বোন, একটু ভেবে দেখবেন কি?

-উম্ম মারঈয়াম
১.
স্মার্টফোনে টুকটুক আওয়াজ।
মায়াবী মৌ ওয়ান্টস টু বি ইয়োর ফ্রেন্ড।

এই দিনটার জন্যই আশিক অপেক্ষা করছিলো। অধরা মায়াবী মৌ এমনভাবে ধরা পড়বে ভাবতেও পারেনি।
মায়াবী মৌ “ঠাডাময়ী” পেইজে নিয়মিত কমেন্ট করে। সেখান থেকেই আশিকের ভাল লাগা শুরু। ঠাডাময়ী লেখিকাদের প্ল্যাটফর্ম। কারণে অকারণে হাই ভোল্টেজের শক দিতে এরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এজন্য পেইজের নাম ঠাডাময়ী। এখানে সব লেখিকাই বলতে গেলে ফেমিনিস্ট। তাদের চরিত্র নিয়েও নানারকম কানাঘুষা আছে। এক বড়ভাই বলেছিলো ঠাডাময়ীর লেখিকা হইতে সাবধান। কেন সাবধান তা খুব একটা খুলে বলেননি। খুলে বললে নাকি গীবত হবে। তবে ইংগিত স্পষ্ট।

একবার কোনো এক ঠাডাময়ীর গল্পে আশিকের কমেন্ট ছিল, “এমনই একজন জীবনসঙ্গী খুঁজছি”।
তখন সেই বড় ভাই সাবধান করে দিয়েছিলেন। আর ফাজিল মেসমেট রুমন সেটার স্ক্রীনশট নিয়ে এখনও ক্ষ্যাপায়।

আশিক এরপর থেকে সাবধান হয়ে গেছে। ‘জান্নাতী ময়না পাখি’ নামে ফেইক আইডি খুলেছে কেবল ঠাডাময়ীর জন্য। না না, ঠাডাময়ী না। ফেইক আইডিটা খুলেছে আসলে মায়াবী মৌ এর জন্য। ঠাডাময়ীতে চমৎকার সব কমেন্ট করে মেয়েটা। ফেমিনিস্ট পোস্টগুলোর কড়া জবাব দিতে ভুল করে না।
আশিক তার আসল আইডি দিয়ে মায়াবী মৌকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল।

সঙ্গে মেসেজ-
” বোন, আপনার বন্ধুতালিকায় কি একটু জায়গা পেতে পারি? কেন ফলোয়ার অপশন চালু করছেন না বোন? আপনার লেখা পড়ে উপকৃত হতাম!”

মায়াবী মৌ ঝাঝালো জবাব দিয়েছে। যার সারমর্ম হলো, সে কোনো গায়রে মাহরামের সাথে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী নয়।

আশিক ঝাড়ি খেলেও খুশি হয়েছে। যাক, মায়াবী মৌ তাহলে গায়রে মাহরামদের সাথে কথা বলে না।
এরপর আশিক নিজেই খুলে ফেলল “জান্নাতী ময়না পাখি” আইডি।

সেই আইডি দিয়ে মায়াবী মৌ এর কমেন্টে ধুমসে রিপ্লাই চলে। ঠাডাময়ী যেন শুধু লেখিকাদের প্ল্যাটফর্ম না। মায়াবী মৌ এর কমেন্টের প্ল্যাটফর্ম, আশিকের পাত্রী খুঁজে বেড়ানোরও প্ল্যাটফর্ম।

অবশ্য শুধুমাত্র নিয়মিত রিপ্লাইয়ে মায়াবী মৌ এর মন গলেনি। আশিক বেশ খেটেখুটে নিজেও কিছু বড় বড় কমেন্ট করেছে ঠাডাময়ীতে। ওর কমেন্টের সাথে ঠাডাময়ীর পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই। কমেন্টগুলো স্প্যামের মত।

সবাই মোটামুটি জানে জান্নাতী ময়না পাখি নামের একটা আইডি প্রতি পোস্টের কমেন্টে মেয়েদের জন্য নসীহামূলক কিছু লিখে, শেষ লাইনে ভেবে দেখার আহ্বান-

“বোন, একটু ভেবে দেখবেন কি?”

সেসব কমেন্টে মায়াবী মৌ এর লাইক পড়লে আশিকের দিনটাই অন্যরকম হয়ে যায়!

