গয়না কোথায়? ২য় পর্ব

গরুর মাংসের ঝাল ঝাল তরকারি আর ডাল, গয়না হারানোর শোকে এই দুই পদের বেশি করা হয়নি আজ। দুপুরের খাওয়াটা আজ একটু দেরী করেই সাড়লো ওরা। অনীমার সাথে একসাথে খাবে বলে দুই বোন বসে ছিল অনেকক্ষণ।

ঢাকার বাইরে একটা মিলিটারি স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে ওদের চাচাতো বোন। ক্যাডেটে পড়ার খুব শখ ছিল, কিন্তু চান্স পায়নি। জেঠার মতো সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে এমন স্বপ্ন দেখেই বড় হয়েছে অনীমা। জেঠা বদলে গেছেন, অনীমার স্বপ্নকে নিরুৎসাহিত করেন। বলেন, মেয়েদের ডিফেন্স যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু অনীমা স্বপ্ন বুনেই চলেছে।

রুমের দরজা বন্ধ করে তিন বোন বসল। দোতলা খাটের উপরে উঠে যায় অনীমা। পা ঝুলিয়ে বসে, হাতে ধরে আছে ওর স্মার্টফোনটা। স্কুলে তো আর ফোন ব্যবহার করতে পারে না ও, বাসায় আসলে তাই ফোনটাকে এক মূহুর্ত ছাড়তে ইচ্ছা করে না। মুখোমুখি মেঝের বিছানার উপর চৈতি-নীতি বসে। নয় পেরিয়ে দশে পা রাখা নীতি একা শোয়া শুরু করেছে নতুন, তাই ওর জন্যে ফ্লোরিং করা হয়েছে। দোতলা খাটের উপর থেকে তো পড়ে যেতে পারেই, নিচ থেকেও পড়ার সম্ভাবনা আছে ওর। খুব হাত পা ছুড়ে ও ঘুমের মাঝে। খাটের কিনারায় শোয়া রিস্কি ওর জন্যে।

“কিরে এইটের পড়া কেমন লাগছে। ফাইভ থাকবে তো?”

অনীমার প্রশ্ন হেসেই উড়িয়ে দেয় চৈতি, “অত ফাইভের চিন্তা কে করে!“

“হ্যা ভাই, তুমি যে ট্যালেন্ট । তোমার নাচতে নাচতে ফাইভ আসবে। হইতা আমার মতো, তাইলে না কানতে কানতে পড়া লাগতো। কিরে মুটি তোর হিফ্‌য কেমন চলে?“

টিপ্পনী গায়ে মাখে না চৈতি। নীতি গাল ফুলায়,

“অনীমাপি আমি মোটেই মুটি না, স্বাস্থ্যটা একটু ভালো এই যা! মন ভালো না লাগলে কী করব বলো। খেয়ে সব ভুলে থাকি।“

চুপ হয়ে যায় অনীমা। জেঠিকে ওইও কম মিস করে না।
“তোর খবর বল অনীমা। রহস্যটা নিয়ে কি ভাবছিস?

“মাম্মার গয়না রহস্য? আসলে মাম্মা সচরাচর কিছু হারায় না। আর হারানো কিছু খুঁজে বের করায় কোনো জুড়ি নাই তার মা শা আল্লাহ! আমি যে পরীক্ষার আগের রাতে সিলেবাস হারাতাম, মাম্মা ঠিক খুঁজে বের করতো। মনে নাই? এটা অবশ্যই চুরি।”

“চুরি কে করলো, কিভাবেই বা করলো। বাইরের লোক তো কেউ ঢুকে না বাসায়?”

