মারবফতী স্বামী বশীকরণ

১.

কমনরুমে ঢুকে দুই হাত দিয়ে টাশ টাশ করে সব সুইচ অন করল রিয়া। এসব কী রিয়া! তোর সব ফ্যান লাইটই লাগবে? মাঝের টেবিলের ফ্যানটা রেখে বাকীগুলো অফ কর!

মিলির ধমকে রিয়া থুক্কু বলে আবার টাশ টাশ করে সুইচ অফ করতে লাগল। কোনটা মাঝের ফ্যানের সুইচ? সব সুইচ একবারে চাপলে বোঝার উপায় নেই। রিয়া ভেবে চিন্তে কিছু করতে পারে না। দৈবভাবে মাঝের সুইচ খুঁজে পাবে এই আশায় দুই তিনবার অন অফ চলল। শেষে সুমি এসে তাকে উদ্ধার করল। একটা দুইটা সুইচ চেপেই ও বুঝে ফেলেছে কোনটা কাংখিত সুইচ।

এক মাস গ্রীষ্মের ছুটি শেষে ক্যাম্পাস আবার জেগে উঠেছে। ক্যান্টিন মাঠ সিঁড়ি সবখানে আড্ডা চলছে। কেবল কমনরুমটা ফাঁকা। সুমীরা নিক্বাবী হওয়ায় কমনরুমই ওদের আড্ডাস্থল। নিক্বাব খুলে আরাম করে আড্ডা দেয়া যায় এখানে। এবারের রুটিনটা একটু উলটাপালটা। সকালের ক্লাস শেষে তিন ঘন্টা গ্যাপ।

সারাদিন ক্যাম্পাসেই থাকতে হবে কিন্তু ক্লাস নেই। মিলি সাধারণত হলে চলে যায়। কিন্তু এক মাস পর বন্ধুদের পেয়ে তার আর যেতে ইচ্ছে করছে না। সুমি বিয়ে করে হল ছেড়েছে দেড় মাস হল। আর রিয়া বাসায় থাকে। একমাস ছুটি কাটিয়ে তিনজন তিনজনার চেহারা ভুলতে বসেছে প্রায়।

“সুমি, তোর ভোটকা ব্যাগটা দে না একটু বালিশ বানাই।” টেবিলের উপর উঠতে উঠতে রিয়া বলল। এত এত চেয়ার থাকতে ওর কেন টেবিলে উঠতে হয় সে এক রহস্য। মিলি একদম বিপরীত। চেয়ারে মেরুদন্ড সোজা করে বসে। রিয়ার মতে জন্মের সময় ওর নাম রাখা হয়েছিল মিলিটারি। কালের বিবর্তনে টারি কাটা পড়লেও স্বভাবটা মিলিটারির মতই আছে।

ব্যাগকে বালিশ বানানো শেষ। সবাই যার যার মত আরাম করে বসেছে। এখন কুশল বিনিময়ের পালা। অবিবাহিত মেয়েরা বেঁচে আছে না মরে গেছে ওতে জানার কিছু নেই। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন সুমি। ওর সংসার কেমন চলে এটাই সবচেয়ে জরুরী প্রশ্ন। যাকে বলে কনটেম্পোরারি ইস্যু।

সুমি এক দুই কথায় যা বলছে তার সারমর্ম হল আলহামদুলিল্লাহ সে ভাল আছে। সবাই ভাল থাকতে চায়, অন্যেরা ভাল থাকুক এমনটাই চায়, কিন্তু কেবল ভাল থাকার খবরে কেন যেন মন ভরে না। গল্প আগাচ্ছে না দেখে রিয়াই মুখ খুললো। সুমি একটু খোলাখুলি বল না! কেমন ভাল আছিস? জামাই মারে না? শাশুড়ি জ্বালায় না? কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবি। ফেসবুকে তোর পক্ষ নিয়ে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দিয়ে দিব।

রিয়ার কথায় গম্ভীর মিলিও হাসি আটকাতে পারে না। ওদের আড্ডার মাঝে কয়েকবার ক্লাসের মেয়েরা এসে জয়েন করেছে। ফেইসওয়াস দিয়ে মুখ ধুতে ধুতে সুমির সংসার কেমন চলছে জেনে নিয়ে আবার চলে গেছে। সুমি হাসিমুখে এক এক করে সবাইকে জানাচ্ছে সংসার বেশ ভাল চলছে।

একজন প্রশ্নে একটু বৈচিত্র্য আনলো। হাজবেন্ডও তোর মত হুজুর? সুমির উত্তর- হ্যাঁ রে হাজবেন্ডও হুজুর। আমার মত না, ওর মত হুজুর। কথাটা মিলির কানে খট করে লাগল। প্রশ্নকর্তার প্রস্থানের পর সুমির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল- হাজবেন্ড ওর মত হুজুর মানে কী রে? তোর মন মতো না? সুমি খানিকটা বিব্রত। অপ্রস্তুত একটা হাসি দিয়ে বলল, আর বলিস না…ও কেমন জানি একটু। মারেফতি টাইপ!