২.
“সালাম আপু। আমি আপনার ফ্যান।”
মায়াবী মৌ মেসেঞ্জারে নক করেছে! এবার আশিকের হার্টবীট মিস হবার যোগাড়।

সেই যে শুরু হল এরপর আর থামাথামির নাম নেই। মায়াবী মৌ আর জান্নাতী ময়না পাখি দু’জন বোন হয়ে গেল। আশিক সদা সতর্ক। কিছুতেই বোঝানো যাবে না সে বোন না, সে আপাদমস্তক এক ভাই।

ইতোমধ্যে মৌ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে ফেলেছে আশিক। মৌ মা বাবার একমাত্র আদুরে মেয়ে। সিলেটে থাকে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি পড়ছে। ফার্স্ট সেমিস্টার শেষ হয়েছে কেবল।

আর আশিকের পরিচয়- সে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্ডারে সাইকোলজি পড়ছে। তার মা বাবা দুজনেই চাকরিজীবি। বাসায় বলতে গেলে একাই থাকে। সকালের নাস্তা সে নিজেই বানিয়ে খায়। লাঞ্চ বাইরে। আর সন্ধ্যায় বুয়া খালা এসে রাতের রান্না করে যায়। এক সপ্তাহ হল বুয়া খালা দেশে গেছে। আশিক থুড়ি ময়না পাখি ভীষণ বিপদে। রাতের রান্নাটা এখন তাকেই করতে হচ্ছে।

বুয়াদের নবাবি আচরণ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা চলেছে ওদের মাঝে। এরকম টপিক পেয়ে গেলে আশিক খুশি হয়। চুড়ি ফিতা নেইল পালিশের গল্প শুরু হলেই ও ধরা খাবে। মনের খায়েশ মিটিয়ে বুয়ার বিষোদগার শেষে দু’জনেরই মনে পড়েছে গীবত হয়ে যাচ্ছে। তাই ওরা আর কথা বাড়ায়নি।

আশিক আসলে মেসমেট রুমনকে বুয়ার জায়গায় বসিয়েছে। রুমন বাড়ি গেছে এক সপ্তাহ হল। রান্নায় অনভ্যস্ত আশিক সত্যিই বেশ বিপাকে পড়ে গেছে। নানাবিধ জটিলতায় ওরা কোনো বুয়া রাখে না। নিজেদের রান্না নিজেরাই করে। রুমনের রান্নার প্রতি বেশ ঝোঁক। বিনা চুক্তিতে ও আশিকের জন্যও রান্না করে। ও অবশ্য একেবারে মাগনা খায় না। মাঝে মাঝেই রুমনকে বাইরে ট্রিট দেয়।

মৌ এর সাথে যোগাযোগ হওয়াতে একটা সুবিধে হয়েছে। আশিক ওর লিখে দেয়া ইন্সট্রাকশন ফলো করে দুই তিন রাত নিজেই রেঁধে ফেলেছে।
যাক মৌ মেয়েটা রান্নাও জানে। বিয়ে হলে না খেয়ে থাকতে হবে না।

এই যা! কল্পনা ডালপালা মেলে বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে!

৩.
নীলরঙা হিজাব পরিহিতা ফর্সা মতন এক মেয়ে। চোখে চিকন করে কাজল দেয়া। মেইকআপ বিহীন ন্যাচারাল মুখশ্রী। এক দেখাতেই ভাল লাগতে বাধ্য।

ছবিটা মায়াবী মৌয়ের। আশিক চায়নি, মৌ নিজে থেকেই দিয়েছে। অনেকটা মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত অবস্থা! প্রথমে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, এরপর মেসেজ আর এখন ছবি!

ছবিটা দিয়েই মৌয়ের আবদার, তোমার একটা ছবি দাও না বোন! খুব মন চায় বোনটাকে একটু দেখি।
আশিক অত কাঁচা কাজ করে না। স্প্যাম সিরিজ “বোন, একটু ভেবে দেখবেন কি?” লিখতে লিখতে ও মেয়েদের ব্যাপারে অনেক কিছু জানে। সেদিনই লিখেছিল পর্দানশীন মেয়েরা যাতে মোবাইলে ছবি না তোলে।

মৌকে সেসবই বুঝিয়ে বলল। পর্দাজনিত কারণে আশিক ওরফে জান্নাতী ময়না পাখি কোনো ছবি তোলে না। ইনবক্সে ছবি চালাচালি তো দূরের ব্যাপার!
সেই সাথে মৌকেও সাবধান করে দিল যেন ও কাউকে ইনবক্সে ছবি না দেয়। মনে মনে অবশ্য বলল, গাধীর গাধী আমাকে দিয়েছিস ভাল কথা! আর কাউকে দিলে তোর খবর আছে!