“এটাই সমস্যা। বুঝতে পারছি না। পাপা কিন্তু খুব খেপেছে। অনেকবার বলেছে গয়না ব্যাংকে রাখতে। কে শোনে কার কথা। কয়দিন পরপর এই পার্টি ওই পার্টিতে একেকটা সেট বের করে পরবে। গত পরশুও পরেছিল। বান্ধবীর জন্মদিনে, ফিরে এসে লকারে রেখেছে স্পষ্ট মনে আছে। চাবিটা সরিয়ে রাখেনি এটাই ভুল করেছে।“

“গত পরশু হলে তো বিষয়টা কিছুটা ইজি হয়ে যায়। পরশু থেকে বাসায় কে কে এসেছে জানা দরকার।“

“কিরে গোয়েন্দাগিরি করবি নাকি? এই ভূত এখনো মাথা থেকে যায়নি?”

উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে নীতি, “এই আপা শার্লক হোমস হবি নাকি রে!”

কৈশোরের বৈপরীত্যের জন্যেই হয়তো, চাচীর গয়না চুরিতে যতটা কষ্ট অনুভব করা উচিত তা হচ্ছে না চৈতির। বরঞ্চ মনে হচ্ছে রহস্যাভিযানের শুরু হতে চলল অবশেষে।

“বিষয়টা এতো সস্তা না সোনামণিরা। আগে কয়েকজনকে সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে। তারপর দেখতে হবে চাচীমণি গয়নার লকারে কার কার হাতের ছাপ পাওয়া যায়। তবে চাচীমণি যে গরু খোঁজা দিছে, এতক্ষণে না আলামত নষ্ট হয়ে যায়।“

“এরপর হাতের ছাপ ম্যাচ করাবো অভিযুক্তদের সাথে?”

“আমাদের প্র্যাক্টিসটা কাজে লাগবে এইবার ইন শা আল্লাহ।“ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে চৈতি। হাতের ছাপ সংগ্রহ করে ম্যাচ করার একটা খেলা খেলতো ওরা প্রায়ই। সেই খেলায় অবশ্য নীতি হতো দুধ-ভাত। ঝুঁকি আছে এমন কোনো এক্সপেরিমেন্ট খুব সাবধানে করে ওরা।

“শোন অনীমা, তুই চাচীমণির থেকে কিছু ইনফো এনে দিবি। কিন্তু কেউ যাতে না বুঝে যে আমরা গোয়েন্দাগিরি করছি। নীতি! মুখ বন্ধ, মনে থাকবে? “
“ওর আর মনে থাকবে! যে পেট পাতলা!” ফোঁড়ন কাটে অনীমা।

“হুহ! আমি তোমাদের মতো মনে প্যাচ নিয়ে ঘুরি না। সরল মনে সবাইকে সব বলে দেই। থাকলাম না আমি তোমাদের মিশনে! কি যায় আসে!”
অট্টহাসি দেয় বাকি দুই বোন।

……………………
অনীমার মা বান্ধবী রেবার সাথে দেখা করতে বের হয়েছে। ফোনে আর কতটুকু শেয়ার করা যায়। সুযোগ কাজে লাগায় বিচ্ছুবাহিনী। যেকোনো বিষয়ে থিওরির যোগান দেয় চৈতি, কিন্ত এক্সপেরিমেন্টের বেলায় দক্ষ হলো অনীমা। ওদের ভারী মিশন বক্সটা অতি আগ্রহের সাথে নিয়ে আসে নীতি। হ্যান্ড গ্লাভ্‌স বের করে নেয় অনীমা। বেলুনের ভেতর পানি ভরে চৈতি। বেলুনের নিচে মোম দিয়ে আগুন ধরিয়ে কালি তৈরি করে। কালিটা সাবধানে সংগ্রহ করে নেয় ওরা। ব্রাশ দিয়ে খুব আস্তে আস্তে লকারে ঘষতে থাকে। হাতের ছাপের কোনো অভাব নেই লকারে। আস্তে আস্তে ৭-৮টা ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। একটার উপর আরেকটা ছাপও পড়েছে।