“কীইইহ!” মিলি যেন হাই ভোল্টেজের শক খেয়েছে। ব্যাগ-বালিশে হেলান দেয়া রিয়াও লাফিয়ে উঠেছে। -কী বললি এটা তুই? বিয়ের আগে খোঁজ নিস নি? -আরেহ তোরা যেমন ভাবছিস অমন না। আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না!

– পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়ে? মিলি বেশ চিন্তিত।
-হ্যাঁ তো! জামাতে সালাত পড়ে।
– তাইলে? একতারা হাতে ‘প্রেম রাখিও অন্তরের ভেতওওওর’ গাইতে গাইতে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে চায়? নাকি মারেফতের ঠ্যালায় বাঁশ বেয়ে উঠা নামা করে?

“উফ রিয়া! সিরিয়াস মুহূর্তেও তোর বাজে না বকলে চলে না?” সিরিয়াস মিলি এখন আরো বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছে। সুমি বেশ ঝামেলায় পড়ে গেছে। তার স্বামী ঠিক মারেফতি না। আবার অন্য কোনো শব্দে তাকে সংগায়িত করা যায় না। মিলি আর রিয়াকে সমস্যাটা খুলে বলবে কি বলবে না তা নিয়ে ও আগে থেকেই দ্বিধায় ছিল। এখন মুখ ফসকে বলে ফেলেছে কিন্তু ব্যাখ্যা করতে পারছে না।

– আসলে আমার জামাই সালাত পড়ে, দাড়ি আছে, লিবাসি… সবই ঠিক আছে। কিন্তু ও জানি কেমন। “কখন থেকে কেমন জানি কেমন জানি করছিস। বুঝিয়ে বল না, কেমন জানিটা কেমন?” রিয়া ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে।

– এই ধর… ইসলামের সবকিছু নিয়ে তার মতামত আছে। চান্স পেলেই জ্ঞান ঝাড়তে থাকে। এমন সব যুক্তিতর্ক… কী বলব! কস্মিনকালেও এমন কিছু শুনিনি। আমিও তো ইসলাম নিয়ে পড়ছি, নাকি?

স্কলারদের অপিনিয়নের সাথে ওর তারছিঁড়া বিশ্লেষণ একেবারেই যায় না। মাথা আউলা হয়ে যায় আমার।

– ধ্যাত! সুমি তুই পুরা আজাইরা একটা জিনিস। এই সামান্য ব্যাপারে স্বামীকে মারেফতি ট্যাগ দিয়ে ফেললি! ইনসাফ নাই রে দুনিয়ায়!

উত্তেজনা কেটে গেছে। রিয়া আবার ব্যাগ-বালিশে হেলান দিয়েছে। মিলিও খানিকটা বিরক্ত। ওর মতে সুমি, রিয়া ইসলামের প্রায় সবকিছুকেই খুব লিটারেলি নেয়।

– শোন সুমি। তুই ইসলাম নিয়ে পড়েছিসই বা কতটুকু? এমন কি হতে পারে না তুই যেটাকে তারছিঁড়া বিশ্লেষণ ভাবছিস সেটা সঠিক?

– আরে আজব! আমি কম পড়েছি মানলাম। কিন্তু যতটুকু পড়েছি জেনেছি তার মাঝে কেউ উলটাপালটা বকলে আমি বুঝতে পারব না?

– আচ্ছা ঠিক আছে! তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম তোর হাজবেন্ড তারছিঁড়া ব্যাখ্যা দেয়। তাতে কী হয়েছে? এটা কত বড় ব্লেসিং তুই বুঝিস?

– ঐভাবে চিন্তা করলে তো সবই ব্লেসিং। কলার ছিলকায় উষ্ঠা খাওয়া ব্লেসিং, গাড়ির তলে পড়ে মরে যাওয়া ব্লেসিং..