মৌয়ের ঐ ছবিটা ভয়ানক ফিতনা হয়ে দাড়িয়েছে আশিকের জন্য। বারবার দেখছে, আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। পরক্ষণেই ভাবছে ও তো বিয়ের নিয়তে ছবি দেখছে। সমস্যা কই? এই মেয়ে ছবি দিতে পারলে ও দেখতেই পারে! ওকে কে বলেছে ছবি দিতে?

৪.
সকালের নাস্তা সারতে সারতে মৌয়ের সাথে চ্যাট করা আশিকের প্রতিদিনকার রুটিন। ঠাডাময়ীতে এখন আর তেমন একটা কমেন্ট করা হয় না কারো। চ্যাট করতে করতেই সময় চলে যায় দু’জনের।

আশিকের কাজের বুয়া রুমন এখনও মেসে ফেরেনি। না ফিরে ভালোই করেছে। আসলেই ওর উপর গোয়েন্দাগিরি শুরু করবে। কার সাথে এত চ্যাট করিস? তুই তো কারো সাথে এত কথা বলিস না?
এরকম নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলবে একদম।

ও ফেরার আগেই মৌয়ের সাথে যতটা সম্ভব কথা বলে নেয়া দরকার। চেহারা ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কথাবার্তা আচার আচরণও ভাল। কিন্তু বিয়ে হবে কীভাবে?

রুমনের সাথে কি একবার পরামর্শ করবে? যতই পঁচাক, বন্ধু তো! ও যদি সমাধান দিতে পারে! নাকি নজর দিবে? নজর লাগলে তো সব শেষ! রুমনকে বলা যাবে না। ডিসিশন ফাইনাল।

নাস্তা সারা হয়ে গেছে। অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে আশিক। এর ফাঁকে ফাঁকে মৌয়ের সাথে গল্প চলছে ল্যাপটপে। স্মার্টফোনে আরাম করে ঐ ছবিটা দেখা যায় না। তাই আজকাল ল্যাপটপেই চ্যাট করা হয়।
গল্প অবশ্য আর করা হল না। কোনোরকম আভাস না দিয়েই প্রকৃতির তীব্র ডাক। ওদিকে অনবরত কলিংবেল বাজছে। রুমন গাট্টিবোঁচকা নিয়ে হাজির। দিশেহারা আশিক কোনোমতে ওকে দরজা খুলে দিয়েই ওয়াশরুম পানে ধেয়ে গেল।

অনুসন্ধিৎসু রুমন নিশ্চিত ওর আর মৌয়ের চ্যাট পড়তে শুরু করেছে। এখন আর কিছু করার নেই। দশটা মিনিট কাটলো দশ ঘন্টার মত।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই রুমনের মুখোমুখি আশিক। ও ল্যাপটপে চ্যাট ঘাটছে না। থমথমে মুখে বসে আছে।
“আমি তোর কাজের বুয়া? আমার হাতটানের স্বভাব? গ্রামে যাবার আগে তোর টাকা চুরি করে ভেগেছি?”
আশিক হতভম্ব। এই দশ মিনিটে এতদিন আগের চ্যাট রুমন কী করে পড়ে ফেলল? ল্যাপটপটাও তো পড়ে আছে বিছানায়! কীভাবে সম্ভব?

রঙ বেরঙের কিছু গালি দিয়ে ফের ঝাড়তে শুরু করল রুমন।

তুমি মিয়া ছবি তুলো না, খুব পর্দা করো তাই না?

দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে দেরি হলো না আশিকের। এত দ্রুত মায়াবী মৌয়ের সাথে দশ বারোদিনের চ্যাট পড়ে ফেলা সম্ভব না।

তারমানে রুমনই ওর মায়াবী মৌ!
এবার আর কেউ কাউকে ছাড়লো না। ধাওয়া পালটা ধাওয়া চলল বেশ কিছুক্ষণ। গালির স্টক ফুরিয়ে যাচ্ছে।

আজ দু’জনেই প্রতারিত, দু’জনেই প্রতারক! এ ঝগড়া থামবার নয়! ঝগড়া হয়ত আরো চলত, কিন্তু আশিকের অফিসে যেতে হবে। হুশটা তাই ওরই আগে ফিরলো। মুহূর্তেই ভোল পালটে গলার স্বরটা যথাসম্ভব কোমল করে বলল,

” একই ছাদের নিচেই তো থাকতে হবে আমাদের। কী লাভ এত হানাহানি করে! বোন, একটু ভেবে দেখবেন কি?”

বোন আশিকের এই আকস্মিক আহ্বানে রুমনেরও বোধোদয় হলো। আসলেই তো! হানাহানি করে লাভ কী? কোনো লাভ নেই!

……………………....…….

#রৌদ্রময়ী_রম্য