‘সম্মান কেউ কাউকে দেয় না, বরং তা আদায় করে নিতে হয়’—এই আদায় করার অর্থ এই নয় যে, রাজপথে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিয়ে ,সভা –সেমিনারে বক্ততা করে কিংবা প্রতিপক্ষকে তিরষ্কার করে অন্যের কাছ থেকে সম্মান আদায় করা যায়।
বরং সম্মান হলো হৃদয়ের গভীর থেকে আসা এমন একটি অনূভূতি, যা কেউ কাউকে স্বাভাবিক সৌজন্যতাবোধ থেকে করে কিংবা কারও ব্যক্তিত্ব বা কাজে মুগ্ধ হলে তার প্রতি মনের অজান্তেই সম্মানবোধ এসে যায়। তবে সম্মান পাওয়ার পর তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্ব কিন্তু সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তির উপরও বর্তায়।
একটি উদাহরণ দিয়ে যদি ব্যাপারটা বোঝাই, আমাদের সমাজে শৈশব থেকেই সবাইকে শিখানো হয় যে, শিক্ষককে সর্বদা সম্মান করতে হবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের সম্মান করতে চায়, কিন্তু এই শিক্ষক যখন ছাত্র-ছাত্রীর সামনেই নকলে সহায়তা করে কিংবা প্রশ্ন ফাঁস করে তখন কিন্তু তার প্রতি স্বত:স্ফর্ত সম্মানবোধটা চলে যায়।
হয়তো সামনা-সামনি দেখা হলে তাকে সালাম দেয় ঠিকই কিন্তু আড়ালে গিয়ে তার সর্ম্পকে ব্যাঙ্গাত্মক কথা বলে। তার মানে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে, শিক্ষককে সম্মান করা যেমন ছাত্র-ছাত্রীর দায়িত্ব তেমনি সেই সম্মানের মর্যাদা ধরে রাখাও কিন্তু শিক্ষকের দায়িত্ব।
এবার আসি, নারীর প্রতি সম্মানের বিষয়ে। পুরুষরা নারীকে প্রাপ্য সম্মান দেয় না, পুরুষদের প্রতি এই অভিযোগ ইদানীং বহুল উচ্চারিত একটি বিষয়। কিন্তু গোড়া থেকে চিন্তা করলে একটি ধারণা পরিষ্কার হবে যে, পুরুষরা কিন্তু মাতৃগর্ভ থেকেই নারীকে অসম্মানকারী পুরুষ হিসেবে জন্মায় না।
বরং একটি ছেলে শিশু যখন পৃথিবীতে আসে তখন সে থাকে নিতান্তই অবুঝ ও অসহায় একটি প্রাণী । এরপর সে যে পরিবারে, যাদের সাথে বড় হতে থাকে তাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে তার প্রাথমিক মানসিক গঠন তৈরি হয়।
সেই হিসেবে তার প্রথম শিক্ষক তার মা, তার প্রথম খেলার সাথী তার বোন, তার প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার পরিবার।
এই পরিবারে যদি মা তার ছেলে শিশুকে প্রথমেই এই শিক্ষা দেন যে,
‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত’, —তবে কিন্তু নারীর প্রতি সম্মানের প্রাথমিক বীজটা ছেলে শিশুর অন্তরে প্রোথিত হয়ে যায়।
এরপর মা যদি, তার ছেলে ও মেয়ে উভয় সন্তানকেই খাদ্য, পোশাক, শিক্ষা, বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান সুবিধা দিয়ে বড় করতে থাকেন তবে একটি ছেলে শিশুর মনে নিজেকে তার বোনের চেয়ে superior ভাবার কোন মনোভাব তৈরি হয় না।
এভাবে নারী-পুরুষ অধিকারের বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে সে প্রথম পরিচিত হতে পারে তার পরিবারে।
এরপর যখন একটি ছেলে শিশু আরেকটু বড় হয় তখন যদি মা তাকে সমাজের অন্যান্য নারীদের মধ্যে কে কে তার গায়রে মাহরাম এই সম্পর্কে ধারণা দেন এবং তাদের সাথে তার আচরণ কেমন হবে তা বোঝাতে তাকে কুরআনের এই বাণী সম্পর্কে অবহিত করেন,
“মুমিন পুরুষদের বলো, তারা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখবে।” (সূরা নূর: ৩০)
তবে কিন্তু একজন ছেলে শিশু অন্য নারীদের প্রতি তার ভোগবাদী মনোভাব তৈরি হওয়ার পূর্বেই তাদের সম্মান করতে শিখে যাবে। এভাবে একজন পুরুষ হিসেবে সমাজে পদচারণা শুরু করার পূর্বেই একজন মা তথা একজন নারী তার পুত্র সন্তানকে সমাজের অন্য নারীদের প্রতি ক্ষতিকারক নয় বরং সহজাতভাবেই সম্মান প্রর্দশনকারী একজন সুরুচিবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তৈরি করে দিতে পারেন; শৈশবেই নারীদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী কেমন হবে সে সর্ম্পকে সঠিক ধারণা দিয়ে।
