আচ্ছা, বলুন তো আমরা ঔষধ কেন খাই? কখন খাই?
আপনার বাচ্চার সন্ধ্যাবেলা হালকা জ্বর এলো, আপনি জ্বর না মেপেই প্যারাসিটামল খাওয়ালেন। রাতে জ্বর বাড়লে আবার জ্বরের ঔষধ খাওয়ালেন, মাথায় জলপট্টি দিলেন। জোর করে খাওয়াতে গিয়ে বাচ্চা বমি করে দিলো, আপনি অস্থির হয়ে সকালে উঠে ফার্মেসীতে গিয়ে একটা বমির ঔষধ নিলেন, একটা এন্টিবায়োটিক নিলেন, পেটটা ফাঁপা তাই একটা গ্যাসের ঔষধ নিলেন। খুশী তো?
ঐ জ্বর রাতে গিয়েও কমলো না, আপনি এবার ফার্মেসীর ডাক্তারকে দেখালেন। সে বেচারা যদি অভিজ্ঞ হয়, আপনাকে শুধু জ্বরের ঔষধই চালাতে বলবে নতুবা আপনার উদ্বেগ দেখে আরেকটা কড়া এন্টিবায়োটিক দিয়ে দিবে। এত ঔষধ খেয়ে বাচ্চা আরো দুর্বল হয়ে পড়লে এবার হাসপাতালে নিয়ে দৌড়ালেন।
” জ্বর কতদিনের?”
“দুইদিনের! “
” এত ঔষধ কেন? এই জ্বর তো আরো পাঁচ থেকে সাতদিন লাগবে ভালো হতে। সিজনাল ভাইরাল ফ্লু। “
” বাচ্চা তো কিছুই খায় না, জ্বর তো নামছেই না, বমি করছে ! ” এই তো দিলেন ডাক্তার বেচারাকে আবার কনফিউজড করে। অথচ বাচ্চা তখন টেবিলের উপর থেকে পেপার ওয়েট ছিনিয়ে নেয়ায় ব্যস্ত, নাহলে হাসি দিয়ে ডাক্তারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছে।
আচ্ছা, আপনাদের কোন আইডিয়া আছে, “খেতে চায় না আর খেতে পারে না ” এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কি? খাওয়ার রুচি নাই, খেতে পারছে না কিছুই, শুকিয়ে গেছে, দূর্বল হয়ে গেছে, এরকম হলে চিকিৎসা জরুরী, ভর্তি করতে হয় প্রয়োজনে ।
যে বাচ্চা খেতে চাইছে না কারন তার খিদা নেই, খেতে পারে কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছে নেই, এসব বাচ্চারা অধিকাংশই খাওয়া নিয়ে জোর করা বাচ্চা, যাদের কাছে খাবার মানে অত্যাচার, জোড় করে ঠেসেঠুসে এদের যখন খাওয়ানো হয়, এরা বমি করে দেয় নাহলে খাবার জমিয়ে রাখে মুখে। খিদা না থাকলেও এক গামলা ভাত আপনাকে ঠেসে খাওয়াক কেউ, কেমন লাগে জানাবেন!
