জন্মের পর থেকেই ঢাকায় থাকে দিপা আর রাশেদের পরিবার। ঢাকায় থেকেও কাজের চাপে, সময়ের অভাবে আর রাস্তায় জ্যামে, সময়ের অপচয়ে ইচ্ছা থাকলেও আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়না বললেই চলে। বিয়ের এত বছর পরেও রাশেদ, দিপার আত্মীয়দের অনেককেই চেনেনা।
ওদের দুই ছেলেমেয়ে, ছেলেটা ১১ এ পা দিল, আর মেয়েটা ৯ এ। দিপার মামার একমাত্র মেয়ের বিয়ে; রাশেদ সহ বাসার সবার দাওয়াত। দিপার মামা নিজে এসে রাশেদকে ওর বাবা মা সহ সবাইকে দাওয়াত দিয়ে গেছেন। দিপাও খুব করে ধরে, যেতেই হবে। কতদিন সবার সাথে দেখা হয়না। একসাথে সবার সাথে দেখা হবার এটা খুব ভালো সুযোগ। রাশেদ ও রাজি হয়ে যায়।
বেশ অনেক বছর আগের কথা। বিয়ের ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ওদের কোন বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছিলনা। পরপর ২ টা মিসক্যারেজ। ডাক্তার ও তেমন কোন সমস্যা খুজে পায়না। একেকজন একেক কথা বলে, কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হয়না। ওরা মানসিক ভাবে ভেঙে পরে। দিপার এক বান্ধবী, তমা ওকে পরামর্শ দেয়, দুজনা ওমরাহ করে আয়। আল্লাহর ঘরে গিয়ে নিজের চাওয়া গুলো বলে আসার পরামর্শ ওর মনে ধরে।
রাশেদকে একথা জানালে, রাশেদ ও রাজি হয়, তবে রাশেদের মা বলেন, একেবারে হজ্জ করে ফেলতে। হজ্জে করে আসা দুয়া আল্লাহ ফেলেন না। দ্রুতই সব ঠিকঠাক হয়, ওরা হজ্জে যাবার জন্য সব গোছগাছ করে ফেলে। দিপার মনে অনেক শংকা, কিভাবে কি করবে? সেতো মাথাতেই ঠিকমত কাপড় দেয়না, নামাজটাই শুরু করেছিল বিয়ের পরে। মনে দ্বিধাদ্বন্দ, কিন্তু তমা এবারো বলে, মন থেকে শুরু করলে, পূর্বের সব পাপের জন্য ক্ষমা চাইলে আল্লাহ মাফ করে দিবেন। হাজীদের আল্লাহ এমনভাবে নিষ্পাপ করে দেন, যেন সদ্য জন্মানো কোন শিশু, আর কবুল হজ্জের প্রতিদান শুধুই জান্নাত।
দিপা সেদিন থেকেই মাথায় হিজাব পড়তে শুরু করে, যদিও তার বেশ আনিজি লাগছিল। তমার সাথে গিয়ে কয়েকটা বোরখা ও কিনে ফেলে, অন্তত হজ্জের কয়েকদিন পরবে। ও প্রথম বোরখা গায়ে দেয়, হজ্জের ইহরাম হিসেবে। কে জানতো সারাজীবন সে ভালোবেসে গ্রহণ করে নেবে আল্লাহর এই হুকুমকে।
এই মেয়েই যখন হজ্জ থেকে ফিরে আসে, ওকে দেখে কেউ চিনতে পারেনা, নিকাব পড়া পুরা হুজুরনি। সেই ছিল শুরু, এরপর থেকে আর কখনো সে কোন গায়ের মাহরামের সামনে আসেনি, এমনকি নিজের কাজিনদের সামনেও না, যাদের সাথে একই বাড়িতে বড় হয়েছে ও। একারনে সবাই ওকে খোঁচা মারতো, উচ্চাশিক্ষিত, স্মার্ট একটা মেয়ে হঠাৎ করে এমন মধ্যযুগীয় পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, ওদের মেনে নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু দিপা পিছপা হয়নি আর কোন কিছুতেই, যেকারনে ওর সাথে সবার যোগাযোগ, সম্পর্ক অনেক কমে আসে। অনেকেই হয়তো চিনতেও পারবেনা ওকে, শত হলেও ওরই আপন লোক সবাই, এবার তাই সবার সাথে দেখা করার লোভ সামলাতে পারেনা ও।