– ঐভাবে কে চিন্তা করতে বলেছে রিয়া? সুমির হাজবেন্ড ওর সাথে নিজের ভিউ শেয়ার করে। কয়জনের স্বামী এটা করে? মতের মিল না হোক। ইলম চর্চায় এরকম পরিবেশ খুব দরকার! তোরা সবাই আছিস কেবল সাজুগুজু নিয়ে। এই লিপস্টিকে কেমন দেখায়, ওই আইশ্যাডোতে কেমন মানায়…বিরক্তিকর!

– কই থেকে কই গেলি তুই? মেয়ে মানুষ সাজবে না তো কারা সাজবে? ছেলেরা? তোর জামাই যদি লিপস্টিক দেয় তোর কেমন লাগবে?

“এই রিয়া! তোর মুখে কিছুই আটকায় না?” সুমি দুইজনকে থামানোর চেষ্টা করে।

“মিলি, তুই হয়ত আমাদের থেকে অনেক বেশি জ্ঞান রাখিস দ্বীনের ব্যাপারে। কিন্তু আমি মোটেও সাজুগুজু নিয়ে পড়ে নেই। ইসলাম নিয়ে ওর ভিউ শুনতে শুনতে দুইমাসেই আমি হাঁপিয়ে গেছি। কিছু ব্যাপারে দ্বিমত থাকা এক জিনিস। আর সব ব্যাপারে অদ্ভুতুরে থিউরি কপচানো আরেক জিনিস। আমার জামাই দ্বিতীয়টা করে। আর কথায় কথায় রুমীকে টেনে আনা তো আছেই!”

– রুমি! মানে তোর ছোট বোন? ইন্নালিল্লাহ! রিয়া আর মিলি দু’জনেই ভড়কে গেছে এবার।

– আরে ধুর! জালালুদ্দিন রুমী! এক মুহূর্ত নিরবতা। এরপর তিনজনই হোহো করে হেসে উঠল। সুমির হাসির সাথে কি একটা দীর্ঘশ্বাসও পড়ল? বাকীদের হাসির তোড়ে বোঝা গেল না ঠিক।

২.

বুধবারের সন্ধ্যাটা খুব একঘেয়ে। সকালে দুইটা ক্লাস করে সুমি বাসায় চলে আসে। দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাটটা হুট করে খুব বিশাল মনে হয়। এত বড় ফ্ল্যাটে সুমি একা! রাঁধা বাড়া সবকিছু সেরে মাগরিবের পর একেবারে ঝাড়া হাত পা। অনিক ফেরে সেই রাত দশটার দিকে। অবশ্য সুমি চায় না অনিক সকাল সকাল ফিরে মারেফতি বয়ানে ওকে বেহকুশ করে দিক।

তবু খুব খালি খালি লাগে। সেদিন মিলি আর রিয়া কেউই ওর সমস্যা বুঝতে পারেনি। মিলি ভেবেছে বাড়াবাড়ি। আর রিয়া খানিকটা স্বীকৃতি দিলেও বলেছে নট আ বিগ ডীল এট অল! রিয়া যদি সমস্যাটা বুঝতো তাহলে হয়ত কোনো বুদ্ধি দিতে পারতো। উলটো বলল, সুখে থাকতে ভুতে কিলাচ্ছে তোকে। তোর জামাইয়ের কোনো ভাল দিক নাই? ওগুলো নিয়ে সুখে থাক।

ভাল দিক যে নেই তা না। প্রায় সব কিছুই বেশ ভাল। অনিক বেশ ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। এটিকেট আর ম্যানার্সে রীতিমত পিএইচডি করা! ওর ভদ্র আচরণে মাঝে মাঝে সুমির খুব অপরাধবোধ হয়। সুমি এত এটিকেটের ধার ধারে না। অনিক যেন ওর চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আচরণ কেমন হওয়া উচিত।

প্রতিদিন সুমি ভাবে ভাল আচরণ করে স্বামীকে চমকে দিবে। কিন্তু মারেফতি বয়ান শুরু হলেই ওর মাথা কাজ করে না আর। মাথার তালু দপদপ করতে থাকে। রিয়া যতই বলুক নট আ বিগ ডীল, অনিকের সাথে মানিয়ে নিতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে সুমির।

