১.
প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষ করে নিজ হাতে মসজিদ পরিষ্কার করেন আব্দুল মান্নান । মসজিদ পরিষ্কার করে এক অনাবিল আনন্দ পান তিনি, এই মসজিদের ঈমাম এবং মুয়াজ্জিনের দায়িত্বে তিনিই আছেন। হাশরের মাঠে মুয়াজ্জিনের মর্যাদা থাকবে সবচেয়ে বেশি, এই হাদিস জানার পর থেকে কিছুতেই লোভ সামলাতে পারেননি আব্দুল মান্নান।
আজ থেকে ২০ বছর আগে নিজের জমানো টাকা দিয়ে এই মসজিদ বানিয়েছিলেন । প্রথমে তা খড়ের বেড়া দিয়ে তৈরি হলেও কালক্রমে এটি এখন ইটের তৈরি সুন্দর সাজানো একটি মসজিদ। জীবনে কোনদিন এই মসজিদ থেকে একটি টাকাও নেননি আব্দুল মান্নান, বরং দিয়েই গিয়েছেন। আর এখন এই মসজিদ নিয়ে মানুষের কত রাজনীতি! সবাই মসজিদের কমিটিতে উচ্চপদ পেতে চায়! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আব্দুল মান্নানের বুক চিড়ে।
২.
সকাল ৮টা নাগাদ মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরে এশরাকের নামাজ পড়ে হালকা ঘুমানো আব্দুল মান্নানের নিত্যদিনের অভ্যাস।
এই গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত, তাকওয়াবান, পরহেজগার, নীতিবান ব্যক্তি হলেন আব্দুল মান্নান। শুধু এই গ্রামের না, আশেপাশের গ্রামগুলোর ছোট বড় সকলেই তাকে সমীহ করে চলে। ১৭ বছর বয়স থেকে তাহাজ্জুদ শুরু করেছিলেন, এই ষাটোর্ধ বয়সে এসেও তিনি মনে করতে পারেন না কোন দিন তাহাজ্জুদ পড়া একদিনের জন্যও বাদ পড়েছিল কিনা।
কষ্টের জমানো টাকা দিয়ে তৈরি করেছেন এই এলাকার একমাত্র মাদ্রাসা। জীবনে কোনদিন কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলা তো দূরের কথা বরং মানুষেরা তাকে বাঁকা কথা বললেও কোনদিন এসব কথার উত্তর পর্যন্ত দেননি। এ নিয়ে তার স্ত্রী লতীফা বেগমের অভিযোগের কমতি ছিল না। গীবত/পরনিন্দা থেকে বহুদূর সরে থেকেছেন। হারামের আশপাশ দিয়েও ঘেষেননি কখনো। হাইস্কুলের হেডমাস্টার হয়েও যে কয়টা টাকা পেতেন খুব স্বচ্ছল সুন্দর ভাবে জীবন পার করে দিয়েছেন তিনি, কোনদিন কারো কাছে ধার পর্যন্ত করতে হয়নি।
৩.
বাড়ির সামনের উঠোনে আম গাছের নিচে চেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন আব্দুল মান্নান। আম, জাম, লিচু, পেয়ারাসহ বিভিন্ন রকমের গাছপালা দিয়ে বাড়িটা ভরপুর। গাছ লাগাতে পছন্দ করেন তিনি, বিশেষ করে সদকা জারিয়ার ব্যাপারটার জন্য তার এ রুচি আরো বেড়েছে।
সামনে খোলা মাঠ, মৃদু বাতাসে ধানের সবুজ শিষগুলো দোল খাচ্ছে।
হঠাৎ কে যেন গম্ভীর কন্ঠে ডাকল, “আব্দুল মান্নান!”
