নতুন নতুন মা

অনলাইনে আপনি প্যারেন্টিং এর উপর অনেক ম্যাটেরিয়ালস পাবেন। ভিডিও, অডিও, নোটস অনেক কিছুই। কিন্তু যা সহজে পাবেন না তাহলে প্যারেন্টস এর জন্য কিছু। কি দরকার এসবের?

একজন মেয়ে যখন প্রথমবার মা হয়, হঠাৎ করেই সে উপলব্ধি করে, ঘুম বা খাওয়ার মত মৌলিক চাহিদাগুলোও খুব আরামসে সেরে নেওয়া যাচ্ছেনা। কথাটা শুনতে যত সহজ, বাস্তবে ততটাই কঠিন।

একটা মানুষ যখন রাতের পর রাত প্রয়োজনমত ঘুমাতে পারেনা, খাবার অর্ধেক খেয়ে উঠে আসে বাচ্চার কান্না থামাতে, এক সময় মানুষটা নিজের অস্তিত্ব হারাতে বসে। কথার ফাঁকে একটা জরুরী কথা বলে দেই, মাতৃত্বের প্রথম ধাপগুলো একটু কষ্টকর হলেও পরে এগুলো অনেক সহজ হয়ে আসে, এবং কেউ কেউ সামলে নেয় দারুণ ভাবে আলহামদুলিল্লাহ, আবার কেউ কেউ বেবি ব্লুতে ভোগে। কখনো কখনো এই বিষণ্ণতা দীর্ঘস্থায়ী মনোবৈকল্যের সূচনা ঘটায়।

২০১৪ এর শুরুর দিক। কিছুদিন আগেই আমার রব্ব আমাকে আমার জীবনের অমূল্য উপহার দিয়ে ধন্য করেছেন, আমার পুত্র আব্দুল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।

কিন্তু জীবন মানেই পরীক্ষা, আর মা হওয়ার পরীক্ষা যদি সহজই হবে, তবে কি আর পায়ের নিচে জান্নাত হতো?

খুব এলোমেলো ছিল সময়টা। খুব অগোছালো।

মাথার চুল আচড়ানো বা ব্রাশ করাও যে পরীক্ষা, মাছের কাঁটা বেছে এক প্লেট ভাত খাওয়াও যে এক সংগ্রাম এটা তখন উপলব্ধি করলাম।

জীবনের একেক স্টেজে একেক রকম পরীক্ষা। অন্যের পরীক্ষা দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আল্লাহ কাউকেই তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা দেন না। আবার কারো পরীক্ষা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

একদিন এক বোন কে আমাকে দারুণ সাজেশন দিল। একটা ডাইরিতে আমার লাইফের গোল লিখতে বলল, লিখতে বলল আমি নিজেকে পাঁঁচবছর পর কোথায় দেখতে চাই।

ডাইরি নিয়ে বসলাম,

পাঁচটা জিনিস লিখেছিলাম পাঁচ বছরের মধ্যে এচিভ করতে চাই। এরমধ্যে সবচে অসম্ভব মনে হয়েছিল যেটা, জাস্ট লিখার জন্য লিখেছিলাম, সেটাই আল্লাহ আমাকে তার দুই বছর পর দিয়ে দেন আলহামদুলিল্লাহ। আর মোটামুটি এচিভ করা সম্ভব যেটা ভেবেছিলাম, সেটা এখনো হয়নি আলহামদুলিল্লাহ।

এটা এখনো আমাকে দারুণ ভাবায়। আমি ভাবছিলাম আমি যা চাইছি সেটা পাঁচবছরে তো পাওয়া সম্ভব না, তাও লিখে রাখি। কিন্তু রাজাদের রাজা, মালিকুল মুলক এঁর জন্য কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি আমাকে অসম্ভব সম্ভব করে দেখিয়ে ধন্য করেছেন।

নিজের উইকনেস, যা আমাকে প্রায়শই বিপদে ফেলতো, লিখে রেখেছিলাম। আর আমার স্ট্রেন্থ, আমাকে দেয়া আল্লাহর নিয়ামতগুলো লিখেছিলাম।

উইকনেসগুলোকে দূর করার বা সেগুলোকে স্ট্রেন্থ এ বদলে দেয়ার দুয়া করতাম আর ট্রেন্থ বা নিয়ামতগুলোর জন্য শোকরানা আদায়।

আমার পরিস্থিতি এদেশের মায়েদের মতই ছিল। বাচ্চা পালতে কি কি ভুল করছি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা করতো। যারা বলতেন তাদের নিয়ত হয়ত ভালো ছিল, কিন্তু একা একা সব সামলে এসব শোনা খুব ক্লান্তিকর ছিল। ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে একটু বেড়িয়ে আসাও সম্ভব ছিল না। অথচ সেসময় মানসিকভাবে সুস্থ থাকা খুব খুব জরুরি।

আমি ফোনে এমন মানুষদের সাথে যোগাযোগ রাখতাম যারা আমাকে আমাকে ভালোবাসেন, ভালো জানেন, পজিটিভ কথা বলেন।

ছেলে যখন একটু দাঁড়াতে শিখলো, তখন ওকে কোলে নিয়ে বিকালে বাসার নিচে হাটতাম। মা-ছেলে দুজনেরই বোরডম কাটতো আলহামদুলিল্লাহ।

আমি খুব মজার কিছু দুয়া করতাম,যেমন

-হালাল বিনোদনের সহজতা
-উত্তম ও মুমিন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা
-ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ
-সম্মান ও কল্যাণ
-অন্তরের প্রশান্তি, ইত্যাদি।

মাত্র চার বছর আগের কথা। কোন দুয়া কবুল হয়েছে। কোনটা হয়নি। কোন কোনটা আমিই এখন আর চাই না। কিন্তু এই দুয়াগুলো আমাকে জীবনের সবচে বড় শিক্ষা দিয়েছে।

শিখিয়েছে দুয়া কবুল হয়। দুয়াকে অযথা মুমিনের অস্ত্র বলা হয় না। দুয়া জীবনের মোড় এমন ভাবে ঘুরিয়ে দিতে পারে যা নাটকীয় বলে অভিহিত করি আমরা। যেখানে ভেবেছিলাম শেষের শুরু, সেটাকেই আমার রব্ব শুরুর শেষ প্রমাণ করেছেন। যেখানে ভেবেছিলাম সব দরজা বন্ধ সেখানেই নতুন দরজা খুলে দিয়েছেন। যে পথ অন্ধকার আর স্যাঁতস্যাঁতে ছিল, সেই পথই তিনি আলোয় ঝিকমিকিয়ে দিয়েছেন।

হ্যা, পরীক্ষা তো এখনো আছে, থাকবেও। কান্না, কষ্ট এগুলোও জীবনের অংশই। কিন্তু কেউ যদি সব হারিয়েও নিজের পরিচয় খুঁজে পায়, নিজের রব্বের পথকে চিনে নেয়, তবে সেই কি আসল বিজয়ী নয়?

……………..

নতুন নতুন মা
নূরুন আলা নূর
৮ নভেম্বর ২০১৮