গৃহিণী না চাকরিজীবী?

আমি তখন দ্বীনের পথে নতুন চলতে শুরু করেছি। সেই সময় একজন ভদ্রলোক আমি চাকরি করতে চাই না শুনে বলেছিলেন যে আমাদের পড়াশোনা করাতে দেশের অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে, তাই আমাদের উচিত দেশকে কিছু দেয়া। সীমিত জ্ঞান আর দুর্বল আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেদিন কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু নিজের দ্বীন পালনের জন্য উত্তম তাই ঘরে থাকতে চাই বলেই দেশকে আমার কিছু দেয়ার নেই এই কথা মনের গভীরে কখনোই বিশ্বাস করিনি।

আচ্ছা, ঘরে থাকা মানেই কি আনপ্রোডাক্টিভ থাকা আর বাইরে গিয়ে কাজ করা মানেই কি প্রোডাক্টিভ থাকা? সমাজ কিন্তু কাউকেই কথা শোনাতে ছাড়ে না!
যারা ঘরে থাকে সমাজ তাদের শোনায় “সারাদিন ঘরে বসে কী কর?” যারা বাইরে যায় চাকরি করতে সমাজ তাদের শোনায় “সারাটাদিন বাইরে থাকে!”

যারা ঘরে থাকে সমাজ তাদের মনে তৈরি করে দেয় হীনমন্যতা আর যারা বাইরে চাকরি করে তাদের মনে এনে দেয় অপরাধবোধ।

আমি ঘরে থেকেই হোক বা বাইরে গিয়েই হোক, যে কাজটা করব তার মাপকাঠি কী হবে আসলে?
আসুন দেখি আমাদের স্রষ্টা কী বলেন।

“আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।” [সুরা যারিয়াতঃ৫৬]

এর মানে কি এই যে আমরা সারাদিন জায়নামাযে বসে সালাত পড়ব আর তাসবীহ গুণব? না। বাধ্যতামূলক ইবাদতের পাশাপাশি দুনিয়াতে চলার জন্য আমাদের যা কিছু করতে হবে সে সব কিছুর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর ইবাদত করব। খাওয়া, ঘুম, সংসার চালানো, সন্তানকে বড় করা, রোজগার করা সবকিছুর পেছনে উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

এখন একজন নারী যদি সারাদিন ঘরে থাকেন কিন্তু ঘরে থেকে উনার উপার্জন হচ্ছে খাওয়া, অলসতা আর হিন্দি সিরিয়াল দেখা তাহলে তিনি ঘরে থেকে আল্লাহর ইবাদতও হচ্ছে না, সমাজে কোন ভাল্যু অ্যাড করতেও পারছেন না। আবার একজন নারী হয়ত সংসারে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়াই বাইরে গিয়ে চাকরি করছেন, হতে পারে সেটা নিজের পড়াশোনাকে “কাজে” লাগানোর জন্য বা স্ট্যাটাস সিম্বল হিসাবে অথবা বাড়তি রোজগারের জন্য।

তিনি যে কাজটা করছেন সেটা হয়ত একজন পুরুষও অনায়াসে করতে পারেন। বাইরে চাকরি করে উনি শ্রম ও মেধা দিচ্ছেন, মাস শেষে কিছু টাকা হাতে পাচ্ছেন। এতে দেশের জিডিপিতে ভ্যালু অ্যাড হচ্ছে, কিন্তু সমাজে কতটুকু হচ্ছে সত্যিই?

লক্ষ্য করুন, একজন পুরুষ যখন চাকরি করেন তখন এই কথাগুলো আসে না কারণ তার প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য রোজগার করা। তার এই কাজের মাধ্যমেই তিনি পারছেন আল্লাহর ইবাদত করতে, দেশের জিডিপিতে ভ্যালু অ্যাড করতে এবং একজন দায়িত্বশীল মানুষ হওয়ার মাধ্যমে সমাজেও ভ্যালু অ্যাড করতে। যারা এই দায়িত্ব পালন করেন না তাদের কথা এখানে বলছি না।

