খুব বেশি দিন হয় নি একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। ট্রেন্ডটা হচ্ছে মানুষজন খুব অবলীলায় তাদের ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক সমস্যা ফেসবুকে একদম পাবলিকলি বলে দিচ্ছে। আমি যদি নিজের কথাই বলি, আমিও এর থেকে মুক্ত না। নিজেকে একদম অন্য লেভেলে নিয়ে গিয়ে এই সমস্যা সম্পর্কে কিছু বলার ইচ্ছে আমার নেই। আমি নিজেকে এই ট্রেন্ডের ভেতরের একজন মানুষ হিসেবে ধরে নিয়ে এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই।
প্রথমে আগে বুঝতে হবে যারা নিজের কষ্টের কথা ফেসবুকে একজন কিংবা দুইজনকে না, স্থান কাল পাত্রের তোয়াক্কা না করে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে তারা কেন এরকম করছে? তারা অনেক কষ্টে আছে, সেই কষ্ট কারণে হোক, অকারণে হোক, মিথ্যা হোক, সত্য হোক আমাদেরকে মেনে নিতে হবে যে তারা খুব ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। অনেকে এই অবস্থাতেও বেশ দাপট নিয়ে থাকে, এমনভাবে নিজের দুর্দশা চিত্রায়িত করে যে মনে হতে পারে এ কেমনতর ভিক্টিম! বরং এর বাড়িতে যারা আছে তাদেরই ভিক্টিম হওয়ার কথা! আসলে অনেকের অনেক কথা শুনে অনেক কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি মানসিকভাবে দৃঢ় অবস্থানে থাকি, আমাদের উচিৎ হবে না ফট করে কোনো সিদ্ধান্তে চলে আসা।
কেউ কষ্টের কথা ভুল করে ভুল জায়গায় বলে ফেলছে এতে তাদের খাটো করে না দেখাই ভাল। আবার তাদেরকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাদের সব কথা বিশ্বাস করে ফেলাও অযৌক্তিক।
একজন নিজেকে ভিক্টিম দাবী করলে, আপনাকে কষ্টের কথা বললে আপনি কী করবেন? এখানে আমরা মারাত্মক কিছু ভুল করি। আমরা অধিকাংশই তাকে সান্তনা দিয়েই থেমে থাকি না। আমরা তার জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করি। এই করার চেষ্টাতে ভয়ংকর কিছু গলদ আমার চোখে পড়েছে। যেমন কেউ একজন আমাকে বলল তাঁর শাশুড়ি খারাপ, তাকে নানাভাবে টর্চার করে। আমি তখন নাম পরিচয় গোপন রেখে তার শাশুড়িকে নিয়ে স্টেটাস দিয়ে বসি। এতে সে সাময়িক শান্তি পায় হয়ত। কিন্তু তার শশুড়বাড়ির লোকজন যদি ফেসবুকে থাকে তাদের যদি এই স্টেটাস চোখে পড়ে তখন তাদের দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগে না যে এখানে কোন শাশুড়ির কথা বলা হচ্ছে। আর আমরা মোটামুটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েই স্টেটাস দেই যেটা দেখে আমজনতা না বুঝলেও যাদেরকে নিয়ে স্টেটাস তারা ঠিকই বুঝবে।
হয়ত এই শশুড়বাড়ির লোকদেরও কিছু বলার আছে, কিন্তু তারা না পারে সইতে না পারে কইতে। কারণ আমি তো তখন পালটা আক্রমণ করব, কী ভাই আমি কি আপনাদের নিয়ে বলছি নাকি? সবকিছু নিজের গায়ে কেন নিচ্ছেন? একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা দরকার কী করলাম। আমি একজনের দুঃখে দুঃখী হয়ে এমন একটা কাজ করলাম যে কাজে আরও অনেকে দুঃখ পেল। এবং যাকে আমি ভিক্টিম মনে করছি সে যদি আসলেই এবসোল্যুট ভিক্টিম হয়ে থাকে, তাহলে আমার স্টেটাসের জের তার শশুরবাড়ি ভবিষ্যতে ভালমতই তুলবে। আর সে যদি এবসোল্যুট ভিক্টিম না হয়, সে যদি আমার কাছে পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টিতে তার অবদান লুকিয়ে থাকে, তাহলে আমি তার শশুরবাড়ির লোকের উপর যুলুম করলাম।
আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে যে, একজন কষ্ট পেয়েছে, সে আমার কাছে কষ্ট শেয়ার করছে মানে এই না আমি বিরাট বিজ্ঞ বিচারক হয়ে গেছি। কিন্তু আমরা তা-ই ভেবে বসি। বিচারক হই, তাও আবার আধা খেঁচড়া বিচারক। যে বিচারকের একমাত্র কাজ হচ্ছে একপক্ষের কথা শুনেই রায় দিয়ে দেয়া। আমি বললাম আমার শাশুড়ি খারাপ। অমনি বিচারক তার বিচারকার্য শুরু করে দিলেন। আমার বাসায় এসে শাশুড়িকে দেখে সালামও দিলেন না কারণ আমার শাশুড়ি খারাপ। কিংবা শাশুড়িকে পরোক্ষ খোঁচা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন আপনি বউয়ের উপর যুলুম করছেন। শাশুড়ি যদি সর্বংসহা হন তাহলে চুপচাপ থাকবেন, ইংগিত বুঝেও প্রতিবাদ করবেন না।
বিচারক মনে করে বসবে থোতা নাক ভোঁতা করে দিয়েছি, চুপ না থেকে উপায় কী! আর শাশুড়ি যদি প্রতিবাদ করে উঠেন, বলে বসেন এমন কথা বলার তুমি কে? তখন বিচারকের রায় এ তো দেখি চোরের মায়ের বড় গলা! এ সংসার থেকে বের হয়ে আসা ছাড়া উপায় নেই। বিচারকার্য সেরে উনি বের হয়ে আসবেন, কোনদিন বুঝবেনও না তিনি বিচারক না, একপক্ষের মনোনীত উকিল। ওদিকে আমার সংসার ঐ একটা ঘটনাতেই ছারখার! আমি অনেক দেরিতে বুঝতে পারব যে আমার একজন পরামর্শদাতা প্রয়োজন ছিল, বিচারক নয়!
এছাড়াও যাকে কষ্টের কথা বলছি এমনও হতে পারে সে দুইপক্ষের সাথেই কথা বলে নিপুণতার সাথে চোগলখুরি করে যাচ্ছে। পরিবারের সমস্যা, দাম্পত্য সমস্যায় চোগলখোররা এত নিষ্ঠার সাথে আপনার পাশে থাকবে, আপনার সুখ দুঃখের খবর নিবে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
একটু চিন্তা করে দেখুন, একজনকে নিজের ব্যক্তিগত কথা বললেই এরকম ভয়ংকর সমস্যা হতে পারে। সত্যি বলতে কি এরকমই হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাহলে আপনি যখন ভরা মজলিশে আপনার দুঃখের কথা বলবেন তখন কী অবস্থা হবে? আমি আপনাকে চিনি না, কিন্তু আমি জানি আপনি ফিজিক্যালি, মেন্টালি এবিউজড। কাদের দ্বারা এবিউজড সেটাও জানি। আমি যেকোনো সময় এর সুযোগ নিতে পারি। যেকোনো কিছুর মাধ্যমে আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারি। আপনি সারাজীবন কষ্টে থাকবেন না। কিন্তু সাময়িক কষ্টের সময় বোকামী করে যে কষ্টে থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেললেন!
এ প্রসংগে আলেমদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ খুব করা হয় যে, কোনো মেয়ে তাদের কাছে দাম্পত্য বা পারিবারিক সমস্যা নিয়ে গেলে তাঁরা শুধু সবরের কথা বলেন। এতক্ষণ যা বললাম তার সাথে আলেমদের পরিস্থিতি একটু মিলিয়ে দেখা দরকার। একটা মেয়ে তার কষ্টের কথা বলছে। এক্ষেত্রে আলেম পরামর্শদাতা নাকি বিচারক? তিনি বিচারকের দায়িত্ব কীভাবে পালন করবেন? যে মেয়ে অভিযোগ করল সে তাঁকে বিচারক মানতে রাজি, কিন্তু সেই মেয়ের পরিবার কি তাঁকে বিচারক মানতে রাজি? তিনি কি আগ বাড়িয়ে পরিবারকে বলতে পারবেন যে আপনারা কেন মেয়েটার উপর যুলুম করছেন? এতে