বিশাল হলরুমে আমাদের ক্লাস। রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত সারি সারি বেঞ্চ। মোটামুটি বড় সাইজের একটা বেঞ্চে ব্যাগ রেখে কমনরুমে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি ক্লাসে টীচার চলে এসেছেন, আর আমার ব্যাগ মাঝে সরিয়ে দু’জন ছেলে বেঞ্চের শেষ প্রান্তে বসে আছে। এরা আমার দুই ব্যাচ জুনিয়র। কারো সাথে পরিচয় নেই।
আমি ওদেরকে বললাম তোমরা একটু বের হও, এই বেঞ্চে বসব। দু’জনের কারো মধ্যে ভাবান্তর দেখলাম না। কথাটা আবার বলতে একজন একটু কাত হয়ে জায়গা করে দিয়ে বলল এদিক দিয়ে যাও।
ততক্ষণে আমার মাথায় আগুন ধরে গেছে। বোরকা পরা একটা মেয়েকে এরা কাত হয়ে জায়গা করে দিচ্ছে বেঞ্চের ভেতরে বসার জন্য? বোরকা কেন, অন্য কোনো পোশাক পরিহিতার জন্যও দৃশ্যটা কল্পনা করা কষ্টকর। আমি তখন নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম দুই বছর বিরাট এক সময়। এই সময়ে ছেলে মেয়েদের চিন্তা ভাবনা অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার ব্যাচের কেউ হলে বেঞ্চ থেকে বের হয়ে জায়গা করে দিত।
যাই হোক, পরবর্তীতে আমার একরোখা আচরণের জন্যই ছেলেগুলো বেঞ্চ থেকে বের হয়ে জায়গা করে দিয়েছিল। বের হওয়ার আগে একজন সজোরে বেঞ্চে ঘুষিও দিয়েছিল। কে জানে হয়ত বেঞ্চে সুপারগ্লু লাগিয়ে বসেছিল, উঠতে খুব কষ্ট হয়েছে।
আমি এ ঘটনাটা মনে রেখেছিলাম। আজকালকার ছেলেরা বোরকা পরা মেয়েকে আর দশটা মেয়ের মতই ট্রিট করে।
কেন করে তা অনেকদিন ভেবেছি। একদিন জবাব পেয়ে গেলাম। মার্কেটে ঘুরছি মোজা কেনার জন্য। এক দোকানী বললেন এই গরমে মোজা পরবেন? আমার পায়ে মোজা, গায়ে বোরকা, তবু দোকানীর এমন প্রশ্ন।
জবাব না দিয়ে বের হয়ে এলাম। পাশেই একটা হিজাব শপ। আমার মতই বোরকা স্কার্ফ পরা একটা মেয়ে ছেলে বন্ধুর সাথে এসেছে স্কার্ফ কিনতে। ছেলেটা সাজেস্ট করছে এই ব্লু স্কার্ফটা নে। মেয়েটা বলছে, না রে…ব্লু বাসা থেকে পরতে দিবে না।
ঐদিন দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। আমি ওরনা দিয়ে হিজাব করছি, বোরকা পরছি তবু লোকজন আমার সাথে এমন আচরণ করছে কারণ আমার মত অনেক মেয়েই বোরকা পরছে, ওরনা দিয়ে হিজাব করছে কিন্তু ছেলেদের সাথে বন্ধুর মত মিশছে, তাদের সাথে শপিং এ যাচ্ছে। তাই আর দশটা মেয়ের সাথে আমার বাহ্যিক কোনো পার্থক্য নেই। ফ্রি মিক্সিং এড়াতে অনেক কাঠ খড় পোড়ালেও সেটা দৃশ্যমান নয়, কেউ আমার আইডিওলজি পোশাক দেখে বুঝতে পারছে না।
আমার উপলব্ধি আরেকটু গভীর হল আমার এক বান্ধবীর কথায়। সে একদিন বলছিলো, “আমাদের ক্লাসের ছেলেরা যে কী ভাবে আমাকে! আমাকে সেদিন করিডোরে একা দেখে অমুক ছেলেটা দেয়ালের সাথে যেন একেবারে মিশে গিয়ে জায়গা করে দিচ্ছিল”
আমরা দুজন খুব হাসলাম। করিডোরের প্রস্থ বিশাল। কারো প্রয়োজন নেই দেয়ালের সাথে মিশে যাওয়ার।
হাসাহাসি শেষে খচ করে একটা প্রশ্ন মস্তিষ্কে বিঁধে গেল যেন। কই কখনো তো কোনো ছেলে আমাকে এভাবে জায়গা করে দেয়নি!
আমিও পর্দা করি, তাহলে কেন সবাইকে এড়াতে পারি না? ব্যাচমেট থেকে জুনিয়র কিংবা অপরিচিত- অনেকেই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে। এমনটা কেন হয়?
আমি পুরো পৃথিবী না ঢেকে নিজের চরণ ঢাকায় বিশ্বাসী। তাই ভাবছিলাম নিজের কমতির কথা। সত্যি বলতে আমি জানতাম আমার সীমাবদ্ধতা আসলে কোথায়! কিন্তু কখনও সেটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা হয়নি। বান্ধবীর ঐ গল্পটা এত নাড়া দিয়েছিল যে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এমনভাবে পর্দা করব যাতে মানুষ আমাকে দেখেই আমার আইডিওলজি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে।
আমার আর আমার বান্ধবীর একটাই পার্থক্য ছিল। ও নিক্বাব পরতো, আমি পরতাম না।
পর্দার শুরু থেকেই আমার চিন্তা এমন ছিল যেহেতু আলেমদের মাঝে ইখতিলাফ আছে নিক্বাবের ব্যাপারে, নিক্বাব না পরলে গুনাহ হবে না ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। তিনি নানা ঘটনার মাধ্যমে আমাকে বুঝিয়েছেন সমাজ এতটাই পঁচে গেছে যে অবস্থান পরিষ্কার করতে হলেও নিক্বাব আমাকে পরতেই হবে!
উপলব্ধি হওয়ার পরপরই আমি নিক্বাব ধরতে পারিনি। একদিন একজন আলেমের লেকচারে শুনলাম তিনি নিক্বাবকে ফরয মনে করেন। তার লেকচার আমাকে অনেক প্রভাবিত করেছিল। আমি নিক্বাব কিনে ফেললাম। পরব কি পরব না করতে করতে ২/৩ মাস কেটে গেল।
অবশেষে একদিন পরেও ফেললাম। আলহামদুলিল্লাহ! নিক্বাব কেন পরব সে প্রশ্নের উত্তর এরপর আর খুঁজতে হয়নি। বরং এখন নিজেকে প্রশ্ন করি নিক্বাব কেন পরব না?
উপলব্ধি
-উম্ম মারঈয়াম
৪ অক্টোবর ২০১৮