সময়মত বিয়েতে পৌঁছে যায় সবাই। দিপা সবাইকে দেখে খুব খুশি হয়, বাচ্চাদুটোকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। কিন্তু দিপা মনেমনে ঢোঁক গেলে ওর আত্মীয়াদের পোশাকের বেহাল অবস্থা দেখে। ছেলে বড় হচ্ছে, ও কখনো এমন পোশাক ঘরেও পড়েনা, যা এতলোকের সামনে ইনারা পড়ে আছেন।
রাশেদের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করতে থাকে, কিন্তু রাতুল? সদ্য ১০ পার হওয়া রাতুল, ওর চোখ দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে দিপা। জানিনা ছেলেটা মনে মনে কি ভাবছে! যত দ্রুত হয় এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। কিন্তু প্রথমবার ওরা খেতে বসতে পারেনা। টেবিল সব ভরে গেছে, ওদের অপেক্ষা করতে হয়। মামা মেয়ের বিয়েতে কোন কিছুরই কমতি রাখেননি।
আল্লাহ তাকে দিয়েছেন যেমন হাত ভরে, খরচ করতেও পারেন হাতভরে। চারপাশে চোখ ধাঁধানো ডেকোরেশন। আর পেশাদার ফটোগ্রাফাররা ফটো তুলেই যাচ্ছেন। দিপার নিজেকে এর মাঝে বড় বেমানান মনেহয়। অথচ ওর নিজের বিয়েতেও কম করা হয়নি এসব। কিন্তু সময় পাল্টে গেছে, এসব জাঁকজমক একদমই ভালো লাগেনা ওর, দম বন্ধ বন্ধ লাগে। সবাই হাসিমুখে, একে অন্যকে জড়িয়ে ছবি তুলছে। ছোট মামি বড় মামির গলা জড়িয়ে যেভাবে দড়িয়েছে, কে বলবে দুই জা য়ে দা কুড়াল সম্পর্ক! দিপার ভালোই লাগে, এক একটা সম্পর্ক যেমনি হোক, কারো বিপদে, কারো দুঃখে বা আনন্দের সময় কাছের মানুষগুলো পাশে থাকাটা মনের জোড় বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।
দিপাকে সবাই ডাকছে ফটোসেশনে অংশ নিতে। আসছি, বলে পালিয়ে আসে! মন টা ভালো লাগেনা। মামি ডেকে বললেন, বোনের বিয়েতে এমন আলখাল্লা কেন পড়ে এসেছে? আর পড়াই যদি লাগে, আরেকটু সুন্দর করে, পরিপাটি, স্মার্ট হয়ে কেন আসেনি? সামনে দিয়ে এক মডার্ন হিজাবিকে দেখিয়ে দিতে ভুললেন না, হিজাব পড়েও স্মার্ট থাকা যায়।
বরপক্ষের একজন, ওকে দেখিয়ে জানতে চাইলে, মামি জবাব দিলেন, আমার ভাগ্নি, ও কিন্তু পি এইচ ডি করা, হজ্জ করে এসেছে তো, তাই এমন পোশাক! এই মামিই একসময় তার বাচ্চাদের বলতেন, দিপার মত হতে, ওর মত ভালো রেজাল্ট, ওর মত স্মার্ট। আর এখন, এই মামিই ওর পরিচয় দিতে লজ্জা পান। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে দিপার ভিতর থেকে।
এর মাঝে গুঞ্জন শোনা যায়, সাথে দেখা যায়, স্টেজের পাশে বিশাল সাইজের লাউডস্পিকারগুলো। এখানে নাকি ডান্সশো হবে একটু পরেই। মাথামুণ্ডু কিছু বোঝেনা প্রথমে। একদল ছেলে, হিন্দি গানের সাথে নাচতে শুরু করে। এরপর একদল মেয়ে। এরপর কনে,,,এরপর বরকনে একসাথে। ঠিক যেমন হিন্দি সিনেমায় নায়ক নায়িকারা বিয়ের সময় নাচে। মামিরাও যোগ দেন নাচে।
শব্দে ওর বাচ্চা গুলো কানে হাত দিয়ে বসে থাকে ঠিকই, কিন্তু চোখ ফেরাতে পারেনা। দিপা ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ির দিকে তাকায়, বোঝাই যাচ্ছে চোখেমুখে তীব্র বিরক্তির রেখা, না হয়েই বা উপায় কি! এসব হবে জানলে কে আসতো শেধে? বাচ্চা দুইটা হাঁ করে সব গিলছে। ওর মেয়েটাকে এই বয়সেই হিজাব ধরিয়ে দিয়েছে, সেই মেয়েটা এমন পোশাকে বয়স্ক লোকেদের এই নাচ দেখে কি শিখবে?