যাইহোক, হাসপাতালে ভর্তি হলেন তো? ঐ জ্বর কিন্তু অবশেষে সাত আট দিন লাগিয়েই ভালো হলো। মাঝখান থেকে একগাদা টেস্ট, কড়া এন্টিবায়োটিক দিয়ে বাচ্চার অবস্থার তেরটা বাজিয়ে, হসপিটালের একগাদা বিল দিয়ে ডাক্তারদের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে বাসায় ফিরলেন।
এরপর আপনি হয়ে গেলেন “জ্বর” রোগের বিশেষজ্ঞ। যখন আবার বাচ্চার জ্বর হবে আপনি আগেই বুদ্ধিমানের মত আগের প্রেসক্রিপশন দেখে হায়ার এন্টিবায়োটিক শুরু করে দিবেন, এবার আর কিছুতেই বাচ্চাকে হাসপাতালে নিবেন না, এই জ্বর হয়তো দেখা গেলো দুদিনেই ভালো হয়ে গেলো, ফলস্ এলার্ম ছিল। আপনি পিঠ চাপড়ালেন নিজের বুদ্ধিমত্তায়।
বুদ্ধিমান রাখাল বালকের মত বার বার এন্টিবায়োটিকের সাহায্য নিলেন জ্বর ভালো করতে। একসময় যখন সত্যিই এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন দেখা দিলো তখন দেখা গেলো বাচ্চা সব এন্টিবায়োটিকে রেজিস্ট্যান্ট। দোষ দিবেন ডাক্তারদের, রোগ ভালো করতে পারে না।
অথচ শুরুটা কে করেছিলো বলুন তো? আপনিই, তাই না? আরে বাবা, ওটা সিম্পল ভাইরাল ফিভার ছিল, এমনিতেই পাঁচ দিন পর কমতে শুরু করতো, একটু যত্ন নিলেই ভালো হয়ে যেত। অথচ কথাটা শুনেন নাই তখন। জ্বর আসলে সারা গা ভেজা গামছা দিয়ে মুছে দেয়া, প্রচুর পানি তরল খাবার খাওয়ানো, বেশী জ্বরে গোছল করিয়ে দেয়া, এটুকু করলেই তো বাচ্চা দূর্বল হতোনা, এত ঔষধও লাগতো না।
ভাইরাস সংক্রমণে আসা জ্বর বা কাশিতে ঔষধ দিলেও যা, না দিলেও তা। কাশি ভালো হয় না বলে অনেকে পারলে পুরো ফার্মেসির যত কফ, ঠান্ডা,শ্বাসকষ্টের ঔষধ আছে সব খাওয়ানোর পর আসেন ডাক্তারের কাছে, একমাসের কাশি, জন্মের পর থেকেই ঠান্ডা, সিজারের বাচ্চা তো, এমন সব চিন্তাভাবনা নিয়ে। আসলে হয়তো গরমে ঘেমে, ধূলাবালিতে দৌড়ে, বাথরুমে পানি ঘেঁটে নাহয় ফ্রিজের পানি, আইসক্রিম খেয়ে বাচ্চা বার বার ঠান্ডা লাগাচ্ছে। অনেক বাচ্চা অবশ্য বংশগতভাবেও এলার্জিতে ভুগে।
” কথা শুনে না বাচ্চা কি করবো? ” খেলে কথা শুনবে এমন ঔষধ কি আবিস্কার হয়েছে? নাকি আমরা আপনার বাচ্চাকে গিয়ে পাহারা দিবো? রাস্তার ধূলাবালি, বাতাসে সীসা, কারখানা বিষাক্ত ধূয়া, ইটের ভাটার কালো ধূয়া…. এসব কি ঔষধ দিয়ে বন্ধ হবে? তাহলে কাশি কেমন করে ভালো হবে?
আবার সত্যিই যখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, বাচ্চাকে নেবুলাইজ করতে চান না অনেক বাবা মা। বাচ্চার হাঁপানি স্থায়ী হয়ে যাবে, সারাজীবন ইনহেলারে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তাহলে, এই তাদের ভয়। এটা সাময়িক শুশ্রূষা, বাচ্চার ভালোর জন্য, এটা আর বুঝানো যায় না।
বাচ্চার ঠান্ডা লাগলে তার নাক পরিস্কার রাখুন, আদালেবু চা, মধু, স্যুপ খেতে দিন। গরম পানির ভাপ নেয়া, গড়গড়া করা, নিয়মিত গোছল করানো, ঘাম মুছে দেয়া, ঘরে আলো-বাতাসের চলাচল নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাচ্চার ঠান্ডা কাশি কমিয়ে রাখা যায়। এত ঔষধপত্রে কি আদৌও কোন উপকার পেয়েছেন কখনো?