যে করেই হোক মারেফতি স্বামীকে শায়েস্তা করতে হবে। মনে মনে অবশ্য জোড়াতালি মার্কা পরিকল্পনা এঁটেছে একটা। কিন্তু তাতে এতই জোড়াতালি যে বাস্তবায়ন করা যাবে কি না সন্দেহ! এখন শুধু আল্লাহর কাছে চাইছে যেন সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হয়। সুমি জানত না আজ সবকিছু ওর প্ল্যান মোতাবেকই ঘটতে যাচ্ছে। প্ল্যানটা তেমন কিছু না, স্বামীকে না খাইয়ে রাখতে হবে দীর্ঘক্ষণ।

সুমির ধারণা তার স্বামীর মৌলিক চাহিদাগুলো ঠিকঠাক পূরণ হচ্ছে বলেই সে সমাজ ধর্ম রাজনীতি নিয়ে এত তারছিঁড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সময় পায়। পেটে একদিন দানাপানি না পড়লে ঠিক বুঝতে পারবে এসব মারেফতি বয়ানের মূল্য কতটুকু!

৩.

ঠিক রাত দশটা সময় অনিক বাসায় ফিরলো। মুখটা একদম শুকনো। এসেই জানালো ভীষণ খিদে পেয়েছে। দুপুরে কাজের চাপে ঠিকমত খায়নি। একটা সিংগারা কোনোমতে গিলেছে। সুমি দিশেহারা। স্বামীটা কিছু খায়নি সেই দু:খে কাঁদবে, নাকি কাহিনী তার মনমত এগুচ্ছে সেই সুখে উদ্বেলিত হবে, ভেবে পাচ্ছে না। বুকে পাথর বেঁধে সুমি জানালো আজ সে রান্না করে নি।

বিনয়ের পরাকাষ্ঠা অনিকের শুকনো মুখ আরো শুকিয়ে গেল। তবু বলল, ইট’স ওকে। আমি সালাত পড়ে নেই। আজ জামাত মিস করেছি ঝড়ের জন্য। তুমি কি এতক্ষণে ভাত আর ডিম ভেজে ফেলতে পারবে? সুমি পারবে। এক চুলায় ভাত আরেক চুলায় ডিম ভাজি করতে খুব বেশি হলে পনের মিনিট!

কিন্তু সুমি তা করবে না। মুখ চোখ ভোঁতা করে অনিকের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল সে। যার উত্তর হ্যাঁ, না অথবা হ্যাঁ না এর মাঝামাঝি- যেকোনো কিছুই হতে পারে। আয়নায় নিজেকে দেখা গেলে বোঝা যেত অভিনয়টা কেমন হচ্ছে। অনিক ওর অভিব্যক্তি দেখার জন্য বসে নেই। খিদের জ্বালায় চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে।

ছেলেরা খিদে সহ্য করতে পারে না। খিদে সহ্য করতে পারে মেয়েরা। এর নাকি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। ব্যাখ্যাটা সুমির মনে নেই। মনে রাখার প্রয়োজনও নেই আসলে। সুমি তো বিজ্ঞানমনষ্ক না। সুমি হল পশ্চাৎপদ ধর্মান্ধ নারী, যে কি না আরবের লু হাওয়া থেকে বাঁচতে বাংলার মাটিতে পর্দা করে।

বিজ্ঞানমনষ্ক নারী হলে আনাড়ি হাতে সিগারেট ধরিয়ে ফুসফুসের বারোটা বাজিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানে বেশ অবদান রাখা যেত। অথবা ফেসবুকে কারণে অকারণে গালির তুবড়ি ছুটিয়ে বিজ্ঞানের নতুন শাখা গালিগালাজকে আরো সমৃদ্ধ করা যেত।

বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়া যেহেতু এত সহজ না, তাই সুমির ঠাঁই হল রান্নাঘরে। স্বামীর জন্য এখন সে ভাত চড়ানোর অভিনয় করবে। হাড়িতে পানি দিয়ে বেমালুম ভুলে যাবে চাল দেয়া হয় নি। কেবল পানি চড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে অভিনয়টা বেশি কাঁচা হয়ে যায়। ২ টা পেঁয়াজ একটা ডিম আর ছুরি হাতে বেশ ব্যস্ত ভাব ধরতে হবে। লবনের বাটি আনার জন্য ড্রইং রুমে দৌড়ে গেলে কেমন হয়? নাহ এটা আবার অতি অভিনয় হয়ে যাবে।