চমকে পিছনে ফিরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি। মনের ভুল ভেবে পড়ায় মন দিলেন।
কিন্তু আবারো কে যেন ডেকে উঠল, “আব্দুল মান্নান!” এবার কয়েকবার।
আবারো পিছনে ফিরে কাউকেই দেখতে পেলেন না আব্দুল মান্নান। এবার তিনি বলে উঠলেন, “কে আপনি? আর কোথায়? আমি তো আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না।”
– “উপরে তাকাও তাহলেই আমাকে দেখতে পাবে(হাসি)।”
উপরে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন আব্দুল মান্নান। জুব্বা পরা, মাথায় বড় পাগড়ি, মুখে দাঁড়িওয়ালা এক লোক তার ঘড়ের টিনের চালে হাটাহাটি করছে। চেহারাটা নূরানী, দেখে বড় মাপের হুজুর মনে হচ্ছে। লোকটি আবারো বলে উঠল,
“আমি তোমার কাজে খুব খুশি হয়েছি আব্দুল মান্নান। তাই আমি নিজেই চলে এসেছি তোমাকে স্বাগতম জানাতে।”
– কে আপনি? আর আপনি উপরে কেন! নিচে নেমে আসুন বসে কথা বলি।”
লোকটি কিছু না বলে টিনের চালেই বসল, বসেই আবার বলল, “আমি তুমার কাজে খুব খুব খুশি হয়েছি। চল মোসাফা করি।” বলেই হাত বাড়িয়ে দিল।
আব্দুল মান্নান হাত বাড়াতেই, মোসাফা না করে হাত ধরে টান দিল এবং সেই সাথে অদ্ভুত হাসি।
ঘুম ভেঙে গেল আব্দুল মান্নানের।
“ইয়া আল্লাহ! এটা স্বপ্ন ছিল! চাশতের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছিলেন তিনি। চিন্তায় পড়ে গেলেন আব্দুল মান্নান, কেন এরকম স্বপ্ন দেখলেন। এরকম স্বপ্ন তো আগে কখনই দেখেননি তিনি। আর এ নিশ্চয় শয়তান, এবং উচ্চপদস্থ কেউ। স্বয়ং ইবলিশ হতে পারে, তাই অহংকার বশত নিচে নামেনি।
ওহ্, মনে পড়েছে। আজ সকালে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় হালিমুদ্দির ব্যাপারে কথা বলেছিল চাঁনমিয়া। কমিটিতে উচ্চপদ পাওয়ার জন্য নাকি সে যা ইচ্ছা তাই করছে এমনকি আব্দুল মান্নানের নামে কুৎসা পর্যন্ত রটাচ্ছে। আব্দুল মান্নান নাকি মসজিদ থেকে টাকা মেরে খায়, এসব কথাও লোকজনকে বলে বেরাচ্ছে।
তাই আব্দুল মান্নাণ আজ সকালে কথায় কথায় বলে ফেলেছিলেন, “হালিমুদ্দি খুব বাড়াবাড়ি করতেছে, ওর বাড়াবাড়ি বন্ধ করা দরকার। নিমকহারাম হয়ে গেছে সে।” কারণ মসজিদের কমিটিতে পদ আব্দুল মান্নান নিজেই তাকে দিয়েছে।
তাহলে এটা গীবত ছিল!
আর এর জন্য ইবলিস নিজে স্বাগতম জানাইতে আসছে। হায় আল্লাহ!
৪.
এই গিবতের ব্যপারে সারা জীবন কত সতর্কই না থেকেছেন, অথচ আজ কিনা ..
আওযুবিল্লাহ.. বলে বাম দিকে তিনবার থুঁ থুঁ দিলেন ।
অযু করে দুই রাকাত নফল নামায আদায় করলেন। বেশ অনেকবার এস্তেগফার পড়ে, আল্লাহ তা’লার কাছে মাফ চাইেলেন।
এরপর হালিমুদ্দির বাড়ির উদ্দ্যেশ্য বের হলেন। কারণ গিবত করা হল বান্দার হক নষ্ট করা। কেউ বান্দার হক নষ্ট করলে, যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে মাফ না করলে আল্লাহ তা’লা কখনই মাফ করবেন না। পাপ মাফ না হলে আখিরাতে নিজের সওয়াব থেকে যার নামে গিবত করা হয়েছে তাকে দিয়ে দিতে হবে ।
হালিমুদ্দির বাড়ির সামনে এসে ডাকলেন,
“আসসালামু আলাইকুম, হালিমুদ্দি বাড়ি আছ?”
– “ওয়ালাইকুম সালাম, হুজুর আপনি? আসেন ভিতরে আসেন।”
– “না থাক, এখানেই বলি। আজ সকালে আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। তুমার নামে বদনাম করেছি, ভাই আমাকে মাফ করে দাও। আসলে বলতে চাই নি, কথা প্রসঙ্গে কিভাবে যে এই ভুলটা করলাম!
যারা মানুষের গীবত করে বেরায়, তাদের জন্য আল্লাহ তা’লা হুতামাহ নামক বিশেষ জাহান্নাম বানিয়ে রেখেছেন। তাফসিরকারকদের মতে জাহান্নামের মধ্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আগুন হল হুতামার। এখন মাফ না চাইলে হাশরের দিন আমার সওয়াব থেকে তুমারে দিয়ে দেয়া লাগবে। আমার ভালো কাজ এমনিতেই কম, তুমারে দেয়া লাগলে আমি যে আর পুলসিরাত পার হতেই পারব না। তাছাড়া এই গীবতের জন্য কবরের আজাব হবে। তাই ভাই মাফ চাইতে আসলাম।
অনেকদিন পর যেন হালিমুদ্দির ঘুম ভাঙল। মনে মনে আওড়াতে লাগল, “হায়! আমার কী হবে!”
……………………………
অনুতাপ
মাইমুনা জ্যোতি
জুন ২২, ২০১৮ইং