এবারে আলোচনা করা যাক, সম্মান ধরে রাখার ব্যাপারে নারীর ভূমিকা নিয়ে। আজকের যুগে নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদেই নারীকে ঘরের বাইরে পা রাখতে হয়। কিন্ত এই বিচরণের ক্ষেত্রে তার appearance কেমন হবে তার উপর কিন্তু তার সম্মান প্রাপ্তি অনেকটা নির্ভর করে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন ,
“মুমিন নারীদের বলো, যা সাধারণত প্রকাশ পায় তাছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না”।
(সূরা নূর: ৩১)
অর্থাৎ নারীর সৌন্দর্য হচ্ছে তার গুপ্তধনের মতো, যা সযত্নে লুকিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু যখন নারী নিজেই তার সৌন্দর্যকে সহজপ্রকাশ্য করে দেয় তখন তার প্রতি সম্মানের বোধটুকু ধরে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। পণ্যের বিজ্ঞাপনে, গানের মিউজিক ভিডিওতে, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায়, নাটকে ,সিনেমায় নারী যখন নিজের সৌন্দর্যকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে তখন ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও সবসময় নিজের দৃষ্টিকে সংযত রাখা পুরুষদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
‘নারী মায়ের জাতি’, তাকে স্বভাবতই সম্মান করতে হব ‘ –পরিবার থেকে শিখে আসা এই তত্ত্বের সাথে ব্যবহারিকের মেলবন্ধন ঘটাতে তখন তাদের মনে দোদুল্যমনতার সৃষ্টি হয়।
সহপাঠী, সহযাত্রী, সহকর্মী, সহধর্মী সবধরনের নারীকেই সে তখন অন্য চোখে দেখতে শুরু করে।
আর তাদের এই অন্যদৃষ্টির মধ্যেও নিজেদের প্রতি সম্ভ্রম বা শ্রদ্ধা আদায় করে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু নারীরও দায়িত্ব রয়েছে ।
নারী যদি তার পোশাক, কথাবার্তা, ব্যবহারে শালীনতা বজায় রেখে তার দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রতিভাকে highlight করতে পারে ,তার ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে প্রকাশ করতে পারে যে, নারী হিসেবে তার সৌন্দর্য নয় বরং মানুষ হিসেবে তার কর্মের মূল্যায়ন করতে সবাই বাধ্য হবে তখন কিন্তু সেই নারীর প্রতি সম্মানবোধটা automatic এসে পড়ে।
আমরা যদি উম্মুল মুমিনীনদের কথা চিন্তা করি তবে অনুধাবন করতে পারব যে, তাদের ব্যক্তিত্বের দ্যুতি এতটাই প্রখর ছিল যে, যে কোন পুরুষ শ্রদ্ধায় অবনত হতে বাধ্য হতেন।
তাই নারীকে শুধু পোশাক দিয়ে পর্দা করলে হবে না বরং তার কথা, ব্যবহার, আচরণ সবকিছুর মাধ্যমে পর্দা করে পুরুষদের সমীহ আদায় করে নিতে হবে। কুরআনুল কারীমে মু’মিন নারীদের পর্দার আড়াল থেকে গায়ের মাহরামের সাথে কথা বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের সাথে কোমল স্বরে নয় – বরং কর্কশ স্বরে কথা বলতে আদেশ করা হয়েছে। তাদের গৃহে অবস্থান করা উত্তম বলা হয়েছে।
উপসংহারে এটাই বলতে চাই _ নারীরা যদি মা হিসেবে, বোন হিসেবে পুত্র বা ভাইয়ের মনে নারীর প্রতি সম্মানের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়;এবং সহপাঠী , সহযাত্রী , সহকর্মী, সহধর্মী হিসেবে “ব্যক্তিত্বের পর্দা ‘ (পোশাক, কথা, ব্যবহার সবকিছুতে শর’ঈ পর্দা মেনে চলা) বজায় রেখে নিজের ব্যক্তিত্ব ও কর্মদক্ষতাকে উপস্থাপন করতে পারে; তবে পুরুষদের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান আদায় করে নিতে আন্দোলন করতে হবে না। বরং সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে নারীকে সম্মান করার সুস্থ পরিবেশ তৈরি হবে।
আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকওয়া এবং ধর্মনিষ্ঠাকে সম্মানের মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যার মধ্যে যতো বেশি তাকওয়া থাকবে সে ততো বেশি সম্মানের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।
আল্লাহ আমাদের নারীদেরকে তার নিজের দায়িত্ব ও করণীয় সঠিকভাবে পালনের তৌফিক দিন। আমিন।
নারীর প্রতি সম্মান
হাবিবা মুবাশ্বেরা
অগাস্ট ১৮, ২০১৯ইং