সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন আমি অমুসলিম পরিবারে বড় হওয়া অমুসলিম এক বালিকা ছিলাম। এক খালাতো বড় বোনের কোমর সমান দিঘল কালো ঘন চুলের প্রশংসা করতেই সাথে সাথে চুলে থুতু দিয়ে খোঁপা করে বেঁধে ফেলল। বলল, এর আগে কেউ একজন তার চুলের প্রশংসা করাতে নজর লেগে নাকি অনেক চুল পড়া শুরু হয়েছিল। একথা শুনে হেসে ফেলেছিলাম আমি। কত কুসংস্কার যে বিশ্বাস করে মানুষ, চুলের প্রশংসা করলে নাকি চুল পড়ে যায়!
এদেশের খ্রিস্টান অথবা হিন্দুদের মাঝেও দেখেছি ছোট বাচ্চাদের কপালের এক কোনে কালো টিপ এঁকে দেয়া হয় নজর যেন না লাগে। কেউ নজর থেকে বাঁচতে থুতু ছিটায়, কেউ আবার এক চোখওয়ালা বিশেষ লকেট গলায় কিংবা হাতে ঝোলায়। এটা শুধু যে খ্রিস্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা না, দেশে-বিদেশে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব জায়গায় নজর লাগাকে বিশ্বাস করা হয়।
পরবর্তীতে জানলাম ইসলামেও নজর থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ কিছু ‘আমল করা হয়। শুধু তাই না, এই বিষয়ে সহীহ হাদিস পাওয়া যায় যেখানে নজরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নির্দেশিত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করা হয়। এরপর তো আর অবিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না!
আমার বড় ছেলেটা ছোটবেলায় একদম ধবধবে সাদা নাদুসনুদুস বাচ্চা ছিল। টকটকে লাল জামা পরিয়ে বাইরে বের হলে অপরিচিত লোকজনও ঘুরে ঘুরে তাকাত ওর দিকে। আশেপাশের কেউ গাল টিপে আদর না করে যেত না। আমার মনে আছে, ওকে নিয়ে কোথাও বের হলেই সেই রাতে সারারাত ঘুমাতে পারতো না, কাউকে ঘুমাতে দিতও না। ছটফট করতো আর একটানা কাঁদতো। পরে বেশ কিছু মায়ের কাছ থেকে শুনেছি তাদের বাচ্চাদের সাথেও একই ঘটনা ঘটে।।
ইসলামে আসার শুরুর দিকে এক বোনের সাথে পরিচয় হয়েছিল। বিয়ের পর তার হাসবেন্ডের সাথে নানান ভঙ্গিমায় ছবি দিত ফেইসবুকে, সাথে রোমান্টিক সব ক্যাপশন। কিছুদিন পরেই শুনি দু’জনের নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে।
আরেক বোনেরও হাজবেন্ড নিয়ে ভালোবাসাবাসির লেখাগুলো পড়ে অনেকেই তাকে সাবধান করেছিল, পরে শুনেছি ব্যক্তিগত জীবনে তারা মোটেও সুখি নয়।
মিডিয়ার তারকাদের মাঝে ঘন ঘন ডিভোর্স আর ব্যক্তিগত অশান্তিময় জীবনের পেছনে মূল কারণ হতে পারে এই নজর লাগা।
ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও দেখেছিলাম যেখানে এক বছরের ছোট্ট একটা কিউট মেয়েকে তার বাবা নানানভাবে ড্যাড ডাকা শেখাচ্ছে, অথচ বাচ্চাটা বার বার মাম্মা মাম্মা বলছে। আপনারা অনেকেই দেখেছেন হয়তো। ভিডিওটা ভাইরাল হওয়ার পর মেয়েটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সাধারণ সর্দিকাশির চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধরা পড়ে সে রেসপিরেটরি ভাইরাসে আক্রান্ত। অল্প দিনের মাঝেই সে মারা যায়।
রুকিয়া সম্পর্কিত কোন একটা বইতে পড়েছিলাম এক ব্যক্তির নতুন বাসার প্রশংসা করাতে হঠাৎ ছোট ছোট পোকা দিয়ে ভরে যাচ্ছিল পুরো বাড়ি। পরে রুকিয়া করে পানি ছিটানোর পর তা ঠিক হয়েছিল।