কিন্তু একজন নারী প্রথমেই ঘরের ব্যবস্থাপক, সন্তানের প্রথম শিক্ষক। শুধুমাত্র এই দায়িত্বটা পালন করলেই সে সমাজে ভ্যালু অ্যাড করতে পারছে। দেশকে কিছু দিতে পারছে। দেশের জিডিপিতে অবশ্যই এতে ভ্যালু অ্যাড হচ্ছে না, কিন্তু অর্থ হাতে না আসলেও যে সমাজকে অনেককিছু দেয়ার আছে এটা বোঝার মতো অন্তর্দৃষ্টি খুব কম মানুষেরই আছে।

যদি বলা হয় পড়াশোনাকে কাজে লাগানোর কথা তাহলে বলতে পারেন আমাদের দেশের কতজন পুরুষ যে বিষয়ে পড়েছেন সেই বিষয়ের ওপরই চাকরি করছেন? একজন উচ্চশিক্ষিত গৃহিণী নারীর ক্ষেত্রেই কেন তাহলে এই কথাগুলো উঠাই আমরা? একজন শিক্ষিত সচেতন নারী যেভাবে ঘর পরিচালনা করবেন, সন্তান প্রতিপালন করবেন একজন অল্প শিক্ষিত, উদাসীন মা কি সেভাবে পারবেন?

যে মা বাচ্চাকে মোবাইল হাতে দিয়ে খাওয়ান আর যে মা গল্প শুনিয়ে খাওয়ান তারা কী একই ভ্যালু অ্যাড করছেন সমাজে? সন্তানের প্রথম উপুড় হওয়া, প্রথম একলা বসতে পারা, প্রথম দাঁড়ানো, প্রথম হাঁটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার মাঝে, সন্তানকে পূর্ণ দুই বছর বুকের দুধ খাওয়াতে পারার মাঝে যে তৃপ্তি আর না পারার মাঝে যে আফসোস তার খবর কি আমরা যারা দেশের জিডিপিতে নারীদের বাইরে কাজ করিয়ে ভ্যালু অ্যাড করাতে চাই তারা রাখি? যেসব মায়েরা একই বাচ্চাকে অথবা ক্রমবর্ধিতভাবে কয়েক বাচ্চাকে মিলিয়ে জীবনে অন্তত দুই বছর বুকের দুধ খাওয়ান তাদের পরবর্তীতে স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৫০% কমে যায়।*১

একজন মানসিকভাবে তৃপ্ত মানুষ সমাজকেও উত্তম কিছু দিতে পারেন।

আমাদের মা, মামীরা রান্নাঘরে ঘেমে নেয়ে যে খাবারগুলো রাঁধেন আমরা সেটাকে “গ্র্যান্টেড” ধরে নেই। মনে করি এ আর এমন কী! কিন্তু পশ্চিমা সমাজ এখন দোকানের খাবার বা প্রসেসড ফুডের চাইতে ঘরে রান্না করে খাওয়ার উপকারিতা ও গুরুত্ব নিয়ে কথা বলছে। বিশ্ববিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এই বিষয়ের ওপর অনলাইনে ফ্রি কোর্স আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে নারী পরিবারের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে ঘরে রান্না করছেন তিনি অবশ্যই সমাজে ভ্যালু অ্যাড করছেন।

আমার কয়েক বছর ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষদের দেশে থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে আমার দুইটা সন্তান হয়েছে। সেই সুবাদে বেশ কিছু মিডওয়াইফ (গর্ভবতী মেয়েদের দেখাশোনা করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী) ও বাচ্চাদের নার্সের সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। মা ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে বলেই কিনা জানি না, আমি দেখেছি তারা বেশ পরিবার কেন্দ্রিক ছিল। তাদের কয়েকজনেরই সন্তান সংখ্যা ছিল দুইয়ের বেশি।