আর ছেলেটা! ইশ; ওদের যদি সাথে না আনতাম, মনে মনে ভাবে দিপা। এর মধ্যে খাবার দেয়া হল। শাশুড়ির পাশে বসেছে দিপা, বৌমা তোমার বোনেরা এত দারুন নাচে জানতাম না তো! শাশুড়ি ও খোঁচা মারার সুযোগ ছাড়লেন না। না মানে, মামিদের বাড়ি যে এলাকায়, ওখানে বিয়েতে এমন একটু আধটু হয়।
আর কথা বাড়ায় না, জলদি খেয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। সেই গগনবিদারী আওয়াজে গান, আর নাচ চলছে তখনো। এত বছরের জীবনে কম বিয়ে তে যায়নি দিপা। আগের সবকিছু যেমন, হলুদের অনুষ্ঠানে কনের গায়ে সারা পাড়ার লোকের হাতের ছোঁয়া, বিয়েতে কনের ময়দা মাখা সাজ, গেট ধরার বাহানায় ছেলেমেয়েদের মাখামাখি, মহিলাদের অসুস্থ সাজপোশাক, ওয়েডিং ফটোগ্রাফি এসব তো অনেকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল দেখতে দেখতে।
তবে আজকের মত, হিন্দি সিনেমা স্টাইলে নাচ আগে দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি ওর। হিন্দি সিরিয়াল, সিনেমা আমাদের মন, মগজ এমন ধোলাই করেছে, এসব নির্লজ্জতা আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে। যে মেয়েটা সারাবছর নিকাব পড়ে রাস্তায় চলাফেরা করে, সেই একই মেয়ে বিয়ের দিন মাথায় ঘোমটাহীন থাকে।
যে বাবা,মেয়েকে পাড়ার ছেলেদের চোখ থেকে বাঁচাতে, বাড়ির ছাদে, বারান্দায় যাবার অনুমিত দেন না, সেই বাবা মেয়েকে হলুদের রাতে পাড়াশুদ্ধ লোককে মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে হলুদ মাখার অনুমতি দেন। যে ভাই, তার বোনকে অন্য ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, সেই ভাই ই তার বোনকে ফটোগ্রাফারদের ইচ্ছামত কাঠের পুতুল বানিয়ে, হাতের ইশারায়, সমস্ত এঙ্গেলে ছবি তোলার সময় নীরব থাকেন।
আমরা কি দিনে দিনে নির্লজ্জ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। নাকি বিয়ের নামে সব হারামকে স্বেচ্ছায় হালাল বানিয়ে নিচ্ছি। যে বাবা, ভাইদের দায়িত্ব তার মেয়েকে, বোনকে এসব হারাম থেকে বাঁচানো, তারাই এসবের অনুমতি দিয়ে মেয়েদের হারামের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। আর নিজেরা দাইউসে পরিণত হচ্ছেন। দাইউওসের অবস্থান জাহান্নামে। আর আমাদের সমাজে দিনদিন এই জাতীয় লোকের সংখ্যা বাড়ছে, আর বাড়ছে।
আশেপাশে তাকালেই দেখবেন, বাবা মেয়ের সাথে হেঁটে যাচ্ছে, বোনের সাথে ভাই, স্বামীর সাথে স্ত্রী। কিন্তু তাদের পোশাকে পর্দার লেশমাত্র নাই। এই পুরুষদের আখিরাতে নিজেদের অধিনস্ত মহিলাদের পর্দার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এসব ভাবতে ভাবতে বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে দিপা।
ভাবতে খারাপ লাগে, একসময় নিজের কাছেও এসব খুব খারাপ কিছু মনে হতনা, কারণ আমাদের মগজে নির্লজ্জতার বীজ বপন করে দেয়া হয়েছে সুনিপুণ ভাবে। হয়ত খুব দ্রুত এই অশ্লীল নাচের সাথেও আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাব, অন্য সবকিছুর মত এই নাচ ও আমাদের কাছে বিয়ের হালাল এবং অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে গণ্য হবে।
বাড়ি ফেরার জন্য বের হতেই, ওর বাচ্চাদের প্রশ্ন, মা, ওরা এভাবে নাচছিল কেন? দিপা কিছু না শোনার ভান করে ওদের প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে যায়, কিন্তু ওদের মাথায় যে বিষের বীজ বপন করে নিয়ে এল, তার কি হবে?
বিয়েবাড়ি, নাকি বাড়াবাড়ি
– ফাহমিদা হুসনে জাহান
(৩১/০১/২০১৯)