সালাত পড়ে অনিক রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছে। এটিকেট এন্ড ম্যানার্সের দাবি হল বউকে জিজ্ঞেস করা তার শরীর খারাপ কি না। এই দুইমাসে কখনো এমন হয়নি। অনিক বাড়ি ফিরেই টেবিলে খাবার পেয়েছে। কিন্তু পুরুষ মানুষ তো খিদে সহ্য করতে পারে না। এই মুহূর্তে রান্নার জন্য হাসিমুখে অপেক্ষা করাটাই বিশাল ব্যাপার।

অনিককে দেখে সুমি বিব্রত ভংগিতে হাসলো। “এই তো আর কয়েক মিনিট। চুলায় তো ভাত….” এটুকু বলে সুমি হা করে চুলার দিকে তাকালো। আগে কখনো অভিনয় করে নি। তাই জানা নেই কেমন হচ্ছে। অনিকের চোখও চুলার পাতিলে। টগবগ করে পানি ফুটছে। কোনো চাল নেই। “কী করেছি আমি! চালই তো দিই নি!” এ কথা বলে অনিকের দিকে বিস্ময়সূচক অনুশোচনার অভিব্যক্তি দিতে হবে। এ অভিব্যক্তি কী করে দেয়?

সুমি অভিনয়ে নতুন। ও যদি জানতো অনিক চোখে মুখে সর্ষে ফুল দেখছে তাহলে আর অভিব্যক্তি নিয়ে ভাবত না। অনিকই বলল, “তুমি চাল দিতে ভুলে গেছো।” ঠান্ডা মাথায় এটুকু বলাই যথেষ্ট। “তোমার কিছু একটা হয়েছে, তুমি যাও আমি রাঁধছি” বলার মত অবস্থা অনিকের নেই। সুমি সাধ্যমত অপরাধীর হাসি হেসে বলল, এখনই চাল ধুয়ে এই পানিতে ছেড়ে দিচ্ছি।

গল্প করতে করতে ভাত হয়ে যাবে। তুমি আমাকে কাল রুমীর কথা কী যেন বলছিলে? কথা তো শেষ হয়নি!

– রুমির কথা? রুমির কথা আমি কী বলব? তোমারই তো ভাল জানার কথা!

– আরে আমার বোনের কথা বলছি না! জালালুদ্দিন রুমীর কথা বলছি!

– ওহ! পরে কথা হবে এ ব্যাপারে। তুমি একটু কষ্ট করে রান্নাটা সেরে ফেল। অনিক ধীর পায়ে শোবার ঘরে চলে গেল। সুমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এখন আর অভিনয় করতে হবে না। মন দিয়ে রান্না করবে এখন। ও ঘর থেকে কুরআন তিলওয়াত ভেসে আসছে। সুমির এবার সত্যিই খুব খারাপ লাগল। মানুষটা খিদের জ্বালা ভুলতে কুরআন নিয়ে বসেছে। আর ও পাষাণের মত অভিনয় করে গেল এতক্ষণ! ডিম ভাজির জন্য আগেই পেঁয়াজ মরিচ কেটে ফ্রিজে রাখা আছে। হাতের আস্ত পেঁয়াজ ছুরিও আজ সুমির অভিনয়ে যোগালি দিয়েছে।

রান্না শেষে অনিককে খেতে দেয়ার পর ও যেভাবে গোগ্রাসে গিলল তা দেখে পাষাণ হৃদয়ও গলে যাবে। আর সুমি তো মেকি পাষাণী! তার উপর অভিনয়ে নতুন! পেট ভরার সাথে সাথেই অনিক ফর্মে ফিরে এল।

সিংকে নিজের প্লেট মাজতে মাজতে সুমির এঁটো প্লেটও ধুয়ে দিতে চাইলো। বিষয়টা এমন না যে সুমি তার স্বামীকে নিজের এঁটো করা বাসন মাজতে বাধ্য করে। বিষয়টা হচ্ছে এটিকেট এন্ড ম্যানার্স। এ বিষয়ে অনিক রীতিমত পিএইচডি করেছে। প্লেট ধুয়ে অনিক খুব উৎসাহের সাথে সুমিকে জিজ্ঞেস করল রুমীর ব্যাপারে ও কী জানতে চায়। সুমি বরাবরই চুপচাপ। কিন্তু আজ ওর লেকচার দেয়ার পালা। এই কয়েক ঘন্টার ম্যাচে সুমি বিজয়ী হয়েছে। এখন উইনিং স্পীচ দিতে হবে।

“রুমীর কথা পরে হবে। আগে আমার কিছু কথা শোনো।” উচ্ছ্বাস চেপে রেখে সুমি বলতে শুরু করল। “আচ্ছা অনিক, বাসায় ফেরার পর অনেক ক্ষুধা নিয়ে তুমি কী কী করেছো মনে আছে?”

