণ পাঁচ বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার আগে তাকে এটা কিনে দিয়েছিলেন। পরম যত্নে বাবার স্মৃতি চোখে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো আফিয়া, যেন বাবাই তাকে সব দেখাচ্ছেন, চেনাচ্ছেন, সেই ছোটোবেলার মতো।
এখন হয়তো সে আরো চশমা কিনতে পারবে, কয়েকটাই কিনতে পারবে, তবুও নির্মম সত্য তো এটাই যে বাবার স্মৃতিটা হারিয়ে যাবে, সেই পরশ আর থাকবে না। আদুরে মেয়েটা কীভাবে মানবে এই হারিয়ে যাওয়া?
“আল্লাহ্, কাল সকালে ঘুম থেকে উঠার আগেই যেন একটা মিরাকল ঘটে যায়, চশমাটা যেন ঠিক হয়ে যায়”-প্রার্থনা করতে করতে নোনা অশ্রু নিয়েই একটা সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।
পরদিন সকালে চোখ খুলতেই পাশের টেবিলে হাত গেলো। নাহ, আজ আর অন্যান্য দিনের মতো চশমাটা তার জন্য সেখানে নেই। রাতের সেই দুঃখ উথলে উঠলো।
রাগে দুঃখে দিন দশেক কাটিয়ে দিলো চশমা ছাড়াই।
তারপর একদিন বেরুলো নতুন চশমা কেনার জন্য। দোকানে গিয়ে আগেরটার মতো খুঁজছে, পায় না। দোকানী জানালো,
“আপু, ঐ ফ্রেম তো আর পাবেন না এখন। বাজারে নতুন ব্র্যান্ড আসছে, নিয়ে যান।”
কিছু করার নেই, নতুন করে চোখ দেখিয়ে নতুন চশমা নিয়ে আফিয়া বাড়ি ফিরলো সেদিন। বাড়ি ফেরার সময় থেকে সবকিছু আজব আজব লাগা শুরু করলো। চারপাশে এতো আলো কেন? জানুয়ারি মাস চলে, এই সময়ে এতো রোদ থাকে কখনো? শেষ কবে এই সময়ে এতো রোদ ছিলো? অদ্ভুত তো!
পরদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েও দেখে আশপাশটা ভীষণ উজ্জ্বল। রঙগুলো যেন ঝলমল করছে, এতো স্পষ্ট লাগছে সব! এক বান্ধবীকে দূর থেকে দেখেও চিনে ফেললো। অন্যদিন হলে এতো দূরে সে দেখতোই না!
আফিয়ার কপালে ভাঁজের রেখা কমে গেলো কয়েকটা, একটা সময় খেয়াল করলো, তার ঠোঁটের কোণায় হাসিও জমেছে খানিকটা। “এটা নিশ্চয়ই এই নতুন চশমার কারসাজি”- আনমনে ভাবনা চলে এলো।
২.
আসুন, আফিয়ার জায়গায় নিজেকে ভাবি। চশমাটাকে রূপক অর্থে নেই। একটু হিসাব করি,
“আর কী সেই বয়স আছে!”
“এতো সময় নেই আমার……”
“কক্ষনো সম্ভব না……”
‘আমি কখনোই পারবো না……“
“আমি পারি না কারণ………”
“এই কাজের যোগ্যতা আমার নেই……”
“আমি এমনই………”
“করলে তো ভালোই হতো কিন্তু………”
এই কথাগুলো বলে বলে জীবনে কতোবার কতো কাজ নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি? কতোবার কেউ আমাকে পিছিয়ে দেওয়ার আগেই, কতোবার পিছিয়ে পড়ার আগেই, কতোবার মাঠে নামার আগেই নিজেকে নিজেই পিছিয়ে দিয়েছি?
আফিয়ার মতোই আমরা লম্বা সময় ধরে একই চশমায় জীবনটাকে দেখছি, বিচার করছি। অনেকদিনের চলে আসা ধ্যানধারণা বদলানোর কোন উদ্যোগ নিচ্ছি না, বদলানো যে প্রয়োজন, সেটা অনুভবও করছি না। ভাবছি, আমি যা দেখছি, যা ভাবছি, তা-ই তো ঠিক। এর বাইরে তো কিছু নেই। চোখে লাগানো এই পুরনো চশমাটা ঠিক করে দিচ্ছে কী ভুল আর কী সঠিক, কী সম্ভব আর কী অসম্ভব। অথচ জীবন বদলে গেছে অনেকখানি, আমার নিজেরও বদলানো দরকার। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে এলো।
এই চশমাটা আমাদের বিশ্বাস, নিজেকে নিয়ে যা ভাবছি, অন্যকে যেমন ভাবছি, সেই বিশ্বাস। জীবনের অনেক সম্ভাবনা, অনেক রোদ্দুরই হয়তো দেখতে পারছি না, কারণ বিগত বছরগুলোয় আমাদের চোখের ফোকাস দূরত্ব কমেছে-বেড়েছে, চশমাটা মলিন হয়েছে, কিন্তু চশমা আর বদলানো হয়নি, সে আমার দৃষ্টিকে সংকীর্ণই করে রেখেছে।
ভাবুন তো, সেদিন সকালে যদি আফিয়া উঠে দেখতো ভাঙা চশমা ঠিক হওয়ার মিরাকলটা ঘটে গেছে, তাহলে কি আর রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটা দেখা হতো তাঁর? আল্লাহ্ তো চাইলে ঠিকই পারতেন সেটা করতে। বুকভরা অভিমান নিয়ে আফিয়া দশদিন ঘুরে বেড়িয়েছে সত্যি, কিন্তু এরপর তো উজ্জ্বলতা এসেছে। সে তো আগে বুঝতেই পারছিলো না যে সে ঠিকঠাক দেখছে না। তাঁর তো মনে হতো, পৃথিবীটা এমনই, সকালের রোদ্দুরে একটা মরা মরা ভাব থাকে। অথচ, সত্যি কিন্তু তা না।
আমাদের যেন আমরাই আটকে না ফেলি।
হ্যাঁ, আমি হয়তো জানি নিজের কোন দিকগুলো আমাকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু এর বাইরে সত্যিই আরো অনেক যোগ্যতা আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন, এই পুরনো চশমার জন্য সেগুলো দেখতে পাচ্ছি না। আমার দেখার পৃথিবী দিনকে দিন ছোটো হয়ে আসছে।
আমি বিশ্বাস করি, দৃষ্টিভঙ্গির এই দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করার সেই যোগ্যতাও আমার-আপনার আছে। এতোদিন খুঁজে দেখা হয়নি কারণ আপনি হয়তো বুঝতেই পারেননি যে এগুলোই আপনাকে আটকে রেখেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আপনি জানেন কোন কোন দিক দিয়ে আপনি নিজেকে পিছিয়ে রাখছেন; প্রতিদিনকার কথাবার্তায় নিজের দেখার সীমাবদ্ধতা যে প্রকাশ পেয়ে যায়, তা আপনি ঠিক ঠিক ধরতে পারেন।
যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষন আঁশ; কথাটা আসলেই সত্যি!
আরেক বার, আরো অনেক অনেক বার নিজেকে উদ্ভাসিত করার সুযোগ মৃত্যু পর্যন্ত আপনার আছে। চলুন, নিজেকে খুঁজে বের করি, চশমাটা বদলাই, স্রষ্টার কাছে আবার আবার কৃতজ্ঞতায় মাথা নোয়াই।
ভাঙা চশমার দুনিয়া
– নাবিলা আফরোজ জান্নাত
(১৭/০৩/২০১৯)