তাদের সাথে কথা বলেই জেনেছিলাম যে তারা কেউ কেউ নিজেদের বাচ্চা ছোট থাকা অবস্থায় বাইরে কাজ না করে বাচ্চাদেরকেই সময় দিয়েছিল। বাচ্চারা বড় হওয়ার পর আবার পড়াশোনা ও কাজে ফিরে এসেছে। একজন মিডওয়াইফ আমাকে কথার ফাঁকে জানিয়েছিলেন যে উনার মেয়ের দুইটা ছোট বাচ্চা আছে। তাদের সময় দেয়ার জন্য সে স্কুল শিক্ষিকার চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে।

মা হওয়ার পর মেয়েরা যে বাচ্চাদের সাথে সময় দেয়াটাকেই বেশি পছন্দ করে সেটা উনার কথায় প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু তারপরই উনি চিন্তিত হয়ে বলেছিলেন যে মেয়েদের ওপর একটা সামাজিক চাপ থাকে বাইরে কাজ করার ব্যপারে। উনার মতে, একটা মেয়েকে একই সাথে বাচ্চা নিতে হবে আবার বাইরে কাজ করতে হবে এটা ঠিক না।

সেই ভদ্রমহিলার একটা কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, “I am worried of a society that pressurizes women to work. Babies need someone to be with them at home.” যে সমস্যা নিয়ে পশ্চিমারা চিন্তিত হয়ে পড়ছে আমরা কি সেই সমস্যার পথেই পা বাড়াচ্ছি না?

আমি যে শহরে ছিলাম সেটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক শহর। সেখানে আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের দেখেছি যারা বাচ্চাদের খাতিরে ঘরে অবস্থান করাকে বেছে নিয়েছে।

এমন মা দেখেছি যিনি সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়েছিলেন কিন্তু বাচ্চাদের সাথে থাকার জন্য তাদের যে কিন্ডিতে (৫ বছরের ছোট বাচ্চাদের জন্য খেলার পাশাপাশি শেখার জন্য প্রতিষ্ঠান) দিয়েছেন সেখানেই কাজ করছেন। এমন মা দেখেছি যিনি পড়াশোনা শুরু করেছিলেন কিন্তু আরও সামনে না এগিয়ে বাচ্চাদের সাথে থাকা দরকার ভেবে ঘরে থাকা বেছ নিয়েছেন। এরা সবাই উচ্চশিক্ষিত, সচেতন এবং আল্লাহভীরু।

পশ্চিমা দেশে সহজেই কয়েক বছর বিরতির পর আবারও পড়াশোনা বা কাজে ফেরত যাওয়া যায় যে সুবিধা আমাদের দেশে কম। কিন্তু আমার ফ্রেন্ডলিস্টের কিছু আপুদেরই তো জানি যারা বাচ্চা ছোট থাকতে তাদের পরিপূর্ণ সময় দিয়েছেন এবং পরে বাচ্চারা কিছুটা বড় হওয়ায় হাতে সময় থাকায় বাচ্চাদের স্কুলেই চাকরি নিয়ে আত্মতৃপ্তির সাথে কাজ করে যাচ্ছেন, মাশাল্লাহ।

আপনার নিয়ত যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে থেকে সমাজকে কিছু দেয়া তাহলে ব্যাংক বা বড় কোম্পানির চাকরির মতো প্রচলিত লোভনীয় কাজ ছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্র খুঁজে পাবেন যেখানে সত্যিই মেয়েদের অবদান রাখা প্রয়োজন।

তাই একজন নারী ঘরেই থাকুক আর বাইরেই যাক তার কাজের মাপকাঠি হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। যদি ঘরে থেকে সংসার পরিচালনা, সন্তান প্রতিপালন করার পরও কেউ ঘরের মাঝে থেকেই বা বাইরে গিয়ে, অর্থের বিনিময়ে বা স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে এমন কোন কাজ করেন যার মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জন করতে পারবেন, তাহলে আত্মবিশ্বাসী থাকুন যে আপনি সমাজে ভ্যালু অ্যাড করছেন।

যারা “গৃহিণী না চাকরিজীবী” এই কুতর্কের অবসান চান তাদের এই আত্মবিশ্বাস থাকাটা জরুরী।

১। বই AMANI Birth লিখেছেন আইশা আল হাজ্জার

————————————