– মনে থাকবে না কেন? সালাত পড়েছি আর কুরআন তিলওয়াত করেছি। আসলে খিদে ভুলে থাকতে তিলওয়াতের বিকল্প নেই, বুঝলে? রোযা রেখেও আমি এই কাজটাই করি।

– বাহ! মা শা আল্লাহ তাবারাকাল্লাহ! কী কর নি তা মনে আছে?

– কী করি নি… উম্মম… অনেক কিছুই তো করি নি!

– আচ্ছা আমি মনে করিয়ে দেই। তুমি আমার সাথে তোমার মারেফতি আলোচনা কর নি। আমি করতে চাইলেও রিফিউজ করেছো। রাইট?

– হ্যাঁ… কিন্তু… অনিক ঠিক বুঝতে পারছে না কোথাকার পানি কোথায় গড়াচ্ছে। তার বউ যে এত গুছিয়ে কথা বলতে পারে সেটাই তো জানতো না!

– শোনো অনিক। আমি তোমাকে এই ব্যাপারটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। পেটে ঠিকমত দানাপানি পড়লে হরেক রকমের আজাইরা চিন্তা করা যায়। খিদের জ্বালায় তুমি সালাত পড়তে পারলে, কুরআন পড়তে পারলে কিন্তু মারেফতি প্যাঁচাল পাড়তে পারলে না। তুমি কি বুঝতে পেরেছো ব্যাপারটা? সুমির চোখ মুখ থেকে আত্মতৃপ্তির দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছে। আজ ওর বিজয়ের দিন। বাংলার ঘরে ঘরে আজ আনন্দ, যা কেবল সুমিই টের পাচ্ছে। আর কেউ না!

অনিক হতভম্ব। দুই মাস কাউকে চেনার জন্য যথেষ্ট না! এই মেয়ে তাকে পুরো ঘোল খাইয়ে ছেড়েছে! এ অবস্থায় এটিকেট এন্ড ম্যানার্সের দাবী কী হতে পারে তা রীতিমত গবেষণার ব্যাপার। অন্য কেউ হলে এ ঘটনা দুর্ঘটনায় গড়াতো। কিন্তু অনিক এটিকেট এন্ড ম্যানার্সে পিএইচডি হোল্ডার। তার উপর পেটে তার দানাপানি পড়েছে। এত সহজে হার মানার প্রশ্নই আসে না!

অনেক কষ্টে লম্বা দম নিয়ে বলতে শুরু করল… ” যাই বল সুমি! তোমার এই দানাপানির ব্যাপারটা আমি ঠিক মানতে পারলাম না। মাত্র একটা ইভেন্ট থেকে এত সহজে কনক্লুসান ড্র করা যায় না। একটু ব্যাখ্যা করি… তোমার মাইনরে স্ট্যাটিস্টিক্স ছিল না? তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে… তার আগে অবশ্য বোঝা দরকার পেটে দানাপানির সাথে চিন্তা ভাবনা আই মীন তুমি যেটাকে মারেফতি প্যাঁচাল বল সেটার আদৌ কোনো কোরিলেশন আছে কি না। থাকলে সেটা কতটুকু।

এখানে কি একটা ভ্যারিয়েবলই কাজ করছে? খিদে আর থট প্রসেসিং এর সম্পর্কটা কি লিনিয়ার? খাতা কলম থাকলে বোঝাতে সুবিধে হত…. থাক খাতা কলম পরে! ঐ আলোচনায় এখনই যাচ্ছি না। হালকা কিছু দিয়ে শুরু করি… রুমী কী বলেছিল জানো? রুমি বলেছে…..” ক্ষণিকের বিজয়িনীর উজ্জ্বল মুখটা দপ করে নিভে গেছে। মনের গহীন থেকে কে যেন চিৎকার করে বলছে- “আল্লাহ! তোমার কাছে বিচার দিলা আ আ আ ম!!!”

(সমাপ্ত)

————————————
মারবফতী স্বামী বশীকরণ
উম্ম মারঈয়াম