গ্লাভস পড়া হাতে দক্ষ ভাবে টেপ দিয়ে ছাপগুলো তুলে নেয় অনীমা। আগে কত যে কান্ড হতো এই ছাপ নিতে গিয়ে। আগুনের তাপে একবার বেলুন ফেটে গিয়েছিল। কোনো কোনোদিন ছাপ নিতে গিয়ে উল্টো ছাপ ফেলতো ওরা। কোন ছাপ কার এটা চিহ্নিত করতে গিয়ে ঝগড়াও লাগতো।

ওইদিন বাসায় বাইরের লোক বলতে ছিল কাজের মহিলা আর ফ্যান ঠিক করতে আসা মিস্ত্রী। কাজের মহিলা বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে নীতিকে তার সাথে কথা বলতে পাঠায় চৈতি। নীতি যে কারো সাথে গল্প জুড়ে দিতে পারে, আপন করে নিতে পারে খুব সহজে। এই স্বভাবটা ওর মায়ের থেকে পাওয়া। বুয়ার সাথে গল্প করে কিছু ক্লিয়ার তো হলোই না, উলটো সন্দেহ দানা বাঁধলো। সামনে তাঁর নাতনীর বিয়ে। মাত্র ১৬ বছর নাতনীর। শ্যামলা গায়ের রঙ। মোটর বাইক চায় ছেলে পক্ষ। নীতি যৌতুক বিরোধী বয়ান দিয়ে আসলেও খুব একটা লাভ নেই আসলে। গয়না বুয়া সরাতে পারে মানতে মন চায়না ওদের। কিন্তু মানুষ বিপদে পড়লে অনেক কিছুই করে। এখন বুয়া খালার বিপদের দিন। কিন্তু সন্দেহ করার ব্যাপারে খুব সাবধান ওরা তিনজন। চৈতির নীতি হলো,”Everyone is innocent until proven guilty.” আর সূরা হুজুরাতের সেই আয়াতটা মনে রেখেই ওরা গোয়েন্দাগিরিতে নেমেছে।

“তোমরা বেশি বেশি ধারণা থেকে বিরত থাক, কারণ তা পাপ”।

গোয়েন্দাগিরির প্রয়োজনে হয়তো কয়েকজনকে সন্দেহের তালিকায় রাখছে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কাউকে হেনস্থা করবে না ওরা, এমনই ইচ্ছা। ছাপ মিলানোর জন্যে খালার জন্যে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে গিয়েছিল নীতি। হাতে গ্লাভস পড়া থাকলেও খালা কিছুই বুঝেনি। নীতি সারাক্ষণই নানারকম উলটাপালটা কাজ করে। ওর কোনো কিছুই কারো অবাক লাগে না। মিস্ত্রীর হাতের ছাপ নেয়া হবে কিভাবে এই নিয়ে চিন্তায় ছিল ওরা।

অনীমার হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে ওদের মিশন বক্স থেকে কী একটা বের করে সুইচবোর্ডে দিয়ে সুইচ দিতেই স্পার্ক করে উঠে সারা বাড়িতে লোডশেডিং।

“কি করলি এটা অনীমা।“ চিৎকার করে উঠে চৈতি। একটা তার বের করে শর্ট সার্কিট করে ফেলেছে অনীমা। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ থামতে কিছুক্ষণ লাগলো। অনীমা মাঝেমাঝে এমন সব কাজ করে উঠে কেউ বাঁধা দেয়ার আগেই।

“যা করেছি ভালোই করেছি। এবার মিস্ত্রী ডাকার ব্যবস্থা হলো।“

“তাই বলে …! দূর্ঘটনা ঘটতে পারতো।“ চৈতি প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বলে।

“শোনো তোমরা তো এই জীবনে আমার কদর বুঝলা না। থাক ঝগড়া করলেই বাড়ে। কথা কওয়াই লস।“ স্মার্টফোনটার দিকে ঝুকে অনীমা।

