ঈদ নিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। যদিও আমি একজন খ্রিস্টান হিসেবে বড় হয়েছি, তবুও ছেলেবেলায় ঈদের দিনগুলো আমার খুব আনন্দে কাটতো।
তখন সম্ভবত ক্লাস ওয়ানে পড়ি। ঈদ-উল-আযহার দিন সকালে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম কুরবানি দেখব বলে। বাড়িওয়ালারা কী বিশাল একটা গরু এনেছে! দশ-বারো জন মিলে গরুটাকে মাটিতে শোয়ালো। একজন পাঞ্জাবি পরা লোক গরুটাকে জবাই করলো। দূর থেকে ভালোমতো দেখিনি সামনে মানুষ ছিল বলে। জবাই করে গরুটার পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো। কিন্তু এরপর যা ঘটলো তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না!
গরুটা এই অর্ধেক গলা কাটা অবস্থায় উঠে দিলো দৌড়, এই গলা কাটা মাথা নিয়েই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোককে তুলে পেছনে ছুড়ে মারল। এরপর প্রায় ২০/২৫ জন মিলে কোনভাবে গরুটাকে আবার মাটিতে শুইয়ে দিলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় এরপর কী হলো কিছু মাথায় ঢুকছিলো না। ভয় পেয়েছিলাম কিনা জানিনা, কিন্তু এই দৃশ্য আমি এখনো ভুলিনি। চোখ বন্ধ করলে আমি আজও সব স্পষ্ট দেখতে পাই।
এরপর অনেক বছর কুরবানী দেখিনি। রক্ত মাংসের গন্ধে বমি আসতো আমার। ঈদ উল আযহার দিন খুব প্রয়োজন না হলে কোথাও যেতাম না। বন্ধুরা সবাই ঈদ করতে গ্রামে চলে যেত। কিন্তু ঈদ উল ফিতরে সারাদিন ঘুরতাম।
স্কুল শেষ করার পর স্কুলের বন্ধুদের সাথে দেখা হতো না সহজে। কিন্তু ঈদ উল ফিতরে সবার বাসায় যেতেই হবে। সকালে একজনের বাসায় যেতাম, সেখান থেকে তাকে নিয়ে আরেক বান্ধবীর বাসায়, এরপর তাদের নিয়ে আরেকজনের বাসায় — এভাবে সাত-আটজন বান্ধবীর বাসায় ঘুরে সবাই একসাথে হতাম। সারা বছর যেন এই একটা দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম।
আমি তখন অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ি। বড় বোন ইসলাম গ্রহণ করার পর ওর বিয়ে হয়ে গেল রমাদান মাসে। এদিকে আমিও মুসলিম হয়ে খ্রিস্টান থাকার অভিনয় করে যাচ্ছিলাম আমার পরিবারের সাথে। সেবারও ঈদ-উল-ফিতর বন্ধুদের সাথেই কাটিয়েছিলাম। কিন্তু সে বছর প্রথম প্রকৃত ঈদ পালন করলাম বড় বোনের পরিবারের সাথে ঈদ-উল-আযহাতে। কুরবানী দিয়ে ভাইয়ারা গোস্ত উপরে পাঠিয়ে দিলেন। গোস্ত কিভাবে ভাগ করে বসে বসে দেখলাম। খুব ভালো লাগছিল।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধল যখন বোনের শাশুড়ি আমাকে গরুর ভুড়ি পরিষ্কার করতে সাহায্য করার জন্য ডাক দিলেন। যে আমি রক্ত-মাংসের গন্ধও সহ্য করতে পারি না, সেই আমি যে এতক্ষণ সব ভুলে বসে বসে দেখেছি, সেটাই তো অনেক। কিন্তু দুর্গন্ধ ভুড়ি পরিষ্কার করা! তাও আবার হাত দিয়ে ধরে। সাহায্যের জন্য বোনের দিকে তাকালাম, কিন্তু আমার অন্তঃসত্ত্বা বোন ততক্ষণে বমি টমি করে ঘরে চলে গেছে। এখন তো না-ও করতে পারিনা!!
আলহামদুলিল্লাহ আন্টির কাজ অনেক পরিষ্কার বলে সে যাত্রা কোনভাবে গ্লাভস পরে, ফুটন্ত পানি থেকে ভুড়ির টুকরো নিয়ে কাঠ দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করে বমি না করেই সুস্থ ভাবে ফিরতে পেরেছিলাম।
তবে সত্যি বলতে আমি অতীতে এত ঈদ উৎসব পালন করার পরেও সেদিন একজন মুসলিম হিসেবে আমার প্রথম ঈদ ছিল।
আলহামদুলিল্লাহ এরপর যত ঈদই এসেছে তার মধ্যে এটাই আমার বেস্ট ঈদ ছিল। নতুন জামা জুতা ছিল না, নিজের পরিবারের পক্ষ থেকেও কুরবানী ছিল না। অথচ সেদিন একজন মুসলিম হিসেবে সত্যিকারের ঈদ পালনের আনন্দ ছিল।
সময় কত বদলে গেছে, মনে হয় জীবনে আরেকবার যদি সেই ঈমানের স্বাদ আবার গ্রহণ করতে পারতাম! সেই অনুভূতিগুলো যদি আবার নতুন করে অনুভব করতে পারতাম…।
…………………….
নাইলাহ আমাতুল্লাহ
২৪ আগষ্ট ২০১৮