গয়না কোথায়? পর্ব-১

-উম্মে লিলি

নরম হাতের ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো চৈতির।
“এই আপা, ওঠ! ওঠ! ঘটনা হ্যাজ বিন ঘটেন!”

হঠাৎ ঘুম ভাংলে বুক ধড়ফড় করে ওর। নীতিটাকে বারবার বলেছে হুট করে না ডাকতে। পিচ্চিটা যে কবে বড় হবে! কোনোমতে চোখ টেনে খুলল। পেট ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে ও। বুক ধড়ফড় করলে মনে হতে থাকে শ্বাস নেয়া যাচ্ছে না, অক্সিজেনের অভাব হয়ে যাচ্ছে বুঝি। আসলে বিষয়টা অনেকটাই মানসিক। পূর্ণাংগ রূপে শ্বাস নিতে পারলে হার্টবিট স্বাভাবিক হয়ে আসে। পেট ফুলাতে থাকলে মনোযোগটা বুক ধড়ফড় থেকে পেটের দিকে সরে যায়, স্বাস-প্রশ্বাস সহজ হয়ে যায়। সাইকিয়াট্রিস্টরা এমনই বলে।

কি ঘটতে পারে? আজ অনীমার আসার কথা। অনীমা কি চলে আসলো? কিন্তু প্লেন তো দুপুরে ল্যান্ড করবে ঢাকায়। চাচা জুমা পড়ে ওকে আনতে যাবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে মাত্র ৯টা বাজে।
এক হাতে অর্ধেক খাওয়া বাটারবন আর আরেক হাত দিয়ে চৈতিকে ঠেলে যাচ্ছে নীতি।

“শোন না আপা! বিশাল কাহিনী হইছে!”
“তোর হাতে বাটারবন কেন নীতি? ডাক্তার আন্টি তোকে না করছে না আবোল তাবোল খাইতে?”

গালে মুখে ক্রিম লাগানো নীতি পাত্তা না দিয়ে চোখ গোল গোল করে বললো, “আপা, চাচীমণির গয়না চুরি হইছে রে। বিশাল অবস্থা। চাচ্চু চায় না পুলিশ ডাকতে, পারিবারিক মানসম্মানের ব্যাপার। বুয়া খালাকে কী একটা জিজ্ঞেস করছে দাদীমণি আর খালা শুরু করছে বিলাপ করে কান্না।“

জলদি উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিল ও। সকালে উঠে নাস্তা বাদে অন্য কিছু করলে দাদী খুব বিরক্ত হন, কিন্তু আজ তো আর সব দিনের মতো নয়। ওড়নাটা গা এর উপর ছড়িয়ে দিয়ে চাচার রুমে নক করলো চৈতি। পিছন পিছন নীতিও চলে এসেছে।

“কিরে বিচ্ছু বাহিনী!” দরজা খুলে দুই ভাতিজির মাথায় টোকা মেরে রুম থেকে বের হয়ে গেলো আবরার। বালিশে মুখ গুঁজে উপুর হয়ে শুয়ে আছে সিমি। নীতি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে চাচীর শাড়ি সরে গেছে। অন্যান্য দিন হলে পেটে গুতো মেরে বলতো, “পেট দেখা যায়! পেট দেখা যায়!” আজ পরিস্থিতি সুবিধার না। নয়তো উপুড় হয়ে শোয়া নিয়েও একটা ইসলামী বয়ান দিয়ে দিতো ও। বয়ানের ব্যাপারে ক্লাস থ্রি পাশ নীতির কোনো জুড়ি নেই। ছোট মুখে পাকা কথা শুনতে ভালো লাগে এজন্যে কিনা কে জানে, ওর বয়ানে কেউই বিরক্ত হয় না।

চৈতী, নীতির পা এর আওয়াজে উঠে বসে সিমি।
“শুনেছিস মা?” শুকনো মুখে বলে চাচী। গালে এখনো না মিলিয়ে যাওয়া পানির দাগ।
মাথা নেড়ে সায় জানায় চৈতি।