আরেক প্যারার নাম ভাইরাল ডায়রিয়া। এক্ষেত্রে ভালো ডাক্তার সেই যে শেষবার চিকিৎসা দেয়। পাঁচদিনে ভালো হওয়ার কথা, সেখানে আপনি তিনদিনে চারজন ডাক্তার পাল্টালেন। কি লাভ হলো? আরো এক ডিগ্রি সেয়ানা হলে, প্রথম দিনেই শুরু করে দিলেন তথাকথিত কমন ঔষধ “মেট্রোনিডাজল” । এই ঔষধটা একটু খেয়ে দেখবেন প্লিজ? সিরাপের মেটালিক টেস্টই যথেষ্ট আপনার বাচ্চার খাওয়ার রুচি চলে যাওয়ার জন্য আর বমি শুরু হলে তো কথাই নাই।
হাত তুলুন কার কার ধারনা আমরা ডাক্তাররা, পাতলা পায়খানা বন্ধ হওয়ার জন্য ঔষধ দেই? এক, দুই, তিন…… আশি নব্বই…. !!! সিরিয়াসলি? এমন কোন ঔষধ এখনো কিন্তু আবিস্কার হয়নি। পাতলা পায়খানায় আমরা ঔষধ দেই ইনফেকশন হলে, জ্বর বমি বন্ধের জন্য আর পানিশূন্যতা রোধে। এগুলো কন্ট্রোল করতে পারলে পায়খানা আপনাআপনিই কমে যাবে।
উল্টো আপনি যদি অযথা ঔষধ খাওয়ান, শরীরে কিছু উপকারি ব্যাকটেরিয়া থাকে যাদের ব্যাকটেরিয়া সমাজের বিভীষণ বলে, এরা মারা পরবে । ফলে বাচ্চার আরো বদহজম ও ডায়রিয়ার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তাহলে কি দরকার অযথা ঔষধ খাওয়াবার?
খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াবেন? তারও নিয়ম আছে। যতবার পাতলা পায়খানা হবে ততবার স্যালাইন খাওয়াবেন, শুধু পায়খানা হলেই, অযথা নয়। ছোট বাচ্চা? পুরোটা স্যালাইন না গুলিয়ে একটু একটু করে গুলিয়ে খাওয়াবেন? বাচ্চাটা আপনার তো? মেরে ফেলতে চান নাকি?
ভুলেও, আমি আবার বলছি, ভুলেও এমন কাজ করবেন না। এই একটা ভুলই যথেষ্ট আপনার বাচ্চাকে মাত্রারিক্ত লবণে কিডনী বিকল করে মেরে ফেলার জন্য। আধালিটার পানিতে পুরো স্যালাইন গুলিয়ে ছয় ঘন্টা পর্যন্ত রাখতে পারবেন। এক প্যাকেট স্যালাইন পাঁচ-দশ টাকা, কিপ্টেমি করে অমূল্য সন্তানটিকে হারাবেন না।
এরচেয়ে বাচ্চাকে প্রয়োজন অনুযায়ী স্যালাইন, প্রচুর পানি, কাঁচাকলা দিয়ে জাউ, পাতলা ডালের পানি, স্যুপ খাওয়ান। পরিষ্কার পরিছন্ন রাখুন, নখ কেটে দিন, নিয়মিত গোছল করান। অল্প অল্প করে বাসায় তৈরী খাবার দিন, এক চামচ এক চামচ করে ১৫ -২০ মিনিট পর পর, তাহলে কিছু বমি হলেও কিছু অন্ততঃ পেটে থাকবে। পেশাব কমে গেলে, সে পরিমান খাবার বা পানি মুখে খাওয়াতে না পারলে, পায়খানায় রক্ত দেখা গেলে তবেই শুধু ঔষধ লাগবে, ডাক্তারের পরামর্শ লাগবে।
সবশেষে জাতীয় একটি সমস্যার কথা বলে শেষ করি। “বাচ্চা কিছু খায় না একটা রুচির ঔষধ লিখে দিন”। এই কথাটা বলে নিজেই নিজের অজ্ঞতাকে জানান দিবেন না । এখন তাহলে বলুন তো, এসব ভিটামিন কেন বানানো হয়েছে বলে আপনার ধারনা ? খেলেই আপনার বাচ্চা রাক্ষসের মতো খিদা নিয়ে খাবারের উপর ঝাপিয়ে পরবে? তর্কের খাতিরে নাহয় এটাও সত্যি মেনে নিলাম। এখন বলুন, বাচ্চা বেশী খেলে কি লাভ? স্বাস্থ্য ভালো চান নাকি মোটা বাচ্চা চান?