আপনি বিজ্ঞানমনস্ক হলে এতক্ষণে মনে হতে পারে এগুলো নজর লাগার কারণে না হয়ে স্বাভাবিকভাবে অন্য কারণেও তো হতে পারে। আমি বলব অন্য কারণগুলোর উৎপত্তি ঘটেছে বরং এই নজর লাগা থেকেই। আমি এটা বলছি না যে জীবনের যে কোন অসুস্থতা, যে কোন দুর্ঘটনার নেপথ্যে বদনজর জড়িত। কিন্তু প্রকাশ্যে সুন্দর কিছুর প্রদর্শন, অতিরিক্ত প্রশংসা, বারাকাতের দুয়া না করা, লোক দেখানো কাজ ইত্যাদির কারণে নজর লাগাটা খুব বেশি স্বাভাবিক।
একজন মুসলিম হিসেবে আমি সব রকম কুসংস্কারমুক্ত। প্রেগ্ন্যান্সিতে কখনোই চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণ মেনে চলিনি। বাচ্চাদের কপালে কালো টিপ দেয়াটাও শরিয়ত সম্মত নয় বলে দিইনি কখনো। অথচ নজর লাগার ব্যাপারটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এবং তা থেকে আমার রবের কাছে প্রতিনিয়ত আশ্রয় চাই।
আসুন জেনে নিই এই ব্যাপারে ইসলাম কী বলে।
আরবী শব্দ আল-’আইন এর উর্দু হলো নজর। ইংরেজীতে একে ইভল আই (evil eye) আর বাংলায় বলে বদনজর বা নজর লাগা অথবা চোখ লাগা। সাধারণভাবে বদনজর হলো কোন ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি ভালোলাগার কারণে বার বার তার দিকে হিংসাপূর্ণ দৃষ্টিপাত করা, এবং এই দৃষ্টিপাতের ফলে সেই ব্যক্তি বা বস্তুর কোন ক্ষতি সাধন করা। সুরাহ ফালাক্বের শেষ আয়াতে আমরা এই হিংসাত্মক নজর থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। বদনজর হলো সেই তীরের মতো, যা হিংসুকের অন্তর থেকে নিক্ষেপ করা হয় যাকে হিংসা করা হয় তার উপর। বদনজরের এই তীর কখনো লক্ষ্যভেদ করে, কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়। [১]
আ’ইশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম বদনজর থেকে বাঁচার জন্য রুকিয়া করতে বলতেন। [২]
রসুলুল্লাহ সা. বলেন, “বদনজর সত্য, তাকদীরকে ছাড়িয়ে যায় এমন কিছু থাকলে তা হলো বদনজর!” [৩]
তিনি (সা.) আরো বলেন, “বদনজর মানুষকে কবর পর্যন্ত আর উটকে রান্নার পাতিল পর্যন্ত পৌছে দেয়!” [৪]
বিশুদ্ধ সনদে আরেকটি হাদীস বর্ণিত আছে যেখানে রাসুল সা. বলেন, “তোমরা বদনজর থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও, কেননা বদনজর সত্য!” [৫]
বদনজর যে শুধু হিংসুকদের হিংসাপূর্ণ দৃষ্টি থেকে হয় তা নয়, কারো কোন কিছু ভালো লাগলে প্রশংসাপূর্ণ দৃষ্টি থেকেও নজর লাগতে পারে। একজন মায়ের নজর তার সন্তানের উপর, এমন কি কারো নিজের উপর নিজের নজরও লাগতে পারে।
বদনজর থেকে বাঁচতে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম আমাদের কিছু ‘আমল শিখিয়ে দিয়েছেন। থুতু ছিটিয়ে, তাবিজ ঝুলিয়ে অথবা কালো টিপ দিয়ে নয় — মুসলিম হিসেবে আমরা শুধু শরিয়াসম্মত প্রস্তাবিত পন্থাগুলোই মেনে চলব।
কাজেই আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন বদনজর থেকে রক্ষা পেতে আমাদের করণিয় কী।
১. রাসুল সা. বলেন, “নিজের প্রয়োজন পূরণ হওয়া পর্যন্ত তা গোপন রাখার মাধ্যমে সাহায্য লাভ করো। কেননা, প্রতিটি নিয়ামত লাভকারীর সাথেই হিংসুক থাকে!” [৬]
সোশাল মিডিয়ায়, বন্ধুদের আড্ডায় অথবা মহিলাদের গল্পের আসরে — আল্লাহর দেয়া নিয়ামতের বর্ণনা না করলেই নয়। আমি নিজেও অনেক সময় এই কাজটা করে ফেলি। কখনো আমরা সন্তানদের প্রশংসা, কখনো ব্যবসায় লাভের কথা, কখনো স্বামী/স্ত্রীর ভালো দিকগুলো ফলাও করে অন্যের কাছে বলতে থাকি। ফলে নজর লাগার দ্বারটা নিজেরাই উন্মুক্ত করে রাখি। মুফতি ইসমাইল মেংকের একটা লেকচারে শুনেছিলাম, সোশাল মিডিয়াতে বাচ্চাদের ছবি দেয়া মানে হলো “আসো আমার সন্তানকে তোমার নজর লাগিয়ে যাও” বলা।