মেয়ের পরিবারে অশান্তি থেমে যাবে নাকি আমাদের মধ্যে হুজুরকে আনলি কেন বলে অত্যাচার আরও বেড়ে যাবে? যে যালিম সে যদি নিজে না চায় কোনো আলেম তাদের দাম্পত্য সমস্যা সমাধান করুক, তখন সেখানে আলেম বিচারক কীভাবে হবেন? আর বিচারক হলে তো দুই পক্ষের কথা যাচাই করতে হয়। একজন আলেমের যখন কেবল এক পক্ষের কথা শোনার সুযোগ থাকে তখন তিনি ধৈর্য ধরার কথা বলা ছাড়া আর কীইবা বলতে পারেন? তিনি কি বলতে পারেন তুমি ডিভোর্স দাও যেখানে কিনা তার যাচাই করার সুযোগ নেই কে ভিক্টিম! এরকম একপাক্ষিক রায় হয়ত আমাদেরকে সন্তুষ্ট করবে যাক মেয়েটা ডিভোর্স নিয়ে শান্তিতে আছে। কিন্তু ঘটনা যদি অন্যরকম হয়? আলেমকে তো আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে। সেই দায়ভার কি আমরা নিব? একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান, তিনি আপনার দুঃখ কষ্টের কথা শুনে আপনাকেই কাউন্সেলিং করবে, আপনাকেই ওষুধ দিবে। যাদের কারণে কষ্টে আছেন তাদেরকে ওষুধ দিবে না। দেয়া সম্ভবও না। এই সহজ ব্যাপারটা আমাদের বোঝা উচিৎ।
দুঃখ কষ্ট যার কারণে পাচ্ছেন তাদেরকে বলুন। আপনার উপর অনাচার হলে প্রতিবাদ করা উচিত। মজলুমের জন্য প্রতিশোধ নেয়াও জায়েয। কিন্তু আমরা যে ভাবছি প্রতিবাদ মানে যার সাথে সমস্যা তাকে সরাসরি এপ্রোচ না করে অন্যদেরকে বলা, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলা, এটা বিরাট ভুল। কেন ভুল সেটা আগেই আলোচনা করেছি। সবচেয়ে উত্তম হয় আমরা যদি মানসিক শক্তি অর্জন করে প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত থাকতে পারি, ক্ষমা করে দিতে পারি। এটা যে পারছে না, সে খারাপ না। তবে যে পারছে, সে উত্তম। কেউ উত্তম পরামর্শ দিলে আমরা যদি সে পরামর্শ বাস্তবায়ন না-ও করতে পারি, আমাদের উচিৎ সে পরামর্শকে সম্মান করা, অন্যকেও পরামর্শ দেয়ার সময় উত্তম পরামর্শ দেয়া। তবে অন্যকে পরামর্শ দেয়ার বেলায় ডোমিনেট করার প্রবণতা ছেড়ে পরামর্শ দিতে হবে। আমার কথা না শুনলে তুমি শেষ এমন অনুভূতি যেন কারো মনে না আসে।
আরেকটা ব্যাপার, আমরা যেন সমস্যার মাত্রা বুঝে রেফার করার মানসিকতা রাখি। দেখা গেল একজন রাতের পর রাত জেগে আছে ঘুমাচ্ছে না। দিনেও ঘুমাচ্ছে না। তাকে দ্রুত সাইকিয়াট্রিস্ট, রাক্বী রেফার করা উচিৎ। আমি রাত জেগে তার দুঃখ দুর্দশার কথা শুনলে হবে না। এক রাত শুনতে পারব, দ্বিতীয় রাতে বিরক্ত হয়ে তাকে উলটো আঘাত করে বসব।
অবস্থা অনুকূলে থাকলে তাকে সুন্নাহ সম্মত দুআ, যিকর এগুলো জানাতে পারি, রুক্বিয়া কীভাবে করতে হয় জানাতে পারি। পারলে নিজেও রুক্বিয়া করে দিতে পারি। কিন্তু নিজের যোগ্যতার উপর সঠিক ধারণা রাখা উচিৎ। আমার থেকে বড় এক্সপার্টের কথা আমি জানি, তাহলে কেন সবকিছু নিজে সমাধান করতে যাব? এটা আমাদের একটা বড় সমস্যা যে, আমরা “খুবই কম জানি” টাইপ একটা বিনয়ী ভাব নিয়ে সবকিছুর সমাধান নিজে করে ফেলতে চাই।
আমি খুব কষ্ট করে আমার সাধ্যের মধ্যে ভদ্রভাষা ব্যবহার করে কিছু কথা লিখলাম। আশা করি যাদের চোখে পড়বে তারা যে অবস্থানেই থকেন না কেন (ভিক্টিম কিংবা পরামর্শদাতা) একটু চিন্তা করে দেখবেন।
পারিবারিক সমস্যা যখন ফেইসবুকে