স্ক্রীন টাইম

আমার ৩ বছর আর ১৯ মাসের দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে সাম্প্রতিক একটা অভিজ্ঞতা লিখছি আজকে। বিদেশে থাকতে আমাদের বাসায় টিভি ছিল না। এক বছর আগে দেশে আসার পরই টিভির সাথে আমার মেয়ের পরিচয় বলা যায়। একই সময় কার্টুনের সাথেও তার পরিচয়।

তখন শিশুতোষ বিনোদনের প্রতি তার এই গ্রোয়িং নীড দেখে আমাকে অল্টারনেটিভ খুঁজতে হোল। কারণ দেশে ইন্ডিয়ান চ্যানেলগুলোতে যেসব কার্টুন প্রচার করা হয় সেসবের কন্টেন্ট বাচ্চাদের উপযোগী না।

ইউটিউব থেকে মারইয়াম মাসুদের তিলাওয়াতের সিরিজ ডাউনলোড করে বিদেশে থাকতেই শোনাতাম। দেখতে দিতাম না তেমন। এটা ছেড়ে রাখার পেছনে বিদেশের নিঝুম নিস্তব্ধতা ভাঙ্গাও একটা কারণ ছিল। কিন্তু এটা তো কার্টুনের মতো না, আসল মানুষ।

ইউটিউব থেকে তারপর ডাউনলোড করে দিলাম মীনার কয়েকটা এপিসোড, জ্যাকি সিরিজের কিছু শিক্ষামূলক এপিসোড। এসবের আশ্রয় নেয়া লাগে সাধারণত যখন আমি দুপুর বেলাটায় প্রায় এক ঘন্টার কিছু কম বা বেশি সময়ের জন্য ব্যস্ত থাকি, যখন ওদের দেখে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না।

তখন দুইজনকে একসাথে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য “আকর্ষণীয় কিছু একটা” দরকার। একটানা যেন ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে না থাকে তাই তুলে রাখা কিছু খেলনা আর বইও সাথে রেখে যাই। প্লেলিস্টটা কার্টুন দিয়ে শুরু করে একসময় মারইয়াম মাসুদের তিলাওয়াত অ্যাড করে দেই। এটা শুরু হয়ে গেলে স্ক্রিনের দিকে কম তাকায়, খেলনা আর বইয়ের দিকেও মনোযোগ দেয় তখন।

এভাবেই আমিও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবতাম এই সময়টা বুঝি এটাই দেয়া লাগবে। কিছুদিন আগে আমার বোন একটা কাজে আমার ল্যপটপটা চাইল। তখনই কয়েকদিন আমরা এটা ছাড়া রইলাম। আমার মেয়ে প্রায়ই বলতে থাকত “মীনা দেখব, মীনা দেখব!” আমি অলটারনেটিভ হিসাবে বলে উঠলাম আসো মীনার গল্প শোনাই। তারপর কার্টুনটাই গল্পের মতো করে বললাম। দেখলাম যে বেশ কাজে দিল। মীনা দেখতে না পাওয়া নিয়ে আর অভিযোগ নাই!

দুপুরের ওই সময়টা খেলনা আর বই দিয়ে গেলাম। দেখলাম যে আমার ছোট ছেলেটা এখন কিছুটা বড় হওয়ায় দুইজন মিলে এসব নিয়েই রইল পুরোটা সময়। এসবের প্রতি আগ্রহ শেষ হওয়ার পর সবকিছু বিছানার সাথে লাগোয়া জানালার কাছে নিয়ে নিজেরাও পর্দার আড়ালে গিয়ে বসে রইল। মানে নিজেরাই খেলা বানানো শুরু করে দিল।

আমার দ্বিতীয় প্রেগন্যান্সীর সময় যখন অল্প গ্যাপে দুইটা বাচ্চা হওয়া নিয়ে আমি চিন্তা করতাম, তখন একজন আপু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন যে এখন তোমার টেনশন হচ্ছে কিন্তু বাচ্চারা একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর শুধু শুকরিয়া করতে থাকবা। উনার পিঠাপিঠি দুইটা বাচ্চা একটু বড় হওয়ার পর নিজেরাই আপন মনে খেলতে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ্‌, এতদিনে মনে হয় সেটা কিছুটা দেখতে পাচ্ছি।

আমার মেয়ে আর ছেলে এখন দুইজন মিলে খেলা শিখছে। ছেলেটা দেড় বছরেই বেশ কথা বলা শিখে যাচ্ছে, যেটা বিদেশে থাকার জন্য হয়ত মেয়েটা দুই বছরেও শেখেনি। ছেলেটার কথা ফোটার পর আমার এখন অবাক হওয়ার পালা। এতদিন আমি কথা বলতাম আমার মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে, ওকেই শেখাতাম সব কিছু।

ছেলেটা শুনে শুনে কখন যেন অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। ওর আধো আধো বুলিতে হঠাত হঠাত একেকটা চেনা কথা বলে উঠে আর আমি অবাক হয়ে যাই। একদিন নিজের পা তুলে বলছে, “আটু, আটু”, একটু সময় লাগল বুঝতে যে মেয়েকে আমি দেখাচ্ছিলাম ওর হাঁটু কোনটা আর ছেলেটা সেটা শিখে ফেলেছে।এসব ছোট ছোট বিষয় আনন্দ দেয় অনেক!

ফিরে আসি আবার স্ক্রিন টাইমে। একজন আপু আমাকে বলেছিলেন প্রতিদিন এটা ছেড়ে না দিতে। তখন বিষয়টা কঠিন মনে হচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক এই অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে কাজটা সম্ভব, যেহেতু এখন ওরা নিজেরা খেলা শিখছে। তবে প্রতিদিন আবার খেলনা দিয়েও বসিয়ে রাখা যাবে না, বাচ্চারা এক জিনিসে বোর হয়ে যায়। কিন্তু আগে যেমন মনে করতাম যে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে স্ক্রিন টাইম দিতেই হবে তেমনটাও আর না।

আসলে, বাচ্চার খাওয়া, ঘুম থেকে শুরু করে সবকিছুতেই মাদারহুড টেকনিক বাচ্চার বয়সের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। ধীরে ধীরে অনেক কিছু সহজতর হয়ে যায়। যেমন স্ক্রীন টাইম ছাড়াও সন্তানদের আনন্দে রাখার বিভিন্ন আইডিয়া আজকাল প্রয়োগ করার চেষ্টা করি।

এক সময় স্ক্রীন ছাড়া বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখা খুবই অসম্ভব মনে হত। এখন কিন্তু তা অনেকটাই সম্ভব হয়ে গেছে। মায়েরা যদি নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাহলে আপাতদৃষ্টিতে বহু অসম্ভব জিনিসও বাস্তবে পরিণত করা যায় আলহামদুলিল্লাহ।

স্ক্রীন টাইম
– রাবেয়া রওশীন

(০৮/০৪/২০১৯)