“আমার ১৫ ভরি গয়না, সব গেলো।! হ্যা হয়তো খুব একটা পরতাম না। কিন্তু ওগুলোই তো আমার সম্পদ ছিল। বিপদে আপদে কাজে লাগতো হয়তো। বিয়ের স্মৃতি…আব্বার দেয়া , তোর চাচ্চুর দেয়া…। মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো চাচী।“

“কেঁদো না, চাচীমণি। আল্লাহ আমাদের বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। অনেক বিপদ কাটিয়েও দেন। হয়তো আল্লাহ আরো বড় কোনো ক্ষতি থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে দিলো, তুমি তো জানো না। “

“একদম ঠিক বলেছিস,আপা।“ নীতি বলে ওঠে।
শুদ্ধ ভাষায় সান্তনা দিলো চৈতি। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা এই বাড়ির নিয়ম। বড়দের সামনে এই নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করলেও নিজেদের ভেতর যেমন তেমন করে কথা বলে ওরা।

“তোর চাচ্চুকে বললাম পুলিশে খবর দিতে, বলে কিনা বাড়ির মান-সম্মানের বিষয়। তোর মা যদি থাকতো, ঠিক একটা স্টেপ নিতে বাধ্য হতো আবরার। এইসব ঠুনকো সম্মানকে ভাবি সবসময়ই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এসেছে।“

যখন তখন মা এর প্রসঙ্গ উঠা পছন্দ করে না চৈতি। দুই বছর হতে চলল মা এই বাড়িতে থাকেন না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে জানতে চাইলো, “বুয়া খালার কি হয়েছে গো? “
“ আর বলিস না। তোদের দাদীমণি একটু জেরার মতো করে ফেলেছে হয়তো! এমনি আমার গয়না হারানোর শোক। তার উপর যদি কাজের লোক আঁতে ঘা লাগায় চলে যায়, তো গয়নার চেয়েও এ বেশি হবে। এক সপ্তাহ ছুটিতে থাকলেই কাজ করে হিমশিম খাই।“

“খালাকে নিয়ে তোমরা কোনো চিন্তা করো না। আমি ইন শা আল্লাহ সেটিংস দিয়ে দিবো।“ নীতি খুব ভাব নিয়ে বলে।

“তুমি ভালো মতো খুঁজে দেখেছ চাচীমণি?”
“কি বলিস তুই তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। আমি যদি ভুলোমনা হতাম তাহলেও একটা কথা ছিল। এইযে তোর মা দুই বছর ধরে তোর নানাবাড়িতে পড়ে আছে। আমি কি একদিনও তোদের টিফিন দিতে ভুলে গেছি? নীতির কোনো অযত্ন হয়েছে?”

আবারও মা’র প্রসঙ্গ। চৈতির বাবা-মা এর বনিবনা হচ্ছে না, ডিভোর্সও হচ্ছে না। সে আরেক কাহিনী। বাবা আর্মি পার্সন, জাতিসঙ্ঘের মিশনে কংগো আছেন। তাকে মিস করলেও সয়ে গেছে ব্যাপারটা। কিন্তু মা’র অনুপস্থিতি প্রতি মূহুর্তে টের পায় দুই বোন। সবার কাছে ব্যাপারটা এতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে ওরা দুইবোন যে কষ্ট পেতে পারে, এটাই কেউ বুঝে না।

মুখটা শক্ত করে বলে চৈতি, “নাস্তা করে নেই আমি, তুমিও করে নাও। ইন শা আল্লাহ পাওয়া যাবে।“
“আর পাওয়া গেছে। পুলিশ কেইস হবে না। যে চুরি করবে সে কি নিয়ে বসে থাকবে? বেঁচে দিবে ঠিকই।“ চাচী ঝাঁঝের সাথে বলে।

……………

চলবে ইন শা আল্লাহ।