কাজেই নজর লাগা থেকে বাঁচতে এই ব্যাপারে সাবধান থাকা জরুরি।
২. “তোমাদের মাঝে কেউ যখন নিজের অথবা অধীনস্থদের অথবা ভাইদের কোন কিছু পছন্দ করে, সে যেন বারাকাহর দুয়া করে নেয়। কারণ বদনজর সত্য।” [৭]
বারাকাহর দুয়া মানে “আল্লাহুম্মাহ বারিক লাহু” অথবা “বারাকাল্লাহু ফিক” বলা, মাশাআল্লাহ নয়। আমরা ভালো কিছু দেখলে সেই জিনিসের বারাকাহ এর দুয়া করব। কারো কাছে দশ হাজার টাকা দেখলে আমরা তার জন্য বিশ হাজারের দুয়া করব। সুন্দর মুখের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়ার দুয়া করব। সুন্দর সম্পর্কগুলো আরো মজবুত করে দিতে আল্লাহর কাছে চাইব। এতে আমাদের নজর অন্যের উপর পড়ার সম্ভাবনা অনেক অনেক কমে যাবে ইনশাআল্লাহ্।
৩. সকাল সন্ধ্যা আল-মু’আউওয়াযাতাইন (ফালাক্ব-নাস), সুরাহ ইখলাস, আয়াতুল কুরসি, সুরাহ ফাতিহা পড়তে হবে।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম বদনজর থেকে বাঁচার জন্য কিছু দুয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। হিসনুল মুসলিম অথবা এধরনের কোন অথেনটিক দুয়ার বই থেকে আমরা দুয়াগুলো জেনে নিব এবং সে অনুযায়ী ‘আমল করব ইনশাআল্লাহ্।
বদনজর থেকে রক্ষার জন্য রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিহি ওয়াসসাল্লামের সেখানো একটি প্রসিদ্ধ দুয়া হলো –
“আ’উযুবি কালিমাতিল্লাহি তাম্মাহ মিন কুল্লি শাইত্বনিন ওয়া হাম্মাহ ওয়া মিন কুল্লি ‘আইনিন লাম্মাহ।” [৮]
৪. সাহল ইবনে হুনাইফ রা. কোথাও গোসলের জন্য জামা খুলেছিলেন। আমের ইবনে রবী’আ রা. তাকে দেখে বললেন, এত সুন্দর মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। এত সুন্দর এমনকি কোন যুবতীর শরীরও দেখিনি। সাহল ঐখানেই পড়ে গেলেন, তার জ্বর চলে আসলো আর মারাত্মক জ্বরে তিনি ছটফট করতে লাগলেন।
তাকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নিয়ে গেলে তিনি ঘটনাটি শুনলেন। তিনি আমের ইবনে রবী’আকে ডাকলেন এবং বললেন, “তোমরা কেন তোমাদের ভাইকে নজর দিয়ে হত্যা করছো?”
অতঃপর তাকে বললেন, অযু কর। আমের (রা.) অযু করলেন। অতঃপর সেই অযুর পানি দিয়ে সাহল এর পিঠ ধুয়ে দিলে কিছুক্ষণ পরে তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন। [৯]
কার নজর লেগেছে জানা থাকলে তার ওযুর পানি আক্রান্ত ব্যক্তির পেছন থেকে একবারে ঢেলে দিতে হয়।
নজর লাগা আর যাদুটোনা বা সিহর কিন্তু এক না। জীবনের যে কোন ঘটনা, দুর্ঘটনা, অসুস্থতার কারণকে নজর লাগা বলে চালিয়ে দেয়া যেমন ঠিক নয় — এসবের কারণ হিসেবে বদনজরকে উপেক্ষা করাও ঠিক নয়।
কারণ…
“বদনজর সত্য”।
……………………………………………
[১] যাদ উল মা’আদ
[২] আল-সাহিহাইন
[৩] মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযি
[৪] আবু নুয়া’ইম, ইবনে ‘আদি এবং অন্যান্য। আল্-আলবানীর মতে হাসান
[৫] ইবনে মাজাহ
[৬] তাবারানী বাইহাকী
[৭] ইবনে আল-সুন্নি, ‘আমল আল-ইয়াওম ওয়াল-লাইলাহ, পৃ: ১৬৮; আল-হাকিম, ৪/২১৬; আলবানীর মতে সহীহ
[৮] বুখারি
[৯] আল-মুসনাদ ৩/৪৮৬
……………………………………………
বদনজর সত্য
সিহিন্তা শারীফা
২ অক্টোবর ২০১৮