১.
কখনো পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত বড় সেলেব্রেশনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। শুধু পহেলা বৈশাখ না, এমনিতেও আমার এধরনের কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া হতো না। হয়তো শোরগোল পছন্দ ছিল না বলে।
২০১৫ সাল। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ি তখন। বান্ধবীরা খুব করে ধরলো সবাই একসাথে বৈশাখের অনুষ্ঠানে যাবে। তাই হঠাৎ করেই যাওয়ার প্ল্যান করে ফেললাম। বান্ধবীদের সাথে ঢাবিতে পড়ে একটা আপু যাবে শুনে আমার ছোট বোনকেও সাথে নিয়ে গেলাম।
সেই পহেলা বৈশাখেই ঘটেছিল এক ভয়ংকর বিভৎস ঘটনা, যা এখনো মনে পড়লে গায়ে কাটা দেয়।
দুপুরে সেখানে খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডে চলে যাই। হই-হট্টগোলের প্রচণ্ড শব্দে মাথা ব্যথা করছিল খুব, তাই বাসায় চলে আসি বোনকে নিয়ে। ঠিক বাসায় পৌঁছানোর পর পরই টিভির খবরে সেখানে যৌন নির্যাতনের কিছু চিত্র আর ভিডিও দেখাচ্ছিল।
কিসের থেকে বেঁচে ফিরেছি ভাবতেই ভীষণ কান্না পাচ্ছিল ওইখানে থাকা বোনদের কথা ভেবে।
বরাবরের মতো এই ইস্যুতেও ফেবুতে অনেকেই অনেক স্ট্যাটাস দেয়া শুরু করে দিল সেবার। কেউ মেয়েদের দোষ দিচ্ছে – না গেলে এমন হতো না অথবা পর্দা করে চললে এমন হয় না। আবার কেউ শুধুই ছেলেদের দোষ দিচ্ছে।
এই আমিও সেদিন এক স্ট্যাটাসের বিরোধিতা করে লিখেছিলাম। বলেছিলাম, “দেশটা তো সবার, যে যার মতো করে চলবে। তাই বলে কেউ এধরণের আচরণ করবে নাকি….।”
সমস্ত সোশাল মিডিয়া এর তীব্র প্রতিবাদে ভরপুর হয়ে গিয়েছিল। আমিও সেখানে সামিল হলাম।
অথচ আমার সৃষ্টিকর্তার বিধানে আমার জন্য কী হুকুম আহকাম লেখা ছিল তা তখনো স্পষ্ট ছিল না। দ্বীনের ব্যাপারে যা জানতাম তার মধ্যে অনেক অপূর্ণতা ছিল।
২.
“তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্য আর আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্য”
– সুরা কাফিরুন-৬.
একদিন কুরআনের একটা আয়াত চোখে আটকে গিয়েছিলো, কিন্তু বোঝার ক্ষমতা ছিল না, তাই আম্মুর সংগৃহীত তাফসীর খুলে ব্যাখ্যা পড়া শুরু করলাম।
মনে হচ্ছে আমাকে কেউ উপদেশ দিচ্ছেন যেন,
যেমনটা আব্বু দিতেন ছোটবেলায় — আগুন, পানিতে খেলতে নিষেধ করতেন। তেমন করে যেন কেউ আমাকে বোঝাচ্ছেন। আমি আমার নফসের অনুসরণ করছি, যেভাবে ইচ্ছে হচ্ছে সেভাবেই চলছি, যা আমাকে জাহান্নামের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আর কিছুদূর গেলেই পড়ে গিয়ে জ্বলবো আজীবন। রবের বিধান বাদ দিয়ে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলার পরিণতি জানলাম সেদিন।
ভয়ে সেদিন ঘুমাতে পারিনি।
একটা মেয়ের জন্য কোনো জায়গাই আসলে নিরাপদ নয়, আর এরকম জায়গাগুলোতে যেখানে ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশা আছে সেখানে কী করে নিরাপদ হতে পারে?
বন্ধুত্বের নামে ঘটে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা। সেখানে ভালো মানুষের মুখোশের নীচে থাকে হিংস্রতা, পাশবিকতা।
সেদিন থেকেই শুরু হলো আমার বদলে যাওয়ার দিন।
এক পরিচিত বোন একদিন ডাকলেন তার বাসার পাশেই হালাকার দাওয়াতে। হালাকা মানে ইসলামী আলোচনা সভা।
ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই স্পিকারের শব্দ কানে আসলো “আল্লাহ আমাদের পছন্দ করেছেন বলেই আমরা এই আসরে একসাথে হয়েছি…।”
এবারো খুব কান্না পেল। এই পাপী বান্দাকে আল্লাহ এত অনুগ্রহ করেছেন আর বান্দা কিনা তার জন্য নামাজের সময়ও বের করতে পারে না!
আল্লাহ মিলিয়ে না দিলে এই সুদৃঢ় সঠিক পথের আনজাম কেউই দিত না আমাকে।
৩.
পহেলা বৈশাখ বাঙালি ঐতিহ্য, আমরা বাঙালি তাই বাঙালি প্রথা পালন করি। কিন্তু মুসলমান হয়ে নিজের ধর্ম পালনে কতোটা সচেষ্ট আমরা?
পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা ইভেন্টে শিরক হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা — যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ছেলে-মেয়ে উভয়কে পর্দার আদেশ দিয়েছেন। উভয়পক্ষকেই কুরআনে দৃষ্টির হেফাযত করতে আদেশ করা হয়েছে।
হজ্জ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইভেন্টগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানেও কিন্তু লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ একসাথে সমবেত হয়। অথচ ইসলামের বিধান মানার কারণে কখনো এই ইভেন্টে আমাদের পহেলা বৈশাখের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি, কখনো ঘটবেও না ইনশাআল্লাহ্।
আর সম্প্রতি আমরা দেখেছি কী জঘন্য সব ঘটনা ঘটে চলেছে পথে-ঘাটে আমাদের মা-বোনদের সাথে। কাকে দোষ দেব আমরা?
শুধু ইসলাম ধর্মের বোনদেরকেই নয়,
অন্য ধর্মাবলম্বী বোনদের; শুধু পর্দানশিন নয়, পর্দাহীন মেয়েদেরও একটাই কথা বলতে চাই —
যে দেশে একটা মেয়ে ধর্ষিত হলে তার সুবিচার পাওয়া যায় না…
যৌন নির্যাতনের স্বীকার হলেও যেখানে কিছুই বলার থাকে না…
রাজনীতির ছায়াতলে যে দেশে অপরাধীরা প্রমাণ থাকলেও ছাড় পেয়ে যায়…
সেই দেশে আপনি মিথ্যে নিরাপত্তার অধিকার নিয়ে তথাকথিত প্রথা পালন করতে গিয়ে নিজের সম্মানটাই হারাবেন বোন।
……………..
অদৃশ্যের ডাক
নবনী
এপ্রিল ১২, ২০১৮ইং