অনীমার ঘটানো অঘটনে মিস্ত্রী ইমনকে ফোন দিয়ে আনালো আবরার। ইমনের কাজের ফাঁকে আবারো ঠান্ডা পানির থেরাপি চালালো নীতি। খুব যত্ন করে বুয়া আর মিস্ত্রীর হাতের ছাপ উঠিয়ে রাখলো অনীমা। ইমন আঙ্কেলের চেহারা বা আচরণে সন্দেহের কিছু পায়নি ওরা। কিন্তু তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায় না, সেদিন উনি ফ্যান ঠিক করেছেন ঐ রুমেই।আর ঝানু চোররা সাধারণত সন্দেহ সৃষ্টি করে না। মিটিং এ বসলো তিন বোন।

“তোরা কেউ দেখছিস ছাপগুলোর অবস্থা? একেকটা ছাপ দেখতে একেক রকম লাগছে। আর আমরা যখন খেলতাম তখন এমন ভাবে ছাপ ফেলতাম বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে যেন সহজে আইডেন্টিফাই করা যায়। আর এখানে কখনো অর্ধেক, কখনো একটা সাইড, কখনো পুরোটা। আমাদের পক্ষে কি আসলে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব কোন ছাপটা কার? মনে তো হয় না।“ হতাশ হয়ে বলে চৈতি।

“বাস্তবতা বুঝলি তাইলে! গোয়েন্দাগিরি করা এতো সহজ না।“ অনীমা বলল ‘আমি আগেই জানতাম’ অভিব্যক্তি দিয়ে।

“কিন্তু তাই বলে কী আমরা চেষ্টা করবো না?”
“সেটা তো না করি নাই…” কথায় ছেদ পড়ল কলিংবেলের শব্দে।

সিমির সাথে রেবা এসেছে। সিমি জোর করেই নিয়ে এসেছে। কফি শপে কষ্টের কথা বলেও মন ভরেনি।
“এই পেট কাঁটা বেটি আবার আসছে!” ফোঁড়ন কাটে নীতি।

হেসে উঠে অনীমা, রেবা আন্টিকে সহ্য করতে পারে না ও। চৈতি চোখ রাঙ্গায়। শাড়ি পরা কারো যদি পেট দৃশ্যমান থাকে তাকে নীতি বলে “পেট কাটা মূর্ধন্য ষ”।
“আবার মানে? আমি তো অনেকদিন দেখি না আন্টিকে।“ চৈতি বলল।

“হুহ। তোমার তো অংক করতে বসলে কোনো হুশ থাকে না দুনিয়ার। পরশু রাতেও এসেছিল জন্মদিনের পার্টি শেষে। আসিফ আঙ্কেল এসে নিয়ে গেছে রাত ১১টায়।“

“তাই নাকি! তাইলে এই রেবা শাকচুন্নিকেও সন্দেহের লিস্ট থেকে বাদ দিস না!” অনীমাও মুখ খুলে দিল।
“মন্দ নামে ডাকা বাদ দে। মাথা ঠিক আছে তোদের? রেবা আন্টির যে পরিমাণ প্রপার্টি আছে তাকে উচ্চবিত্ত বলাও ঠিক হবে না। উচ্চ-উচ্চবিত্ত বলা যাইতে পারে।“

“ওই মহিলারে আমার সহ্য হয় না। একে তো ড্রেসাপের কোনো ঠিক নাই, তার উপর কথা বলার সময় অতিরিক্ত আল্লাদ করে। মনটা চায় তুইলা আছাড় মারি। আল্লাহই ভালো জানেন ক্যামনে এইটারে টলারেট করি।আমার মা এর রুচিই নাই। কাদের সাথে যে মিশে!”

“টিট…টিইইট…টিইইইট!” যান্ত্রিক শব্দ করে উঠে নীতি। এটা ওদের গীবত এলার্ট। কেউ গীবত করে ফেললে অপরজন সতর্ক করে দেয় এভাবে।

“বাদ দে তো তোরা। চল আন্টিকে সালাম দিয়ে আসি।“ চৈতি বলল।

“জ্বী খালাম্মা! আপনি যখন বলছেন!” মুখ ভেংচায় অনীমা।

চলবে ইন শা আল্লাহ

…………………

উম্মে লিলি
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