বাচ্চা বেশী খেয়ে সুমো কুস্তিগির হলো, নড়তে চড়তে হাঁপিয়ে যায়, ঘেমে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, হেঁটে গেলে মনে হয় একটা কিউট হাতির বাচ্চা! এই চান? তাহলে কেন প্রেম করার সময় মডেলদের মত ফিগার, সিক্স প্যাক পেশী বহুল বডি খুঁজেন? মোটা বলে বিয়ের সময় রিজেক্ট করেন? মোটা বাচ্চা তাহলে কেন চাচ্ছেন? আপনার বোনের বাচ্চাটা কি নাদুসনুদুস, ভাসুরের বাচ্চাটার পাশে আপনারটাকে হাড়গিলা লাগে?
তুলনা করাটা আসলে আমাদের একটা সামাজিক ব্যাধি। অ্যাঞ্জেলিনা জোলি কি সবাই হতে পারবে? সবাই কি বিল গেটস হবে? ওজনটাও সবার এক হতে হবে? আপনার ভাসুরের বউ চলমান মৈনাক পর্বত, না খেলেও ওজন বাড়ে। তার বাচ্চার স্বাস্থ্য বংশগত কারনে ভালো। আপনার বোনের বাচ্চাটা হয়তো সারাদিন ট্যাব, টিভি, কম্পিউটার নিয়ে পরে থাকে, ফাস্ট ফুড ছাড়া খায়না। তার সাথে আপনার চঞ্চল, বুদ্ধিমান, মেধাবী কিন্তু স্বাস্থ্য কম বাচ্চাটার তুলনা চলে?
তাহলে বলুন লেখাপড়া, খেলাধূলায় ভালো করা বাচ্চাটার মাবাবা হতে চান নাকি অকর্মা, বুদ্বিহীন অথচ মোটা বাচ্চার মাবাবা হতে চান? খুব অশালীন মনে হচ্ছে এভাবে বলায়? তবে হ্যা, বাচ্চার ওজন যদি বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী অপুষ্টির সূচকে পরে তখন অবশ্যই তার চিকিৎসা প্রয়োজন। আর এত কথার পরও যদি বলেন আপনার বাচ্চা খায় না তাহলে এক কাজ করুন, একটা বাচ্চা এনে দেখান তো পথশিশুদের মধ্যে থেকে, যার খাবারে রুচি নাই!
কেন ঔষধ খাওয়াবেন তাহলে? ভিটামিন দেয়া হয় অপুস্টির বাচ্চাকে, অনেকদিন রোগে ভুগছে, যক্ষা, ক্যান্সারে ভুগছে এমন বাচ্চাদের। পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য, পুস্টিকর খাবারের সহায়ক হিসেবে দেয়া হয়, বাচ্চাকে মোটা হওয়ার জন্য নয়। বোঝা গেলো?
একটা সুস্থ সুন্দর শিশুর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে তার যত্ন নিন, সঠিক সময়ে সঠিক খাবারটি নিশ্চিত করুন, মানসিক বিকাশে সুস্থ পরিবেশ দিন, সমাজে চলতে হলে সুন্দর আদব কায়দা শেখান। লোকে যখন আপনার বাচ্চার প্রশংসা করবে তখনই বুঝবেন আপনি সার্থক।
ঔষধ বনাম রোগঃ বন্ধু তুমি শত্রু তুমি
-লুনা লাবিব
১১/০৪/২০১৯